Image description
আওয়ামী শাসনে আলেম নিপীড়ন

রাজপথে সোচ্চার থাকার কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের বিশেষ টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন মাওলানা মুহাম্মাদ মামুনুল হক। নানাভাবে জুলুম-নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় প্রাণনাশের শঙ্কায়ও ছিলেন তিনি। সম্পূর্ণ বিনা অপরাধে দুই দফায় তিন বছরের বেশি সময় কেটেছে কারাগারে। দীর্ঘ ৪১ দিন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। আদালতে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরিয়ে তাকে শীর্ষ সন্ত্রাসীর মতো হাজির করা হয়। রিমান্ডে চোখ বেঁধে-হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তার চুলের ডিএনএ চুরি করে তা ভুয়া অভিযোগের মামলার আলামত হিসেবে ব্যবহারের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।

শুধু এসব নির্যাতনই নয়, চরিত্র হননের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা অপচেষ্টার মুখোমুখি হন মামুনুল হক। এরই অংশ হিসেবে সোনাগাঁয়ের একটি রিসোর্টে দ্বিতীয় স্ত্রীসহ অবরুদ্ধ করে আটকের চেষ্টা ও পরে তার বাসা থেকে ওই স্ত্রীকে তুলে নিয়ে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। পরে সেই মামলা থেকে বেকসুর খালাসের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ষড়যন্ত্রের বাস্তবতা প্রকাশ পায়।

শেখ হাসিনা সরকারের ইসলাম ও দেশবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক। রাজনীতির মাঠ থেকে শুরু করে ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিল এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ জনপ্রিয় ও আলোচিত হয়ে ওঠেন মরহুম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের এই ছেলে। সরকারি মহলের নানা প্রলোভন আর ভয়ভীতি উপেক্ষা করেই মাঠে সক্রিয় ছিলেন তিনি। এসব কারণেই তিনি আওয়ামী সরকারের রোষানলে পড়েছিলেন বলে মনে করেন কওমি অঙ্গনের অন্যতম শীর্ষ এই আলেম।

আলেমদের ওপর নির্যাতন প্রসঙ্গে মাওলানা মামুনুল হক আমার দেশকে বলেন, আওয়ামী শাসনের সময়টা আলেম-ওলামা এবং ইসলামের ধারক-বাহকদের জন্য খুব খারাপ ছিল। এ সময় অনেকেই নানাভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে তিনি নিজেই সরকারের টার্গেটে পরিণত হন। তার ওপর জুলুমের মাত্রাটাও ছিল ভিন্ন ধরনের। কঠিন দুঃসহ সময় পার করতে হয়েছে তাকে।

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের এই যুগ্ম মহাসচিব জানান, বিগত সরকার যাদের পথের বাধা হিসেবে বিবেচিত করেছে, তার অন্যতম ছিল কওমি অঙ্গন, বিশেষ করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। শাহবাগে নাস্তিক্যবাদী শক্তির উত্থানের মধ্য দিয়ে হেফাজতকে মাঠে নামতে বাধ্য করা হয়। আর হেফাজত যখন মাঠে আসে, তখন তাদের ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে তারা মোকাবিলা করে। শাপলা চত্বরে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হয়। আপাতদৃষ্টিতে তারা সে সময় হেফাজতকে বাহ্যিকভাবে পেছনে ঠেলে দিতে সক্ষম হয়। তবে কার্যত ২০১৩ সালের এ ঘটনা দীর্ঘ মেয়াদে আওয়ামী লীগের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে পরিণত হয়েছে। ইসলামপ্রেমীদের মনে আওয়ামী লীগের প্রতি ঘৃণা জন্ম দেয়।

মামুনুল হক বলেন, তাকে নিয়ে আওয়ামী সরকারের মেগা পরিকল্পনা ছিল। ভিনদেশির প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা, সহযোগিতাসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তার বিরুদ্ধে মাঠে একযোগে কাজ করে। তার মধ্যে বড় ভূমিকা পালন করে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। তারা তাকে সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলার পরিকল্পনা নেয়। তাকে কেন্দ্র করে এ দেশের আলেম সমাজ ও হেফাজতের নেতারা বিশেষ করে প্রতিবাদী আলেমদের ঘায়েলের ঘৃণ্য পরিকল্পনা আঁকে। সে অনুযায়ী চরিত্রহননের মতো নাটক মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সংস্থা তাদের সেই কাজ শুরু করে।

শেখ মুজিবের ভাস্কর্য এবং মোদির আগমনবিরোধী আন্দোলন ঘিরে আওয়ামী সরকারের ব্যাপক তোপের মুখে পড়েন আলেম-ওলামা ও ধর্মপ্রাণ মানুষ। ধরপাকড়ের শিকার হন বহু আলেম, ছাত্র-জনতা এবং হেফাজত নেতারা। সে সময় ধরপাকড়ের টার্গেটে পড়েন মাওলানা মামুনুল হক। একপর্যায়ে বিনা অপরাধে ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল মোহাম্মদপুরে নিজ কর্মস্থল জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা থেকে গ্রেপ্তার হন তিনি।

গ্রেপ্তার-নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি উল্লেখ করে মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘গ্রেপ্তারের পর ধারাবাহিকভাবে প্রায় ৪০ দিন ডিবিতে রিমান্ডে ছিলাম। রিমান্ডে খুব বেশি শারীরিক টর্চার না করা হলেও প্রচণ্ড মানসিক টর্চার করা হয়েছে। রিমান্ডের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ লোমহর্ষক যে কাজটি করা হয়, সেটি হলো এক দিন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিশেষ একটি কামরায় নিয়ে চোখ বাঁধে ও হ্যান্ডকাফ পরায়। মাথার টুপিও খুলে ফেলা হয়। সাধারণত জিজ্ঞাসাবাদের সময় এ রকম রীতি নেই এবং আমাদের আগে-পরে কারও করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘ওইদিন ছিল শুক্রবার। তারা তেমন কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেনি, কিন্তু মাথার চুলে টান লাগা অনুভব করলাম। পরে পুলিশ কর্মকর্তাদের কথাবার্তায় অনুমান করলাম যে, ওই সময় আমার মাথার ডিএনএ চুরি করে নিয়েছে। সেই ডিএনএ আমার বিরুদ্ধে মানহানিকর-চরিত্রহননের মামলার আলামত হিসেবে নিয়ে গেছে। হয়তো ডিবিতে থাকা অবস্থায় আমার ব্যবহারের কাপড়-চোপড়ও নিতে পারে। এটা ছিল আমার সঙ্গে ভয়াবহ-বর্বর আচরণ। এ ছাড়া রিমান্ডে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপর্যুপরি জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে।’

রিমান্ডের পর দীর্ঘ প্রায় তিন বছর কারাগারে ছিলেন ঢাকা মহানগর হেফাজতে ইসলামের এই সেক্রেটারি। এ সময় বহু মামলার মুখোমুখি হন তিনি। প্রতিনিয়ত আদালতে যাতায়াত করা ছিল তার জন্য কষ্টকর। তাকে কোর্ট গারদে রাখা হতো অনেক সময়।

২০১৩ সালেও শাপলা চত্বরের ঘটনার পর গ্রেপ্তার হন মামুনুল হক। এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, খুলনায় একটি মামলায় হাজিরা দিতে গেলে ভোরে শিববাড়ী মোড় থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তার বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দেয়, যার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। ঢাকায় বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের সময়কার বিভিন্ন জটিল মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের ঘটনার বিভিন্ন মামলায় জড়ানো হয়। ওই সময় তাকে দুদিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। ১৫টি মামলায় তখন জামিন নিয়ে বের হতে হয় তাকে। বিভিন্ন মামলায় ঢাকা-খুলনায় বারবার যাতায়াত করতে হয়েছে।

তবে ২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় গ্রেপ্তারের পর ৪১টি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সবগুলোয় পর্যায়ক্রমে জামিন নিয়ে বের হতে হয়েছে তাকে।

পরিবারের ভোগান্তি প্রসঙ্গে মামুনুল হক বলেন, ২০২১ সালে গ্রেপ্তারের আগে-পরে তার পরিবারের ওপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে গেছে। ডিবি ও পুলিশ সদস্যরা এসে তার স্ত্রীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাকে দিয়ে মামলা করানো হয়েছে। এ সময় পরিবারের অন্য সদস্যরা ভীতিকর অবস্থার মধ্যে ছিল। এরপর পরিবারের লোকজনের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি করা হতো। দুটি মাদরাসার সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছিল। এর মধ্যে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়ায় নির্মাণাধীন একটি মাদরাসায় পুলিশ অভিযান চালায়। সেখানে ছাত্র-শিক্ষক যাদের পেয়েছে, সবাইকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। মাদরাসাটি তালাবদ্ধ করে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে ছিল প্রায় এক বছর। সেখানে তাদের কোনো লোকজনের যাতায়াতের সুযোগ ছিল না।

মোহাম্মদপুরে জামিয়া আরাবিয়া রাহমানিয়া মাদরাসা নিয়ে সরকারের ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে মামুনুল হক বলেন, কিছু আইনি জটিলতার সুযোগে মাদরাসাটি প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার সব আয়োজন তারা করে। তারা বাবা আল্লামা আজিজুল হক প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাটি ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা ধারাবাহিকভাবে পরিচালনা করছিলেন তিনি। তার বড় ভাই মাওলানা মাহফুজুল হক এটির প্রিন্সিপাল ছিলেন। সেটিকে সরকার দখলে নিয়ে প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দেয়। এভাবে গুলশানে একটি মসজিদ-মাদরাসা নিয়ে তাবলিগের মধ্যে বিরোধ ছিল। সেই বিরোধ কেন্দ্র করেও তাকে আসামি করে মামলা দেওয়া হয়। মোহাম্মদপুরের মাদরাসা প্রতিপক্ষের হাতে তুলে দিতে ভূমিকা রাখায় পুলিশের একজন ডিআইজিকে পরে রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়া হয়।

দমন-পীড়নের পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন প্রলোভনও দেওয়া হয়েছে মামুনুল হককে। তবে এসব কথায় কোনো গুরুত্ব না দেওয়ায় তারা আগ্রহ হারিয়েছে বলে মন্তব্য মামুনুল হকের।

ঢাকার আজিমপুরে ১৯৭৩ সালে জন্মগ্রহণকারী মামুনুল হক কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রির পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ইসলামি রাজনীতির পাশাপাশি তিনি মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসায় শায়খুল হাদিস হিসেবে কর্মরত। মাসিক রাহমানি পয়গাম নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক তিনি। এ ছাড়া বহু ইসলামি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত মাওলানা মামুনুল হক।