
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের গত ১৬ বছরের কঠোর দমন-পীড়ন, নির্যাতন-নিপীড়ন, গুম-খুন, হামলা, মামলা ও গণগ্রেফতারে বিপর্যস্ত ছিল বিএনপি। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে বন্দি করে রেখেছিল কারাগারে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারে ছিল নিষেধাজ্ঞা। এমনকি বিএনপি নেতাদের বক্তব্য ও আন্দোলন-কর্মসূচির সংবাদ প্রচারেও ছিল বিধিনিষেধ।
ফলে বিএনপি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে ডিজিটাল জগতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে ওঠে বিকল্প মঞ্চ। কিন্তু এই ভার্চুয়াল রাজনীতি আর কতদিন, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে নানান প্রশ্ন।
ভাঙা মাঠের রাজনীতির বিকল্প
২০০৭ সালের এক-এগারোর পর বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে। সাংগঠনিক দুর্বলতা, নেতৃত্বের অনিশ্চয়তা ও প্রশাসনিক দমন-পীড়নের কারণে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকাটা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল দলটির। বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বিএনপির রাজপথ কার্যত শূন্য হয়ে পড়ে। এই শূন্যতা পূরণ করতে দলের নেতাকর্মীরা প্রথমে ব্যক্তিগত উদ্যোগে, পরে কিছুটা সংগঠিতভাবে বেছে নেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন, ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটিক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার (বর্তমানে এক্স), হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামসহ আরও কয়েকটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুক ও ইউটিউবে লাইভ, টুইটার ক্যাম্পেইন, টেলিগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ব্যবহার এখন বিএনপির দৈনন্দিন যোগাযোগের অপরিহার্য অঙ্গ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মাঠের অনুপস্থিতি ঘোঁচানোর জন্য বিএনপি কার্যত ভার্চুয়াল মাঠ তৈরি করেছে, যেখানে প্রতিদিন কথার মিছিল হয়।
বিপ্লবের হাতিয়ার নাকি বিশৃঙ্খলার হাতছানি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিএনপিকে কিছু তাৎক্ষণিক সুবিধা দিলেও এর ব্যবস্থাপনার অভাব আজ দলের জন্য বড় ঝুঁকিতে পরিণত হয়েছে। প্রথমত, সংগঠিত বার্তা দেওয়ার পরিবর্তে ব্যক্তিপর্যায়ের মতামত নির্ভর প্রচারণা দলে বিভ্রান্তি বাড়াচ্ছে। দ্বিতীয়ত, গুজব ও যাচাই-বিহীন তথ্য ছড়ানোয় দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে। তৃতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রে নেতা-নেত্রীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সরাসরি ফেসবুক পোস্ট বা ইউটিউব ভিডিওর মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে, যা দলীয় শৃঙ্খলাবোধের অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যেখানে দলের নিজস্ব বার্তা সংগঠিত করে জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা, সেখানে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী নিজেরাই আলাদা মঞ্চ তৈরি করে ফেলছেন। ফলে জনগণের কাছে দলের অবস্থান অস্পষ্ট বা বিতর্কিত হয়ে উঠছে।
সাফল্যের গল্প ও সীমাবদ্ধতা
নেতিবাচক দিক থাকা সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপি কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেও সফলতা দেখিয়েছে। যেমন: মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে বা দেশে নির্যাতনের অভিযোগ প্রচারে ডিজিটাল প্রচার কার্যকর হয়েছে। বিশেষ করে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে বিএনপির সমর্থন ধরে রাখার ক্ষেত্রে ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে জনপ্রিয়তা আদৌ মাঠের ভোটবাক্সে রূপান্তরিত হচ্ছে কি না? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, ভার্চুয়াল জনপ্রিয়তা আর নির্বাচনী শক্তি এক নয়। মাঠে জনসমর্থন ছাড়া শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে রাজনৈতিক দল টিকিয়ে রাখা কঠিন।
আসন্ন ভবিষ্যৎ: রক্ষাকবচ নাকি আত্মহননের রণক্ষেত্র
বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সংগঠিত বার্তা পৌঁছানোর মাধ্যম হিসেবে সাজিয়ে নিতে পারে, তাহলে এটি মাঠের রাজনীতির ঘাটতি অনেকাংশে পুষিয়ে দিতে পারবে। তবে যদি চলমান বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, তাহলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আত্মঘাতী হাতিয়ারে পরিণত হবে।
বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারছি, প্রযুক্তি দিয়েই প্রযুক্তির বিভ্রান্তি ঠেকাতে হবে। দলীয়ভাবে প্রশিক্ষিত মিডিয়া সেল ছাড়া এ যুদ্ধে জয় সম্ভব নয়।’
অতএব, বিএনপির জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো একক, সুসমন্বিত বার্তা নির্ধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নীতিমালা প্রণয়ন, তরুণ কর্মীদের তথ্য যাচাই ও কৌশলী প্রচারণায় প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং বিভ্রান্তিমূলক ও বিশৃঙ্খল প্রচার বন্ধ করতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ। রাজনীতির মাঠ যতই সংকুচিত হোক, জনগণের আস্থা এবং সাংগঠনিক সংহতি ছাড়া কোনো ডিজিটাল যুদ্ধই দীর্ঘমেয়াদে বিজয় এনে দিতে পারে না। বিএনপির সামনে এখন সেই কঠিন বাস্তবতা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপির প্রভাব বাড়ছে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপির প্রভাব আগের তুলনায় অনেক বেশি দৃশ্যমান। মাঠের রাজনীতিতে প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে দলটি অভূতপূর্ব সক্রিয়তা ও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বিশেষ করে ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার), ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউব, টেলিগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে বিএনপি নেতাদের উপস্থিতি এবং অনুসারীদের তৎপরতা নজর কাড়ছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির ফেসবুক পেজে বর্তমানে অনুসারীর সংখ্যা ৩৪ লাখের বেশি। এক্স অ্যাকাউন্টে অনুসারী আছে প্রায় ৮১ হাজার ৬০০। ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে অনুসারী প্রায় ৭৬ হাজার ৮০০। টিকটকে অনুসারীর সংখ্যা চার লাখ ৮৮ হাজারের বেশি। লাইকের সংখ্যা ৭৭ লাখের বেশি।
বিএনপির ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ২৭ লাখের বেশি। টেলিগ্রাম চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার আছে প্রায় ৫২ হাজার ৬০০। হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে অনুসারীর সংখ্যা প্রায় চার হাজার।
এসব পেজ ও অ্যাকাউন্টে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, বড় ছেলে তারেক রহমান, বিএনপির কেন্দ্রীয় বিভিন্ন নেতার বক্তব্য, বৈঠক ও কর্মসূচির খবর নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থক ও সাংবাদিকরা নিয়মিত এসব পেজ, অ্যাকাউন্ট ও চ্যানেল থেকে নিয়মিত তাৎক্ষণিক খবরাখবর পাচ্ছেন।
ফেসবুকে বেগম খালেদা জিয়া
ফেসবুকে বেগম খালেদা জিয়া নামে একটি ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ রয়েছে। বর্তমানে এই পেজে অনুসারীর সংখ্যা ২৭ লাখের বেশি। এই পেজে খালেদা জিয়ার বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও রয়েছে। তার চেয়ে বেশি বক্তব্যের ভিডিও রয়েছে তারেক রহমানের।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ছাত্রদের কর্মসূচির প্রতি সাড়া দিয়ে গত বছরের ৩০ জুলাই ফেসবুক প্রফাইল লাল করেছিলেন কারা নির্যাতিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
এর কিছুদিন পরই ৫ আগস্ট পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এভারকেয়ার হাসপাতালে ছুটে যান দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এসময় সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের পক্ষ থেকে হাস্যোজ্জ্বল খালেদা জিয়াকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান তিনি। সেই ছবি ৭ আগস্ট খালেদা জিয়ার ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়।
সেদিন ফেসবুক পেজে লাইভ করে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেন খালেদা জিয়া। বলেন, ‘আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাদের বীর সন্তানদের যারা মরণপণ সংগ্রাম করে এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। শতশত শহীদদের জানাই শ্রদ্ধা।’
তার সেই পোস্ট ৪ মে ২০২৫ পর্যন্ত দেখেছেন ৪০ লাখের বেশি মানুষ। মন্তব্য করা হয়েছে ১৯ হাজার ৩০০-এর বেশি।
এক্স, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকে খালেদা জিয়ার ফেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট ও চ্যানেল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ভার্চুয়াল জনপ্রিয়তায় শীর্ষে তারেক রহমান
ফেসবুকে বেশ জনপ্রিয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বর্তমানে তার পেজে অনুসারীর সংখ্যা ৩৫ লাখের বেশি। এক্স প্ল্যাটফর্মেও আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন তিনি। প্রতিদিন গড়ে এক হাজারের বেশি নতুন অনুসারী যুক্ত হচ্ছেন তার অ্যাকাউন্টে। বর্তমানে তার অনুসারীর সংখ্যা ৭৬ হাজারের বেশি। তারেক রহমান সক্রিয় রয়েছেন ইনস্টাগ্রামেও। অনুসারীর সংখ্যা নয় হাজার ৮০০-এর বেশি। ইউটিউব ও টিকটকে তারেক রহমানের ভেরিফায়েড চ্যানেল পাওয়া যায়নি।
লন্ডন থেকে তারেক রহমানের বক্তব্য, দলীয় নির্দেশনা এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষণমূলক ভিডিও নিয়মিত এসব মাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হচ্ছে। হাজার হাজার অনুসারী তাতে মন্তব্য করছেন, প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন এবং নিজেদের টাইমলাইনে শেয়ার করছেন। এসব বক্তব্য ভাইরাল হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে।
ফেসবুকে সক্রিয় বিএনপি মহাসচিবও
ফেসবুকে সক্রিয় আছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। তার ফেসবুক পেজে অনুসারী আছেন পাঁচ লাখ ৯৮ হাজারের বেশি। ইউটিউব, টিকটক, এক্স ও ইনস্টাগ্রামে তার ফেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট ও চ্যানেল খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নামে ফেসবুক, এক্স ও ইনস্টাগ্রামে একাধিক পেজ ও অ্যাকাউন্ট থাকলেও কোনোটিই ফেরিফায়েড নয়।
বিএনপি মিডিয়া সেলের শক্তিশালী ভূমিকা
বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের বার্তা প্রচারে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সক্রিয় বিএনপি মিডিয়া সেল। ফেসবুকে বিএনপি মিডিয়া সেল পেজের অনুসারীর সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। ইনস্টাগ্রামে অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার ৮০০। টিকটকে অনুসারীর সংখ্যা প্রায় ৮৭ হাজার ৮০০। এক্সে অনুসারী আছে ৮০ হাজার ১০০-এর বেশি।
বিএনপি মিডিয়া সেলের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার ৩৮ হাজারের বেশি। টেলিগ্রাম চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার প্রায় আট হাজার। এসব চ্যানেলে নিয়মিত লাইভ করে এবং বিশ্লেষণমূলক ভিডিও দিচ্ছেন বিএনপির মিডিয়া সেলের কর্মকর্তারা, যার অনেকগুলোর ভিউ কয়েক লাখ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।
দলীয় কর্মসূচি, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, পোস্টার, বক্তৃতার ক্লিপিং এবং ব্রেকিং আপডেট দিয়ে এসব পেজ, চ্যানেল ও অ্যাকাউন্ট বিরোধী রাজনীতির প্রধান অনলাইন মুখ হয়ে উঠেছে।
ফেসবুকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ইশরাক হোসেন
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সরব ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। তার ফেসবুক পেজে অনুসারীর সংখ্যা এখন ২৯ লাখের বেশি। এক্স অ্যাকাউন্টে অনুসারী আছে প্রায় ৫৭ হাজার ৩০০। ইনস্টাগ্রামে অনুসারী আছেন এক লাখ ৫৮ হাজারের বেশি। ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ৮৩ হাজার ৫০০-এর বেশি।
সরাসরি সম্প্রচারিত বক্তব্য, গ্রাউন্ড রিপোর্ট এবং আন্দোলনমুখী বিভিন্ন বার্তা ও ফটোকার্ড পোস্ট করে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে যুক্ত রাখছেন তিনি। বিশেষ করে শিক্ষিত শহুরে তরুণদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে দিন দিন।
শামা ওবায়েদ ও নারীদের প্রতিনিধিত্ব
বিএনপির অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় মুখ। তার রাজনৈতিক অবস্থান, নারীর অধিকার নিয়ে সরব অবস্থান এবং স্পষ্ট বক্তৃতা তাকে অনলাইন ব্যবহারকারীদের কাছে একটি পরিচিত মুখে পরিণত করেছে। ফেসবুকে তার অনুসারীর সংখ্যা দুই লাখ ৬০ হাজারের বেশি।
‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জনগণের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মূলধারার গণমাধ্যমের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল সেটা তারা রাখতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে বিএনপি তাদের কর্মকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্লাটফর্মে তুলে ধরেছে এবং সেখান থেকে জনগণ জানতে পেরেছে।’- সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব মহিউদ্দিন খান মোহন
অঞ্চলভিত্তিক নেতাদের জনপ্রিয়তা
চট্টগ্রামের গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, কুমিল্লার সাজ্জাদ মাহমুদ, চাঁদপুরের শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক কিংবা ময়মনসিংহের আবদুল কাইয়ুম বাবলুর মতো স্থানীয় নেতারাও এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছেন। তাদের অনেকের ফলোয়ার ১০ থেকে ৩০ হাজারের মধ্যে, কিন্তু পোস্ট রিচ লাখ ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
‘মিডিয়া যুদ্ধ’
বিএনপির তরুণ কর্মীরা মিম, গ্রাফিক্স, অ্যানিমেটেড ভিডিও ও সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার অংশ ভাইরাল করে দিচ্ছেন ফেসবুক গ্রুপ ও পেজের মাধ্যমে। ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের অজস্র অনলাইন ইউনিট এখন তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন মুহূর্তে।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন, মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি নেতা নাসের রহমান কিংবা বিএনপির মিডিয়া সেলের কয়েকজন রয়েছেন যারা দলের সাংগঠনিক পদেও রয়েছেন, তারা মাঠের কর্মসূচিতে যতটা সক্রিয় থাকেন তার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সরব থাকেন।
‘বিএনপি অপপ্রচারের অস্ত্র হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে না। তারা তাদের দলীয় নীতি আদর্শ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের চেষ্টা করছে, ৩১ দফার প্রচারণা চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে অপপ্রচার চালিয়েছে, বিএনপির মধ্যে সেই অনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই।’- রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারুফ মল্লিক
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মাঠের রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা কাটাতে বিএনপি ডিজিটাল যোগাযোগকে অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। এটাই এখন দলটির নতুন যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে তারেক রহমান ও ইশরাক হোসেনের মতো নেতারা হাত রেখেছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব মহিউদ্দিন খান মোহন বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপির তৎপরতা রয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড জনগণের সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্রে মূলধারার গণমাধ্যমের যে ভূমিকা রাখার কথা ছিল সেটা তারা রাখতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে বিএনপি তাদের কর্মকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্লাটফর্মে তুলে ধরেছে এবং সেখান থেকে জনগণ জানতে পেরেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার রয়েছে। বিএনপি যদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে সে ক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক দিক তৈরি হয়।
বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মুস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, জনগণের কাছে যাওয়ার অনেক মাধ্যম রয়েছে। যার মধ্যে প্রধানতম সহজ মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। বিএনপি সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব রয়েছে। সরকার পরিবর্তনেও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব রয়েছে। আবার চরিত্র হননেরও শিকার হতে হচ্ছে। আমার কাছে মনে হয় যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষজ্ঞ আছেন তাদের পরামর্শে সোশ্যাল মিডিয়ার পরিচালনা কৌশল ঠিক করা উচিত।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব শুধু বিএনপিতে নয়, পলাতক আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব রয়েছে। অনেক সময় প্রপাগান্ডা দেখতে পাই, আবার সত্য উঠে আসে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারুফ মল্লিক জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপি অপপ্রচারের অস্ত্র হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে না। তারা তাদের দলীয় নীতি আদর্শ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারের চেষ্টা করছে, ৩১ দফার প্রচারণা চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ সোশ্যাল মিডিয়ায় যেভাবে অপপ্রচার চালিয়েছে, বিএনপির মধ্যে সেই অনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই। অনেকে বলার চেষ্টা করেন বিএনপি সোশ্যাল মিডিয়ায় শক্তিশালী নয়। কিন্তু আমি মনে করি জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি তাদের নিজেদের দলীয় কর্মকাণ্ড বাদ দিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, এটা স্যোশাল মিডিয়ায় শক্তিশালী হওয়ার নমুনা হতে পারে না।
তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ এবং মিডিয়া সেল অত্যন্ত সক্রিয় হয়েছে, যা কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ছাড়াও মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘আমরা রাজনীতির মাঠে জনগণের অধিকার ফিরিয়ে আনতে সোশ্যাল মিডিয়াকেও হাতিয়ার হিসেবে দেখতে পারি। তবে এ মাধ্যম যেন বিভ্রান্তি বা উসকানির উৎস না হয়, সে বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, ‘আমরা মাঠে নামতে পারিনি, মিডিয়া ছিল নিয়ন্ত্রিত। তাই তরুণদের হাত ধরে সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের প্রধান কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ২০২০ সালে এক ভার্চুয়াল বক্তব্যে বলেন, আজকের রাজনীতি তথ্যযুদ্ধের রাজনীতি। সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের সেই লড়াইয়ের অন্যতম মঞ্চ। সত্য প্রচারের জন্য এই মাধ্যম আমাদের অস্ত্র।
তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ এবং মিডিয়া সেল অত্যন্ত সক্রিয় হয়েছে, যা কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ছাড়াও মাঠ পর্যায়ে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।
‘বিগত ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনা সরকার নিজেদের প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটা বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করেছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে মামলা থেকে শুরু করে গ্রেপ্তার, হত্যা, গুম, নিপীড়ন করেছে।’ -বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান
আন্তর্জাতিক পরিসর ও তুলনা
ভারতে কংগ্রেস পার্টি এবং পাকিস্তানে পিটিআই, উভয় দলই সোশ্যাল মিডিয়াকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে সফলভাবে ব্যবহার করেছে। ইমরান খানের পিটিআই দলের ‘ডিজিটাল আর্মি’ ২০১৮ সালের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। অথচ বিএনপির মিডিয়া কৌশল এখনও অপেক্ষাকৃত ছন্নছাড়া।
২০২৩ সালে ‘ডিজিটাল মিডিয়া ইন বাংলাদেশি পলিটিকস’ শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বিএনপি-সংশ্লিষ্ট ফেসবুক পেজগুলোর সম্মিলিত রিচ ছিল প্রায় ৩৫ কোটি, যেখানে আওয়ামী লীগের ছিল প্রায় ৫০ কোটি। তরুণ ভোটারদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ বলেছে, তারা প্রথম রাজনৈতিক তথ্য পায় ফেসবুক বা ইউটিউব থেকে। এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যা বিএনপির ডিজিটাল কার্যক্রমের গুরুত্বকে বাড়িয়ে তোলে।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খানের ভাষায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটা মূলত তৈরি হয়েছিল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যোগাযোগের জন্য। এখন এটি প্রচার মাধ্যম বা বাণিজ্যিক ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এবং এক শ্রেণির প্রপাগান্ডার হাতিয়ার।
জাগো নিউজকে তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদ শেখ হাসিনা সরকার নিজেদের প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটা বিএনপি ও বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করেছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে মামলা থেকে শুরু করে গ্রেপ্তার, হত্যা, গুম, নিপীড়ন করেছে। এখন এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা সক্রিয় আছেন, তারা পূর্ণ স্বাধীনভাবে যে যেভাবে পারছেন নীতির সমালোচনা না করে ব্যক্তির সমালোচনা ও আক্রমণ করছেন। হয়তো সাময়িক কিছুটা সময় নাগরিকদের মধ্যে আলোচনা হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে বিএনপির জন্য নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করতে পারবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান জাগো নিউজকে বলেন, শুধু বিএনপির রাজনীতি নয়, গোটা বিশ্বেই এখন সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব পড়ছে। নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যায়। তবে গণমাধ্যমের মতো সব সময় বস্তুনিষ্ঠ তথ্য পাওয়া যায় না, ফলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।