
Taufique Joarder (তৌফিক জোয়ার্দার)
সম্প্রতি এনসিপির বেশ কিছু দুর্নীতির খবর সামনে এসেছে। তাদের বিভিন্ন গ্রুপের মাঝে মারামারির খবরও প্রকাশিত হয়েছে। চাঁদাবাজি এবং অবৈধ প্রভাব খাটানোর অভিযোগ তো বেশ পুরনো। হঠাৎ এসব খবর বেশি বেশি সামনে আসায় আমার এনসিপিতে-যোগ-দেওয়া বন্ধুদের লেখাগুলোতে একটা বিব্রত হবার টোন শুনতে পাচ্ছি। এসব খবরের প্রতিক্রিয়ায় তাদের পোস্টগুলো কিছুটা ডিফেন্সিভ ও অ্যাপোলোজেটিক হয়ে উঠেছে।
এরা ভালো মানুষ। যে সৎ আকাঙক্ষা থেকে তারা এনসিপিতে যোগ দিয়েছেন তা শ্রদ্ধা দাবি করে। কিন্তু তাদের সমাজ নিয়ে আইডিয়ালিস্ট ধারণা দেখলে করুণাও হয়। তাদের আমতা আমতা বিব্রত বয়ান দেখে মজাও লাগে। এমনটা যে হবে তা পোড় খাওয়া সমাজ ভাষ্যকাররা আগেই জানতো।
এনসিপি নতুন ও ছোট দল। সদস্য সংখ্যা, সম্ভাব্য ভোটার, দেশব্যাপী সাংগঠনিক কাঠামো, এমনকি এর সদস্যদের নিজেদের ও রাজনীতির বয়স—সব বিবেচনাতেই তারা ছোট। এমন ম্যানেজেবলি ছোট একটা দলও দুর্নীতি ও নানা নেতিবাচক সামাজিক অভিঘাতগুলোকে মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। তাহলে চিন্তা করুন, বিএনপির মতো লাখ লাখ নেতাকর্মী আর কোটি কোটি সমর্থকের দলকে এগুলো সামলাতে কতটা বেগ পেতে হয়। অথচ গত কয়েক মাস ধরেই কী নির্মম বিদ্বেষবিষাক্ত ন্যারেটিভের জাল বোনা হয়েছে দলটার বিরুদ্ধে। এতে অবশ্য ভালোই হয়েছে। কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে বিএনপি দল থেকে বহিষ্কার করেছে। এ কাজটা করতে অন্য কোনো সময় হলে প্রচুর অভ্যন্তরীন চাপ সহ্য করতে হতো। থ্যাঙ্কস টু এনসিপি, এ কাজটা করতে বিএনপিকে দলের ভেতর থেকে তুলনামূলকভাবে কম চাপ সহ্য করতে হয়েছে।
তাহলে কি বিষয়টা এমন দাঁড়াচ্ছে যে বিএনপিতে আসলেই খারাপ মানুষের আধিক্য। না, বড়, বুর্জোয়া, ক্ষমতায় যেতে চাওয়া এবং সেভাবে অপ্টিমাইজ্ড হওয়া দলগুলো দেশের সমাজ ও মানুষের সাধারণ ডিস্ট্রিবিউশনেরই প্রতিফলন। সমাজ, তথা দেশের মানুষ যেমন, দলগুলোও মোটাদাগে তেমন। আফটার অল, দলগুলো কোনো সমাজ সংস্কারের ব্রত নিয়ে রাজনীতিতে নামেনি। কোনো দেশেই নামেনা। তারা সমাজের একজিসটিং সামাজিক ও জনমিতিক ডিস্ট্রিবিউশনকে হাতিয়ার করে ক্ষমতায় যেতে চায় মাত্র। এটাই তার কাজ, এজন্যই সে সৃষ্টি হয়েছে।
এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে সংক্ষেপে দু’টো কথা বলে রাখি। এই জায়গায় এসে জামায়াতে ইসলামী, আওয়ামী লীগ এবং কিছু বামপন্থী দলের (এদের সবাইকে আলোচনার সুবিধার্থে নাম দেওয়া যাগ ’ক গ্রুপ’) সাথে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, অন্য কিছু বামপন্থী দলের (’খ গ্রুপ’) একটা পার্থক্য তৈরি হয়। ক গ্রুপের দলগুলো কেবল ক্ষমতাতেই যেতে চায়না, তারা তাদের সদস্যদেরকে তাদের নিজস্ব ভাবধারা বা আদর্শে দীক্ষিত বা ইনডক্ট্রিনেটও করে। তার অর্থ দাঁড়ায়, এরা ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রের মধ্যেও সেসব ভাবধারার ব্যাপন ঘটাতে তারা বদ্ধপরিকর থাকে। এভাবে দলীয় আদর্শের সাথে রাষ্ট্রী আদর্শ একাকার হয়ে যায়। এর পেছনে তাদের আবেগ, মননের একাত্মতা, ও ধনুর্ভঙ্গ পণ কাজ করে। তাই একবার ক্ষমতায় গেলে তারা সেটা হারাতেও ভয় পায়। কারণ তারা তাদের এতদিনের এত পরিশ্রমে গড়ে তোলা সাদ্দাদের বেহেশত ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা করে, যা তাদের কাছে আদর্শিক মৃত্যুর সমান। অন্যদিকে খ গ্রুপের দলগুলোর এমন কোনো আদর্শিক ব্যাগেজ নেই। তারা অনেকটা হ্যাপি-গো-লাকি মোডে ক্ষমতায় যায়, ক্যাজুয়ালি কাজ করে, সাথে কিছু দুর্নীতিও করে। তাদেরও ক্ষমতা ছাড়তে ভয় হয় বৈকি। তবে সেটা আদর্শিক কারণে না। দুর্নীতির বিচারের ভয়ে, প্রতিপক্ষের রিটালিয়েশনের ভয়ে, অথবা ইনকাম হারানোর ভয়ে।
যাই হোক, মূল আলোচনায় আসি। বলছিলাম দলগুলো, বিশেষতঃ খ গ্রুপের দলগুলো, যেমন বিএনপি আসলে দেশের সামগ্রিক সোশিও-ডেমোগ্রাফিক প্রোফাইলেরই প্রতিফলন। সমাজে ৫০ শতাংশ মানুষ ধান্দাবাজ হলে দলেও ৫০ শতাংশ মানুষ ধান্দাবাজ, সমাজে ৩০ শতাংশ মানুষ দুর্নীতিবাজ হলে দলেও তাই, সমাজে ১০ শতাংশ মানুষ অপরাধী হলে দলেও তাই। এই স্ট্যাটাস কুয়োকে বদলানোর বা চ্যালেঞ্জ করার কোনো দায় বা দায়িত্ব এ দলগুলোর নেই। সমাজ বদলালে দলও বদলাবে। এখন দেখা যাক, সমাজ তাহলে কেমন, এবং তা কবে বা কিভাবে বদলাবে?
আমরা বাংলাদেশ বলতে একটা দেশ বুঝি। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ যেন সম্পূর্ণ পরষ্পরবিচ্ছিন্ন, সুদূরে অবস্থিত দু’টা দেশ (অথবা অনেক গুলো দেশ)। এ দুটো দেশের মানুষের রুচি, গণআকাঙ্ক্ষা, সমাজবীক্ষা, আগ্রহ, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, সংস্কৃতি—সবই যেন আলাদা। এদের এন্টারটেইনমেন্ট এবং সেলিব্রেটিরা পর্যন্ত আলাদা। এক গ্রুপের সেলিব্রেটিদেরকে অন্য গ্রুপের মানুষরা চেনেনা পর্যন্ত, এবং চিনলেও সেটা নিয়ে হাসাহাসি করে। শাকিব খানের সিনেমা দেখে বের হওয়া ফ্যানদের কথাবার্তা, পোশাক, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ চিন্তা করুন একবার, কী বোঝাতে চাচ্ছি বুঝে যাবেন। যেটা আমরা আরবান মিডল ক্লাস বুঝতে পারিনা অথবা বুঝতে চাইনা তা হলো, আমরা সংখ্যায় ছোট, যদিও আমাদের গলাটা তিনগুণ লম্বা। আর বড় আমাদের সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট। কিন্তু নির্বাচনে সবারই এক ভোট। বুঝতে পারছেন নির্বাচনে কাদের এবং কেন অ্যালার্জি?
গ্রামে গেলে দেখবেন মানুষের ডিমান্ডগুলো কতটা বিখাউজ। তাদের দাবিদাওয়া গুলোকে মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে আছে টাকা-পয়সা সহ নানা ইমেডিয়েট সহযোগিতার অনুরোধ। এদের মধ্যে সবাই যে জেনুইন তা-ও না। অনেকে অসহায়ত্বের ভান করে চোরের ওপর বাটপারি করতে আসে। স্থানীয় নেতা এসব দাবি দাওয়া পূরণ করবে কিভাবে, যদি না তার আয়ের বৈধ বা অবৈধ উৎস থাকে? বৈধ আয়ে বেশিরভাগ সময়ই এসব দাবিদাওয়া পূরণ করা সম্ভব হয়না। এদিকে, তা না করলে জনপ্রিয়তাও ধরে রাখা যায়না, ভোট টানা যায়না। আর এসব পূরণ করতে গেলে অবৈধ আয়ের দিকে পা বাড়ানোর সম্ভাব্যতা বেড়ে হয়। এ যেন শাখের করাত।
আরেক ধরণের দাবিদাওয়া গুলো আরও কমপ্লেক্স। এগুলো নানা রকম সরকারী ধান্দা ও তদবির সংক্রান্ত। ১৫ বছর বয়সী নাবালক মেয়ের জন্য হঠাৎ উপযুক্ত প্রবাসী পাত্র পাওয়া গিয়েছে, সার্টিফিকেটে বয়স বাড়িয়ে দেখাতে হবে। প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার জন্যও বয়স বাড়ানোর অনুরোধ নিয়ে অনেকে আসে। এর সাথে তাদের রুটি রুজি, গোটা পরিবারের বেঁচে থাকা না থাকা নির্ভর করে। অবৈধ জেনেও মানবিক কারণে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকে হয় নিজে (ক্ষমতায় থাকলে) অথবা অন্যকে দিয়ে (ক্ষমতায় না থাকলে) এ ধরণের কাজগুলো করাতে হয়। চাকরির উমেদারি বা সুপারিশ আরেকটা বড় ক্ষেত্র রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর। সরকারী নানা সুবিধা পাওয়ার অনুরোধ নিয়ে অনেকে আসে, যাদের সেটা প্রাপ্য নয়। এদিকে তা না করলে নেতার নামে সত্য-মিথ্যা বদনামের অন্ত থাকবেনা। আর দেখেছি নানা অপরাধ করে থানা থেকে ছাড়ানোর তদবির। যে যত বড় অপরাধীকে ছাড়াতে পারে, সে তত বড় নেতা। তার তত বেশি গ্রহণযোগ্যতা। আরও অসংখ্য উদাহরণ দিতে পারব এমন, যার একটার চেয়ে আরেকটা বেশি পিকিউলিয়ার।
আমরা রাজনৈতিক নেতাদেরকে বড় অপরাধী হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছি। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমার বরং রাজনৈতিক নেতাদেরকে একরকম সমাজের কাছে ব্ল্যাকমেইলড বা প্রিজনার বলেই মনে হয়েছে। মানুষের অর্থনৈতিক দাবির চাপ মেটাতে এদেরকে একদিকে নিজেদের আয়ের রাস্তাটা তৈরি করতে হয় অস্বচ্ছ উপায়ে। অন্যদিকে নানা অন্যায্য দাবিদাওয়া মেটাতে গিয়ে নিজেরাও জড়িয়ে পড়ে নানা ফৌজদারি অথবা দেওয়ানি মামলায়। এদিকে এসব করতে না পারলে ভোটও পাওয়া যায়না। এ যেন এক দুষ্টচক্র। এই বাস্তবতায় বিএনপির মতো খ গ্রুপের দলগুলো পথ কেটে এগুনোর চেষ্টা করে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, সমাজ কি তাহলে কোনোদিন বদলাবে না? কিভাবে বদলাবে? এ পরিবর্তনের জন্যই কি ২৪-এর অভ্যুত্থান ছিলনা? সরি টু সে, ’না,’ এই ম্যাসিভ স্কেলের সামাজিক পরিবর্তন বা সোশাল রেভোলিউশনের ম্যান্ডেট নিয়ে, প্রস্তুতি নিয়ে অথবা পরিকল্পনা নিয়ে সেই আপরাইজিং হয় নাই; আপনার শুনতে ভালো লাগুক আর না লাগুক। এটাই অপ্রিয় সত্য ও বাস্তবতা। সমাজ কাঠামো ও আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তন ধীর এবং আনসেক্সি একটা প্রক্রিয়া। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে খ গ্রুপের দলগুলো, সেখানে ইতিবাচক প্রভাবকের ভূমিকা নেয়না আগেই বলেছি। কিন্তু যা বলিনি তা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো সামাজিক পরিবর্তনকে বাধাগ্রস্তও করেনা। সে কেবল নিজেকে সামাজিক পরিবর্তনের সাথে অ্যাডাপ্ট করে। যে যত অ্যাজাইল রাজনৈতিক দল, সে তত কার্যকরভাবে সেই পরিবর্তনকে ধারণ করে। যে দল সেটা পারেনা, সে দল হারিয়ে যায়।
এভাবেই শত শত বছর ধরে নানা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, জনমিতিক অভিঘাতের পথ ধরে রাষ্ট্র এগিয়ে যায়। দলগুলো তার সাথে তাল মেলায় মাত্র। সে সমাজ সংস্কারক নয়, বড়জোর সমাজসেবক হতে পারে দলের কিছু সদস্য; তাও সবাই নয়। সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন চাইলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতাকে বজায় রাখতে হবে মাত্র। এর বেশি ইন্জিনিয়ারিংয়ের সুযোগ নেই। জোর করে করতে গেলে দেশটা আমানুল্লাহ খানের আফগানিস্তান হওয়ার চান্স আছে, যার পরিণতি থেকে ১০০ বছরেও দেশটা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এমন উদাহরণ আরও অনেক দিতে পারব, তাতে লেখাটা আরও দীর্ঘই হবে কেবল।
বিএনপির বিরুদ্ধে অনেকে এখন বিষোদ্গার করছেন বুঝেশুনে, একটা রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি হিসেবে। নির্বাচনের ন্যায্য দাবিকে ‘সংস্কারে’র মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দাবিকে স্টিগমাটাইজ করছেন সংকীর্ণ স্বার্থে। তাদের উদ্দেশ্যে বলি, দলের বিরোধিতা একটা স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক চর্চা; সেটা অবশ্যই করুন। কিন্তু excess of anything is bad. এটা যদি একটা টক্সিক মাত্রায় দিনের পর দিন চলতে থাকে, তা রাজনৈতিক অ্যাটমোস্ফিয়ার এবং সংস্কৃতিকে বিষাক্ত করে তোলে। সেটা আরেকটা ফ্যাসিবাদের ব্রিডিং গ্রাউন্ড হয়ে উঠতে পারে।
আরা যারা ওপরে বর্ণিত বৃহত্তর বাংলাদেশের সমাজ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট না বুঝেই এটা করছেন, তাদেরকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ভোটের রাজনীতিতে কেবল রাজনীতি সচেতন আরবান মিডল ক্লাসের ইগো বাঁচিয়ে চললেই ক্ষমতায় যাওয়া যায়না। আর ক্ষমতায় যেতে চাওয়া তো আর অন্যায় কিছু না, যদি সেটা গণতান্ত্রিক উপায়ে হয়। অথচ সেটার জন্য ১০০ ভাগ সাধু হওয়াও সম্ভব নয়। ১০০ ভাগ খাঁটি সোনা দিয়ে তো আর গয়না হয়না। এ বাস্তবতা মাথায় রেখেই রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা করুন। দেখবেন যে ঘৃণার বিষ হৃদয়ে পুষে রেখেছেন, তা ফিকে হয়ে আসছে। গণতান্ত্রিক সমাজের স্বার্থে এতটা ঘৃণা স্বাস্থ্যকর নয়।