Image description

রেলওয়ে উন্নয়নের নামে শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ব্যাপক লুটতরাজ হয়েছে। হাসিনার একক ইচ্ছায় সাড়ে ১৫ বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিশেষ দুটি প্রকল্পসহ ৯৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অভিযোগ-লুটপাট করতে বড় প্রকল্পগুলো একপ্রকার সমীক্ষা ছাড়াই নেওয়া হতো। এগুলোর সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে ১০-১৫ গুণ বেশি দেখানো হতো। এসব প্রকল্প থেকে ১৫ থেকে ৩৫ শতাংশ অর্থ লুটপাট করা হয়েছে। 

এজন্য শেখ হাসিনা, বোন শেখ রেহানা, রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি এবিএম ফজলে করিমসহ সাবেকমন্ত্রী ও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা করেছে। সেখানে দুর্নীতিতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা।

২০১১ সালে গঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পর্যায়ক্রমে ছয়জন রেলপথমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ মন্ত্রণালয়ে টানা সংসদীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন ফজলে করিম চৌধুরী। মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র অনুযায়ী, পরিকল্পনাহীন উন্নয়নে শুধু লুটপাটের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ৩৬০ কোটি থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়েছেন। অস্বাভাবিক ব্যয়ে চলমান পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার প্রকল্পের মধ্যে বেশ কয়েকটির কাজ বন্ধ রয়েছে। 

এছাড়া লুটপাটের আশায় আরও প্রায় পৌনে ৬ লাখ কোটি টাকার মহাপরিকল্পনাও করেছিলেন শেখ হাসিনা। দুই বোনের (হাসিনা-রেহানা) দুর্নীতিসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগের পর অভিযোগ পড়ছে। রেল অঙ্গনে ফজলে করিম চৌধুরী ও ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরীর ত্রাসের রাজত্বের চিত্র বেরিয়ে আসছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে প্রকল্প ও কর্মকর্তাদের জিম্মি করে তারা অর্থ লুটপাট করতেন। মাঠপর্যায়ের রেল কর্মকর্তা-ঠিকাদারদের নির্যাতন করতে চট্টগ্রাম শহরে বাপ-বেটা মিলে টর্চার সেল তৈরি করেন। টর্চার সেলে নিয়মিত বৈঠক-সভা বসাতেন ফজলে করিম ও ফারাজ করিমরা। 

এ প্রসঙ্গে রেলওয়ে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, পুরো রেলে উন্নয়নের নামে যে লুটতরাজ হয়েছে, তা পদে পদেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দুদকসহ আমাদের মন্ত্রণালয়ে বহু অভিযোগ পড়েছে। 

এসব অভিযোগের সত্যতাও মিলছে। দুদক অনুসন্ধান করছে, আমরাও সহযোগিতা করছি। ফজলে করিম ও ফারাজের নামে-বেনামে রেলে ব্যবসা রয়েছে-এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। সব অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি এবং ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জানা যায়, অধিকাংশ প্রকল্প সমীক্ষা ছাড়া গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করায় সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। রেলে ব্যাপক লুটপাটে ফজলে করিম, সাবেক রেলপথমন্ত্রী, সচিব, রেলওয়ে ডিজি ও প্রকল্প পরিচালকরা সমর্থন করেছেন। ফজলে করিম ছিলেন উন্নয়ন প্রকল্পের ঘোষিত ত্রাস। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে লুটতরাজের শক্তিশালী চক্র। এ চক্রের অন্যতম সদস্য ছিলেন চট্টগ্রামের যুবলীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। বাবরের সঙ্গে সহযোগী ছিলেন শতাধিক ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা। রেলে টেন্ডার-চাঁদাবাজি ও প্রকল্পের আদ্যোপান্ত তারা নিয়ন্ত্রণ করত।

পূর্বাঞ্চল রেলের সিআরবি পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে সদরসহ দুই অঞ্চলের চারটি বিভাগ নিয়ন্ত্রণ হতো ফজলে করিমের ইশারায়। তার সঙ্গে তাল মেলাতেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। রেলের ক্রয়সংক্রান্ত বিষয় থেকে শুরু করে প্রকল্প অনুযায়ী চাঁদা ও পার্সেন্ট পৌঁছে যেত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার দরবারে।

১৫ বছরে রেলে বাস্তবায়িত প্রায় সবকটি প্রকল্পের সময় ও অর্থব্যয় একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে। কোনো কোনো প্রকল্প দুই বছরের স্থলে ১৩ বছর লেগেছে। ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্প ১৮ হাজার কোটি টাকায় বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অধিকাংশ প্রকল্পের ব্যয় শুরুর ব্যয়ের চেয়ে ৪-৫ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে।

 প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় কী করে বাড়ানো যায়, এ নিয়ে ফজলে করিমের আস্তানায় রীতিমতো সভা বসত। সেখানে রেলপথমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রকল্প পরিচালক, প্রকৌশলী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, সচিব বৈঠক করতেন। মাঠ পর্যায়ে থাকা রেলওয়ের কর্মকর্তারা বৈঠকের সিদ্ধান্তে অমত প্রকাশ করলেই চলত একধরনের নির্যাতন। বাবরের বিরুদ্ধে সিআরবিতে হত্যা মামলাসহ ৯টি মামলা রয়েছে। অথচ ফজলে করিমের ছত্রছায়ায় তাকে জেলে থাকতে হয়নি। সিআরবিতে এমনকি রেলওয়ে অফিসারদের বাসায় দল বেঁধে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতেন চক্রের সদস্যরা। বাবরসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের কামরুল হাসান, রায়হান, মামুন, সুজন বড়ুয়া, ফয়সাল, মিজানুর, নজরুল, আনোয়ার, জাফর, আমির, রাজেশসহ ১৫ জন সিআরবি ও রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বাসভবনে মহড়া দিতেন।

পূর্বাঞ্চল রেলের সাবেক এক প্রধান প্রকৌশলী জানান, ফজলে করিমের নির্দেশনা পালন করতে দেরি হওয়ায় একদিন রাতে তার রেলওয়ে বাসভবনে জোর করে প্রবেশ করে পিস্তল ঠেকিয়ে গালাগাল করেন তার লেলিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক সাবেক জিএম যুগান্তরকে বলেন, রেলের যে কোনো বিভাগীয় পদে যোগদানকারী কর্মকর্তাকে ফজলে করিমের সঙ্গে দেখা করতে হতো। বাপ-ছেলের (ফজলে করিম ও ফারাজ করিম) হয়ে কাজ করতে হতো। কাজ না করলেই রেলের কর্মকর্তা, ঠিকাদারদের টর্চার সেলে নিয়ে মারধর করা হতো। নির্যাতনের শিকার রেলওয়ে সরঞ্জাম ক্রয় দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, চট্টগ্রামের ৩০নং বান্ডিল রোড পাথরঘাটায় ইকবাল ভিলায় তাদের একটা টর্চার সেল রয়েছে। রেলওয়ে ওয়াশিং প্ল্যান্টবিষয়ক সরঞ্জাম ক্রয় বিষয়ে কথাবার্তায় নড়চড় হওয়ায় তাকে মারধর করা হয়। ওই সময় ফজলে করিম ও ফারাজ করিম উপস্থিত ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ১২-১৫ জন সন্ত্রাসী। অপর একজন প্রকৌশলী জানান, রাজশাহী ও পার্বতীপুর থেকে রেলের অফিসাররা ঢাকা ও চট্টগ্রামে ফজলে করিমের সঙ্গে দেখা করতেন।

নামে-বেনামে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রেলে ফজলে করিম ও ফারাজ করিম কাজও করতেন। ফজলে করিমের শ্যালক এম এহসানকে দিয়ে নেক্সট জেনারেশন গ্রাফিক্স লিমিটেড, ফেব ডিজেল সেলস অ্যান্ড সার্ভিস, ম্যাক্সিমাম সাপোর্ট লিমিটেডসহ পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা হয়। 

সরেজমিন সিআরবি ঘুরে জানা যায়, সিআরবি এলাকায় ফজলে করিমের সন্ত্রাসী বাহিনী সব সময় উপস্থিত থাকত। একই সঙ্গে ১৫ বছরে রেলের আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তারা তার ইশরা-নির্দেশনায় লুটপাটের অংশীদার হতেন। কর্মকর্তারা জানতেন তার নির্দেশনা মানেই শেখ হাসিনার নির্দেশনা।

নিরীহ কর্মকর্তারা জানান, ১৫ বছরে যেসব কর্মকর্তা বিশেষ বিশেষ পদে চাকরি করেছেন, তাদের সম্পদের হিসাব দ্রুত নেওয়া উচিত। এসব কর্মকর্তা আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের হয়ে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে রেলওয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো।

রেলওয়ের এক এডিজি যুগান্তরকে বলেন, ‘সংসদীয় কমিটিতে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন ফজলে করিম। ওই সময় কমিটির বাকি সদস্যরাও আমাকে গালাগাল করেন। ওই মিটিংয়ে আমাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়। আমার দোষ ছিল, ডেমু ট্রেন চালু করতে মালামাল ক্রয়ের নির্দেশনা পালন না করা। আমি বলেছিলাম, ডেমু ট্রেনের এখন প্রায় মৃত্যু হয়েছে। এখন ডেমুর মালামাল ক্রয় করে চালুর উদ্যোগ নেওয়া মানেই টাকাগুলো জলে যাওয়া।’

চট্টগ্রাম সিআরবিতে কর্মরত প্রকৌশলী দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ফজলে করিম ও বাবরের সন্ত্রাসীবাহিনী এখনো সিআরবি, রেলওয়ে ভবন, মন্ত্রণালয় ও মাঠ পর্যায়ে বিচরণ করছে। বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলেমিশে-ঠিকাদারির কাজ করছে। বিভিন্ন কর্মকর্তাকে হুমকি-ধমকি দিয়ে তারা কাজ আদায় করে নিচ্ছে। প্রকল্পে ছাত্রলীগ-যুবলীগের চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে রেলে থাকা ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তারা।

রেলওয়ে শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এমআর মঞ্জুর যুগান্তরকে বলেন, সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসীরা পুরো রেলকে জিম্মি করে উন্নয়নের নামে লুটতরাজ করেছে। 

মন্ত্রণালয় গঠনের পর থেকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি ফজলে করিম চৌধুরী, তার ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরী নামে-বেনামে রেলে ব্যবসা করেছেন। গড়ে তুলেছিলেন সন্ত্রাসী চক্র। বাবরসহ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ফজলে করিমের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে পুরো রেলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। চট্টগ্রাম শহরে থাকা টর্চার সেলে রেলওয়ে কর্মকর্তা-ঠিকাদারদের নিয়ে মারধর করতেন। টেন্ডার থেকে শুরু করে প্রকল্পের মেয়াদ-ব্যয় বাড়ানোর সব কাজ ওই টর্চার সেলে করিয়ে নিতেন। তিনি আরও বলেন, ফজলে করিম ও বাবরের সন্ত্রাসীরা ফ্যাসিস্ট রূপ পালটে এখন সিআরবিসহ পুরো রেলে বিচরণ করছে। আমরা সতর্কাবস্থায় আছি। রেলওয়ে উপদেষ্টাসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়গুলো জানাচ্ছি।

এমআর মঞ্জুর বলেন, রেলে এখনো আওয়ামী ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তারা রয়েছেন। তাদের তালিকা করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। আমাদের মধ্যে ঐক্য থাকলে ফ্যাসিস্টদের ঠাঁই হবে না। আমাদের নাম ভাঙিয়ে রেলের কোথাও অনিয়ম-দুর্নীতি করার চেষ্টা করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ফজলে করিম চৌধুরী কারাগারে থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে তার ছেলে ফারাজ করিমের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।