
লন্ডনে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার পর খালেদা জিয়াকে বহনকারী ‘বিশেষ বিমান’ ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে ফুল দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানানো হয়। বিমানবন্দর থেকে গুলশানের বাসভবন ফিরোজায় ফিরে দলের নেতাকর্মী আর লাখো মানুষের ভালোবাসা ও ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হন খালেদা জিয়া।
বিমানবন্দর থেকে শুরু করে পুরো সড়ক নিরাপত্তার চাদরের ঢাকা ছিল। সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খ বাহিনীর সতর্ক অবস্থানের মধ্য দিয়ে নেতাকর্মী ও লাখো জনতার ভিড় ঠেলে দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে বাসায় প্রবেশ করেন খালেদা জিয়া। গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে বাসভবনের দ্বিতীয় তলায় ওঠেন তিনি। সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর এমন রাজসিক ফেরা ইতিহাসের স্মরণীয় প্রত্যাবর্তন হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে ফেরেন দুই পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান ও শার্মিলা রহমান। বাসায় পৌঁছে নেতাকর্মী ও দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। তার দেশে ফেরায় গণতন্ত্র উত্তরণের পথকে সহজ করবে বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
বিএনপি চেয়ারপারসন দেশে ফেরার পর তার সাবেক প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল নিজের ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেছেন, ‘তৃতীয় বিশ্বের কোনো রাজনৈতিক নেতানেত্রীর পক্ষে এর চেয়ে উঁচুতে ওঠা সম্ভব নয়। তিনি জাতীয় ঐক্য, মর্যাদা ও নিরাপত্তার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। দলের বা সরকারের নেতৃত্বের ঊর্ধে উঠে গেছেন তিনি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। একটি রাজনৈতিক দলের তৃতীয় অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটল। আমার ভেতরে আজ আনন্দ ও বেদনার মিলিত অনুভূতি।’
বিমানবন্দরের পথে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারী খালেদা জিয়ার আগমনে তাকে স্বাগত জানাতে রাস্তার পাশে বিএনপি নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বারবার ওই নারীকে সরিয়ে দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি খালেদা জিয়াকে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দেওয়ার সুযোগ পান। ওই নারীর নাম জুলেখা বেগম। তার বাড়ি বঞ্ছারামপুর।
এ ছাড়া বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটে সকাল থেকেই অপেক্ষা করেন চট্টগ্রাম থেকে আসা বিএনপি কর্মী আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, সুস্থ হয়ে নেত্রী দেশে ফিরছেন এটা আমরা জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখ। দীর্ঘদিন জেল খেটে মুক্তি পাওয়ার পরও এত শান্তি লাগেনি।
খালেদা জিয়ার আগমন উপলক্ষে সকাল থেকে ফিরোজাসংলগ্ন এলাকায় ভিড় করেন দলীয় নেতাকর্মীরা। তাদের হাতে ছিল জাতীয় ও দলীয় পতাকা। এ ছাড়া তারা নানা ব্যানার-ফেস্টুন বহন করেন। তারা স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে তোলেন পুরো এলাকা।
ফিরোজা ও এর আশপাশের এলাকায় আগেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ফিরোজার প্রবেশপথ গুলশান-২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কের সামনে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। সড়কটির দুই পাশে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়।
কাতারের আমিরের দেওয়া এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রিয় মাতৃভূমির মাটি স্পর্শ করেন তখন পথে পথে মানুষের অপেক্ষা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র নেতারা খালেদা জিয়াকে বিমানবন্দরে উষ্ণ অভিবাদন জানান। পরে তার দীর্ঘ গাড়িবহর মানুষের শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়ে এগিয়ে চলে গুলশান অভিমুখে। বিমানবন্দর থেকে কুড়িল বিশ্বরোড হয়ে বনানী গুলশানে পথজুড়ে অবস্থান করা নেতাকর্মী আর সাধারণ মানুষ ভালোবাসা জানায় জাতীয়তাবাদী আদর্শের এই নেত্রীকে।
ফিরোজা আবারো ফিরেছে পুরোনো রূপে, যে ফিরোজায় নিকট অতীতে গৃহবন্দি আর পরিবারহীন একাকী সময় কেটেছিল বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর, সেখানে তিনি এবার ফিরলেন দুই পুত্রবধূকে নিয়ে; সঙ্গে অগণিত মানুষের ভালোবাসা।
খালেদা জিয়া গুলশানের বাসায় ফেরার পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের নেতাকর্মীদের নিজের বাড়ি ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান এবং বাসার সামনে ভিড় না করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘তিনি (খালেদা জিয়া) এখন কিছুটা অসুস্থ। চিকিৎসকরা তাকে কমপক্ষে আট ঘণ্টা সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাই কেউ এখানে স্লোগান দেবেন না, ভিড় করবেন না। দয়া করে আপনারা সবাই এখন যার যার বাড়িতে ফিরে যান।’
সবাইকে ‘ফিরোজা’র সামনে থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘দলের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করছি, যেন এখানে কোনো গণ্ডগোল না হয়। পরে সময় হলে আপনাদের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।’
এর আগে বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ফ্যাসিস্টদের হাতে নির্যাতিত হয়ে, কারাবন্দি থাকার পর, দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হওয়ার পর যুক্তরাজ্যে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। সেখানে প্রায় চার মাস চিকিৎসা শেষে তিনি আজ দেশে ফিরে আসেন।
তিনি বলেন, এটা আমাদের জন্য, গোটা জাতির জন্য অত্যন্ত আনন্দের দিন। আজ গণতন্ত্রে উত্তরণের যে সময়টুকু, এই সময় তার উপস্থিতি আমাদের দেশের জন্য, জনগণের জন্য একটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য দিক। আমরা মনে করি, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এ উপস্থিতি, তার দেশে ফিরে আসা, এটা আমাদের গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে আরো সহজ করবে। দেশকে একটা সঠিক, বৈষম্যহীন পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করবে।
এ ছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, লন্ডনে চিকিৎসা নেওয়ার পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। চিকিৎসার পর তিনি অনেকটুকু সুস্থ আছেন এবং মানসিকভাবেও তিনি স্ট্যাবল (শক্ত) আছেন। আপনারা তার জন্য দোয়া করবেন।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে ডা. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ আছেন। যদিও দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা ভ্রমণের কারণে তিনি কিছুটা অবসন্ন। আমরা তার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।’
বিএনপি চেয়ারপারসন সবাইকে শুভেচ্ছা, সালাম ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বলে জানান ডা. জাহিদ হোসেন। খালেদা জিয়ার জন্য কাতারের পক্ষ থেকে বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স দেওয়ায় দেশটির সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, কাতার সরকার সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এটি দিয়েছে। এ সহায়তার মধ্য দিয়ে জিয়া পরিবারের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক, তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।