
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর-দক্ষিণ) আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া রাজনীতিতে ছিলেন আলোচিত ও সমালোচিত। হাসিনার আমলে ঢাকার রাজনৈতিক গডফাদার হিসাবে খ্যাতি এবং চাঁদপুর তথা মতলবে ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। অর্থবিত্তে ঠিক কতটা ফুলে ফেঁপে উঠেছিলেন সাবেক এমপি মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া তা জানা সম্ভব না হলেও তার সঙ্গে থাকা ছোট নেতারাও বনে গেছেন কোটিপতি। ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপে মতলবে শাসন করা এই আওয়ামী লীগ নেতার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে জানে না কেউ।
আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করার সাহস কখনোই পায়নি কেউ। মৃদু প্রতিবাদেও শেষ হয়ে যেত রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। কেবল আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপি নেতারাও ভয়ে কখনো কথা বলতেন না তার বিরুদ্ধে। যেন সবার কাছেই জ্যান্ত আতঙ্ক ছিলেন এই নেতা।
নাম না প্রকাশের শর্তে মতলব উত্তর ও দক্ষিণের একাধিক ব্যক্তি বলেন, মায়া ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বললেই তার ওপর চলত মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন। তিনি মতলবে এতটাই ক্ষমতাধর ছিলেন যখন যা বলতেন সেটাই ছিল মতলবের মানুষের জন্য এক ধরনের সংবিধান। অথচ মতলবে হেন দুর্নীতি নেই যা করেননি এই মায়া চৌধুরী। চাঁদপুর তথা মতলব উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই উপজেলার বিভিন্ন দপ্তরের ঠিকাদারি কাজ, মেঘনা নদীতে বালু উত্তোলন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি, শিক্ষক নিয়োগ ও বদলি, স্থানীয় নির্বাচনসহ সব কিছুই হতো তার কথামতো এবং দিতে হতো নির্দিষ্ট অঙ্কের পার্সেন্টেজ। টিআর কাবিখার টাকা নামে-বেনামে সবই উত্তোলন করতেন তিনি।
পরিচয় না প্রকাশের শর্তে উপজেলার আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেন, এমন কোনো সেক্টর নেই যেখান থেকে টাকা পেতেন না মায়া। সব টাকাই নগদে পৌঁছাত তার কাছে। লেনদেনের মাধ্যম হিসাবে কাজ করতেন তার সহকারী মামুন। অভিযোগ রয়েছে চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের যে সিন্ডিকেট রয়েছে তার মূল হোতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার রায় থাকা সত্ত্বেও মায়া চৌধুরী অবাধে মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করে শত শত কোটি হাতিয়ে নেন। সাধারণ মানুষের জমি দখল থেকে শুরু করে, চাঁদাবাজি, হত্যা, গুম এমনকি অপহরণের মতো জঘন্য কাজও করত মায়া বাহিনী (ভিঙ্গুল বাহিনী) ও তার পরিবার।
তথ্যানুযায়ী জানা যায়, মায়া চৌধুরী ১৯৯৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী দায়িত্ব পান। ২০১৪ সালে সংসদ নির্বাচনে সংসদ নির্বাচিত হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রী হওয়ার পর থেকে নিজের আধিপত্য বিস্তার, অসহনীয় মাত্রায় দুর্নীতি ও লুটপাট। দেশ, বিদেশে গড়েছেন প্লট, ফ্ল্যাট, বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ চিটাগাং রোডে মায়া চৌধুরীর স্ত্রীর নামে আট বিঘা জায়গার মধ্যে রীনালয় সিএনজি পাম্প হাউজ, উত্তরা ১নং সেক্টরে ৬ তলা বাড়ি, গুলশানে হোটেল লেক ভিউ প্লাজার পাশে ৫ কাঠা প্লট, উত্তরা নিকুঞ্জে ফাইভ স্টার হোটেল দ্যা ওয়েস্টার্ন মায়া, ভুলতা গাউছিয়া ৩০ বিঘা জমিতে স্টার থাই এলুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি, গাজীপুরে চৌধুরী গার্মেন্টস, পুরান ঢাকা ভুতের গলিতে আলী ভিলা নামে (৬ তলা) বাড়ি, গুলশান মরিয়ম টাওয়ারে ফ্ল্যাট, উত্তরা ১৪ ও ১৫ সেক্টরে ৩টি বাড়ি, মতলব উত্তর ও দক্ষিণে রয়েছে প্রায় ৩০০ একর ভূমি।
এছাড়াও বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, লন্ডনে কয়েকটি ফ্ল্যাট ও বাড়ি রয়েছে এগুলো দেখাশুনা করে তার নাতি আসফাক চৌধুরী মাহি, কানাডায় বেগম পাড়ায় বাড়ি আছে তিনটি, সেখানে বসবাস তার কন্যা ও নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ মার্ডারের মূল হোতা তৎকালীন র্যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসার তারেক সাঈদ স্ত্রী রিয়া চৌধুরী, আমেরিকায় বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করেছে ওখানে দেখার দায়িত্ব রয়েছে মায়ার ছোট ছেলে রনি চৌধুরী। এছাড়াও মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই গড়ে তোলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
মায়াপুত্র প্রয়াত দীপু চৌধুরীর নেতৃত্বে একসময় উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাব দখলে ছিল। ওই ক্লাবের আধিপত্য ও জমি দখল নিয়ে ২০০০ সালের দিকে তিতাস নামের একজনকে হত্যা করা হয়। দীপু চৌধুরী এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে অভিযোগ ছিল। তখন দীপু চৌধুরীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তার পরও দীপু ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দলীয় প্রভাব খাটিয়ে দীপুকে রক্ষা করেন তখনকার প্রতিমন্ত্রী বাবা মায়া চৌধুরী।
এছাড়াও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাজধানীর উত্তরায় ঠিকাদার তরাজ উদ্দিন খুনের ঘটনায় মায়ার প্রয়াত ছেলে দীপু চৌধুরীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দীপু চৌধুরী আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন। পালটে যায় দৃশ্যপট। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার মতো বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হন তারা।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য মায়ার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তা দিয়েও মেলেনি উত্তর।