Image description
তদন্ত প্রতিবেদন জমা ♦ মানবতাবিরোধী অপরাধে প্ররোচনা ♦ সরাসরি হত্যার নির্দেশ ♦ শিশুদের টার্গেট করে হত্যা ♦ আহতদের চিকিৎসায় বাধা ♦ নিহতদের ময়নাতদন্তে বাধা

জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

গতকাল ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ে এ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও গণ অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে ট্রাইব্যুনালে সংবাদ সম্মেলন করে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এ তথ্য জানান। নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা প্রথমে চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এখন চিফ প্রসিকিউটর এ তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আকারে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবেন। এ প্রক্রিয়ায় দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে চিফ প্রসিকিউটর জানান।

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে তিনজনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ রয়েছে। সেই অভিযোগগুলোর মধ্যে দুটি অভিযোগ প্রকাশ করা হয়েছে। বাকিগুলো আপাতত প্রকাশ করা হচ্ছে না। চিফ প্রসিকিউটর বলেন, প্রথম অভিযোগটি হচ্ছে, শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধে উসকানি ও প্ররোচনা দিয়েছেন। এক সংবাদ সম্মেলনে রাজাকারের নাতিপুতি বলে উল্লেখ করেছিলেন। এটা বলার মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এরপর তারা মানবতাবিরোধী এসব অপরাধ করে। এ উসকানির দায়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় যে অভিযোগ তা হলো হত্যার নির্দেশ। তদন্ত সংস্থা শেখ হাসিনার অনেকগুলো টেলিফোন কনভারসেশন জব্দ করেছে। সেখানে তিনি বারবার সুস্পষ্টভাবে নিশ্চিত করেছেন, রাষ্ট্রীয় সব বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন, হেলিকপ্টার, ড্রোন, এপিসিসহ মারণাস্ত্র ব্যবহার করে নিরস্ত্র নিরীহ আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। সরাসরি সেই নির্দেশের প্রমাণপত্র আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা হাতে পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তার বিরুদ্ধে এই দ্বিতীয় অভিযোগটি দাখিল করেছে।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে জুলাই-আগস্টে প্রায় দেড় হাজার আন্দোলনকারীকে হত্যা এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি করে আহত করার তথ্য উঠে এসেছে। শিশুদের টার্গেট করে হত্যা, আহতদের চিকিৎসায় বাধা এবং নিহতদের ময়নাতদন্তে বাধা দেওয়ার অভিযোগও আনা হয়েছে। এমনকি, শেখ হাসিনা নিজে হাসপাতালে গিয়ে আহতদের চিকিৎসা না দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তাজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে বিচার, এটা কোনো সাধারণ বিচার নয়। রাজপথের চাপের ভিত্তিতে কোনো বিচার করা সম্ভব নয়। এটা একটা প্রফেশনাল জায়গা। এখানে আইনের এবং ইনভেস্টিগেশনের অনেক খুঁটিনাটি জটিল বিষয় আছে। চাপ দিলেই এখানে কিছু করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, আমরা চাইব এ বিচারের কোনো ধরনের অনিয়ম না হোক এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন না হোক। পাশাপাশি এ বিচারে যেন কোনো ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি না হয় এবং বিচারকার্য যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কল রেকর্ড, ভিডিও ফুটেজ, উদ্ধারকৃত বুলেট, হেলিকপ্টারের ফ্লাইট শিডিউলসহ বিভিন্ন আলামত জমা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের যেসব ডাক্তার চিকিৎসা দিয়েছেন বা অ্যাটেন্ড করেছেন তারা সাক্ষী হিসেবে আসবেন। যারা সরাসরি আহত হয়েছেন, তারাও সাক্ষী হিসেবে আসবেন। পাশাপাশি শহীদ পরিবারের যারা তাদের নিজেদের স্বজনদের লাশ রিসিভ করেছেন, দাফন করেছেন, তারাও সাক্ষী হিসেবে আসবেন। পাশাপাশি আলামত হিসেবে বিভিন্ন কল রেকর্ড, অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ এবং বুলেট যেগুলো নিহত বা আহতদের শরীর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলো। যেসব হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোর ফ্লাইট শিডিউল, সেখানে কারা যাত্রী ছিলেন ও কী ধরনের অস্ত্র সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো তদন্ত সংস্থা দাখিল করেছে। এসব আলামত বিশ্লেষণ করে আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে জানান চিফ প্রসিকিউটর। গত বছরের ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণ অভ্যুত্থানের সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় তিনবার বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গত ২০ এপ্রিল এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সময় বাড়ানোর আবেদন করেছিল প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় দুই মাস বাড়ানো হয়। আগামী ২৪ জুনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল। অবশ্য এর আগেই প্রতিবেদন জমা দিল তদন্ত সংস্থা। এ মামলা ছাড়াও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অপর মামলাটি হয়েছে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়।