Image description

েভিড বার্গম্যান গতকাল ফেসবুকে একটি পোস্টে লিখেছেন- আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা হবে এই সরকারের জন্য একটি মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত। তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে জুলাই-আগস্ট মাসের হত্যাগুলো আওয়ামী লীগ সরকার করেছে—দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নয়। তিনি জবাবদিহিতার দাবিতে সোচ্চার ছাত্রনেতাদেরকে ' মব উসকানিদাতা' হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।

এর প্রেক্ষিতে আমি নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে চাই-

১। তাত্ত্বিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে আওয়ামী লীগকে একটি দল হিসেবে এবং সরকারে তাদের ভূমিকাকে পৃথক করে দেখা সম্ভব হলেও, আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এই বিভাজন ধোপে টেকে না। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আওয়ামী লীগ শুধু শাসন করেনি, বরং দলীয় কাঠামোর মাধ্যমেই শাসন করেছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। দলটির প্রভাব বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসন এমনকি নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। দলীয় নির্দেশনা ও রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের মধ্যে আর কোনও বাস্তব পার্থক্য অবশিষ্ট ছিল না। এটি শুধু রাজনীতিকীকরণ নয়, বরং রাষ্ট্রের দলীয়করণের এক নগ্ন রূপ ছিল।

আর এই দল ও রাষ্ট্রের একীভূত অবস্থানই ছিল জুলাই-আগস্ট মাসের গণহত্যার মূল সহায়ক। একটু স্মরণ করুন—বেশিরভাগ যায়গাতেই আওয়ামী লীগ কর্মী ও পুলিশ বাহিনী একসঙ্গে, সমন্বিতভাবে, অস্ত্রধারী অবস্থায় নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। সরকার ও দলের মধ্যে একটি ‘পরিষ্কার তাত্ত্বিক বিভাজন’ তুলে ধরার প্রস্তাব হয়তো আকর্ষণীয় শোনাতে পারে, কিন্তু বাস্তবে সেই বিভাজন কখনোই ছিল না।

২। ডেভিড আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো ছাত্রনেতাদের ‘মব উসকানিদাতা’ বলে বর্ণনা করেছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এই ধরনের শব্দ ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বনের পক্ষপাতী, বিশেষ করে এমন একটি দেশে যেখানে গণতান্ত্রিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক এসেছিল প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি থেকে নয়, বরং ছাত্র, শ্রমিক ও তরুণ সংগঠকদের হাত ধরে।

১৯৫২ সালে ‘মব উসকানিদাতা’ বলেই আখ্যায়িত করা হয়েছিল তাদের, যারা রাষ্ট্রের নির্দেশ অমান্য করে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা করেছিল এউ ছাত্রসমাজই। ১৯৯০ সালে সামরিক শাসন পতনের নেপথ্যে ছিল না কোনও বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক, বরং ছিল ছাত্র ঐক্যজোট। আর আজও, সেই একইভাবে, শোকাহত, ক্ষুব্ধ ও নীতিনিষ্ঠ ছাত্ররাই এমন একটি রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে—যে রাজনীতি তাদের বন্ধুদের হত্যা করেছে, এবং একটি পুরো প্রজন্মকে পঙ্গু করে রেখেছিলো।

এটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের জন্য নয়। বেলগ্রেডে ছিল ‘ওতপোর’ আন্দোলন, কায়রোতে তাহরির স্কয়ার, আর সোয়েটোতে ছিল স্কুলশিশুরা—যারা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্য নীতিতে পরিবর্তন এনেছিল। ডেভিড বার্গম্যানের এই তথাকথিত ‘মব উসকানিদাতারাই’ ইতিহাসে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের অগ্রভাগে ছিলেন। তাদের প্রতিরোধ কোন হঠকারিতা নয়; এটি সেই নৈতিক স্পষ্টতা, যা পেশাদার রাজনীতি ব্যর্থ হয়ে পডলে দৃশ্যমান হয়।

৩। আপনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করলে দেশের একটি বড় অংশের ভোটাররা রাজনৈতিকভাবে বঞ্চিত হবে। কিন্তু এই আপত্তির পেছনে একটি ধারণা কাজ করছে—যেন রাজনৈতিক অংশগ্রহণ একটি শর্তহীন অধিকার। বাস্তবে তা নয়।

ট্রানজিশনাল জাস্টিস  নীতিতে, যেসব দল বা ব্যক্তিকে সংগঠিত ও পদ্ধতিগত অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনা হয় না। বিশ্বজুড়ে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি হলো—গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের পূর্বশর্ত হচ্ছে জবাবদিহির প্রক্রিয়া; সেটা না হওয়া ছাড়াই বা তাকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ শুরু করা যায় না।

দক্ষিণ আফ্রিকায়, বর্ণবৈষম্য পরবর্তী সময়ে যারা রাজনীতিতে ফিরতে চেয়েছিল, তাদের আগে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের সামনে সত্য প্রকাশ করতে হয়েছিল। লাইবেরিয়ার যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে, চার্লস টেলরের দলকে শুরুতে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। বসনিয়ায়, যেসব দল জাতিগত নিধনের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের ডেটন চুক্তির অধীনে কিছু সময়ের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই উদাহরণগুলো কোনো প্রান্তিক বা ব্যতিক্রমী মডেল নয়—এগুলো ছিল আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত কাঠামো, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল অপরাধে লিপ্ত অথচ অনুতপ্ত নয় এমন গোষ্ঠীর রাষ্ট্রক্ষমতা পুনর্দখল প্রতিরোধ করা।

এটি প্রতিশোধ নেওয়ার বিষয় নয়, বরং গণতান্ত্রিক পুনর্জন্ম সুরক্ষিত করার প্রশ্ন। দায়বদ্ধতার বিষয়টি ক্ষমতা হস্তান্তরের পরের জন্য স্থগিত রাখার প্রস্তাব মানে হচ্ছে বহুত্ববাদের নামে দায়মুক্তিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া।

সবশেষে, এখন আওয়ামী লীগের সরকারে থাকা অবস্থায় তার কার্যক্রম ও দল হিসেবে তার বৈধতার মধ্যে একটি  তাত্ত্বিক বিভাজন টানার মানে হলো সেই কাজটাই করা, যা  ট্রানজিশনাল জাস্টিস গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে এসেছেন; অর্থাৎ, নিপীড়নের সহায়ক কাঠামোগুলোকেই তাত্ত্বিকভাবে বিমূর্ত করে তাদের দায় এড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া।

এখন যদি কেউ বলেন আওয়ামী লীগ যা সরকারে করেছে সেটা আলাদা, আর দল হিসেবে তাদের বৈধতা ঠিক আছে—তাহলে সেটা ঠিক সেই ভুলটা হবে যেটা ট্রানজিশনাল জাস্টিস গবেষকরা বারবার নিষেধ করেছেন। এইভাবে নিপীড়নের কাঠামোগুলোকে তাত্ত্বিকভাবে গোপন রাখা হয়, আর তারা কোনও পরিণতির মুখোমুখি হয় না।

এর ফলাফল সুস্পষ্ট—পুনরায় সেই একই ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা, যা অতীতে ধ্বংস ডেকে এনেছিল।

-খালেদ সাইফুল্লাহ