শেখ হাসিনার সরকারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা একের পর এক ধরা পড়ে জেলে, আন্দোলনের মাঠ প্রায় নেতৃত্বশূন্য। এ সময় দলের মুখপাত্র হয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করতে থাকেন যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ। গ্রেপ্তার এড়াতে একপর্যায়ে আত্মগোপনে থেকে দিতে থাকেন বিপ্লবী ভিডিও বার্তা। তাতে চাঙা হয়ে ওঠে আন্দোলন। বিএনপির এই কেন্দ্রীয় নেতাকে ধরতে হন্যে সরকারি বাহিনী। কিন্তু তার হদিস করতে পারছে না কেউ। শেখ হাসিনার সরকারের মন্ত্রী এবং দলের নেতারা তাকে কটাক্ষ করেন এই বলে- তালেবানের মতো তোরাবোরা পাহাড় থেকে ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন সালাহউদ্দিন। জঙ্গি তকমা দিতেও ছাড়েননি তারা। পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র লেগেছে তার পেছনে। বেশি দিন নিজেকে গোপন রাখতে পারেননি দলের দুঃসময়ের এই মুখপাত্র।
২০১৫ সালের ১০ মার্চ তাকে ট্র্যাক করে ফেলে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। সেদিন রাত সাড়ে নয়টায় উত্তরার তিন নম্বর সেক্টরের একটি বাসা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় তারা। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই তার। গুম করা হয়েছে, নাকি ইতিমধ্যে ইলিয়াসের ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে তাকে, এ নিয়ে তখন সারা দেশে উদ্বেগ-কানাঘুষা। কোথায় নেওয়া হয় সালাউদ্দিনকে? তার ভাষ্য, কবরের মতো একটি কামরায় ফেলা হয় তাকে। কোনো বাড়ির নিচতলা সেটি। ছাদে হাই পাওয়ার লাইট। নিঃসঙ্গ এই কক্ষে কাটে ৬১ দিন। খাবার দেওয়া হতো লোহার দরজার নিচ দিয়ে। টয়লেটের জন্য কোনোরকম ব্যবস্থা ওই কক্ষেই। দুই মাস ধরে এখানে প্রায়ই তাকে নির্যাতন করা হয় সরকারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের ইশারায়। সেই আয়নাঘরে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গোনেন বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন। চরম নির্দেশ এসে গেছে শেখ হাসিনার সরকার থেকে। ইলিয়াসের ভাগ্যই তাকে বরণ করতে হবে।
কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? তুলে নেওয়ার ৬৩ দিন পর ১১ মে ভোরে মেঘালয়ের শিলং শহরে সালাহউদ্দিন। তখনো ভোর রাত। বিপর্যস্ত সালাহউদ্দিনকে উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ। সে আরেক গল্প। আমরা বরং তার মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে যাওয়ার নেপথ্য ঘটনা বলি। ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধান বলছে, সালাহউদ্দিনকে আয়নাঘরে নির্যাতন আর জিজ্ঞাসাবাদ চলার একসময় মৃত্যুর পরোয়ানা আসে সরকারের হাইকমান্ড থেকে। তা কার্যকর করতে তৎপর হয়ে ওঠেন আয়নাঘরের হোতারা। বাদ সাধেন র্যাবের তখনকার শীর্ষ একজন কর্মকর্তা। সঙ্গত কারণেই তার নামটি এখানে গোপন রাখা হচ্ছে। সালাহউদ্দিনের ভাগ্য যাতে ইলিয়াসের মতো না হয় ভেতরে ভেতরে তৎপর হয়ে ওঠেন তিনি। র্যাবের ওই কর্মকর্তার দীর্ঘদিনের চেনা মানুষ সালাহউদ্দিন। মানুষটির চরম অমঙ্গলে সায় দেয় না তার মন। দেশে সরকার ও রাজনীতির যে উত্তুঙ্গ পরিস্থিতি, তিনি কী করবেন বুঝতে পারেন না। কাউকে বলতেও পারছেন না।
নানা কৌশলে তিন দিন আটকে রাখেন ওপর মহলের চরম নির্দেশ। সালাহউদ্দিনকে কেন বাঁচাতে চাইছিলেন তিনি, সেই রহস্য জানতে পেরেছে ঢাকা টাইমস। ওই কর্মকর্তা অব দ্য রেকর্ড একজন সিনিয়র সাংবাদিককে তখন বলেছিলেন, তার ওপর অনেক চাপ ছিল সালাউদ্দিনের জন্য আসা নির্দেশ বাস্তবায়নে। এমন চাপ তার চাকরিজীবনে কখনো ফেস করেননি তিনি। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কার্যকরে বাধা দিলে নিজেরও বিপদ হতে পারে, ভাবছিলেন ওই কর্মকর্তা। এই সময়ে একটা পথ খুঁজে পান সালাউদ্দিনকে বাঁচানোর। সেই ছকেই পরে কাজটি হয়। এক গভীর রাতে সালাহউদ্দিনকে সীমান্তের ওপারে ফেলে আসেন বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা। গুপ্তহত্যা থেকে বেঁচে যান বিএনপির জনপ্রিয় এই নেতা। হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন কর্মকর্তাটি। সালাউদ্দিনের প্রতি র্যাবের ওই কর্মকর্তার সহানুভূতির কারণ পরে বুঝতে পারেন সাংবাদিকটি, যখন তিনি জানতে পারেন তারা বিসিএসের একই ব্যাচের প্রার্থী।
১৯৮৫ সালে তারা বিসিএস উত্তীর্ণ হন। সালাহউদ্দিন পান প্রশাসন আর ওই কর্মকর্তা পুলিশ ক্যাডার। ওই সময়ই তাদের দুজনের পরিচয়। কর্মকর্তাটি এখন আর পুলিশে নেই। গুপ্তহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া সালাহউদ্দিন নয় বছর পর দেশে ফেরেন শিলং থেকে। সালাহউদ্দিন ১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী একান্ত সচিব ছিলেন। পরে সরকারি চাকরি ছেড়ে যোগ দেন বিএনপিতে। ১৯৯৬ সালে প্রথম কক্সবাজার থেকে দলের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ২০০১ সালে এমপি নির্বাচিত হয়ে চারদলীয় জোট সরকারের যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৬ সালে দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে তার অনুপস্থিতিতেই স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হয় জনপ্রিয় এই নেতাকে। নয় বছর ভারতে আটকে থাকার সময় শিলংয়েই অবস্থান করেন বিএনপির এই সুদর্শন নেতা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর সুগম হয় দেশে ফেরার পথ। ট্রাভেল পাস নিয়ে গত ১১ আগস্ট দিল্লি থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে দেশে ফেরেন তিনি। ছুটে যান নিজের মাতৃভূমি কক্সবাজারে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফেরা সালাহউদ্দিন ফুলেল সংবর্ধনায় সিক্ত হন বিপুল মানুষের ।