
জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে বাংলাদেশের ও মিয়ানমারের রাখাইনের মধ্যে একটি মানবিক করিডোর স্থাপনে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষ আসতে পারে, এমন শঙ্কা থেকে সেখানে মানবিক সহায়তা দিতে বাংলাদেশের কাছে করিডোর চেয়েছিল সংস্থাটি। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে করিডোরের ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। কারণ, এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সে ব্যাপারে বিস্তারিত আপাতত বলছি না। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে সহযোগিতা করব।’
এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ‘মানবিক করিডর’ স্থাপনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল। এসব দলের নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। এটিকে তারা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা ঝুঁকি হিসেবেও মনে করছেন। এছাড়া মানবিক করিডোর ভবিষ্যতে সামরিক করিডোরে পরিণত হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাজনৈতিক নেতারা।
গত সোমবার গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায়ও এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। সেখানে স্থায়ী কমিটির সদস্যগণ ‘মানবিক করিডোর’ স্থাপনের যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে সরকারের কাছে জানতে চাওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। একইসাথে এ বিষয়ে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে দলের প্রতিক্রিয়া জানাবে বলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এছাড়া বিএনপি সরকারের কাছে এ বিষয়ে একটি চিঠি পাঠাবে এবং প্রয়োজন হলে অন্যান্য সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকও করবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটি মনে করে যে, মিয়ানমারের সংঘাতময় রাজ্য রাখাইনে সাহায্য পাঠানোর জন্য ‘মানবিক করিডোর’ প্রতিষ্ঠার মতো বিষয়ে একটি অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত নয়। তারা বলেন, এই ধরণের পদক্ষেপ বাংলাদেশের নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক অখÐতার সাথে সম্পর্কিত। একারণে তাদের পরামর্শ হচ্ছে যে, এই ধরণের সংবেদনশীল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে রাজনৈতিক দল এবং জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।
বৈঠক সূত্রে আরো জানা যায়, সরকারকে এই সিদ্ধান্ত থেকে ফেরাতে কিংবা পুনর্বিবেচনা করতে যদি প্রয়োজন হয় বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ প্রয়োগ করবে। বিএনপি সরকারকে সতর্ক করেছে যে, সরকারের এই ধরণের পদক্ষেপের ফলে বাংলাদেশ ফিলিস্তিনের মতো যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জনগণকে অন্ধকারে রেখে এধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অযৌক্তিক। যদি এধরণের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই সবার সঙ্গে আলোচনা করে মতৈক্যের ভিত্তিতে গ্রহণ করা উচিত ছিল।
এদিকে গত সোমবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁওয়ে একটি অনুষ্ঠানে মানবিক করিডোরের বিষয়ে বলেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ সাহেব বলেছেন, আমরা আরাকানবাসীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি মানবিক প্যাসেজ দিতে চাই। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এটি বোঝা কঠিন। অস্থায়ী সরকারকে এমন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। কারণ এটি দেশের নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব, শান্তি এবং এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা এতে জড়িত।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে বলেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোর দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে নিরাপত্তাহীন করবেন না। আপনি চাইলে দেশের জন্য অনেক ভালো কিছু করতে পারেন। কিন্তু আপনার ভুলের কারণে দেশের জনগণ বিপদে পড়তে পারে। আপনি তো মুখ মুছে বিদেশে চলে যাবেন। যাদেরকে বিদেশ থেকে নিয়ে এসে উপদেষ্টা বানিয়েছেন, তারাও বিদেশে চলে যাবে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের বাংলাদেশে থাকতে হবে। আমাদের দেশে থাকতে হবে। এই সাধারণ জনগণের দেশে থাকাটা অনিরাপদ করবেন না। আমাদেরকে নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে দেবেন না।
তিনি বলেন, এই মানবিক করিডোর কী? মানবিক করিডোরটা হচ্ছে, যখন পাশের রাজ্যে, পাশের দেশে গৃহযুদ্ধ, রক্তারক্তি হয়, তখন সে দেশের সাধারণ জনগণকে নির্গমনের জন্য রাস্তা করে দেওয়া হয়। এই ধরনের ঘটনা জাতিসংঘের তত্ত¡াবধানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখেছি। কিন্তু একটি করিডোরও রক্তারক্তি ছাড়া মুক্তি পায়নি। সব মানবিক করিডোর অমানবিক অবস্থায় পতিত হয়েছে। সুতরাং, বাংলাদেশের যে মানবিক করিডোর দেওয়াও হচ্ছে, এটা বাংলাদেশের জনগণ ও সার্বভৌমত্বের জন্য সুখকর নয়।
বাংলাদেশ হেফাজত ইসলামের যুগ্ম সম্পাদক এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক জাতিসংঘের অনুরোধে মিয়ানমারে মানবিক সাহায্য পৌঁছনোর জন্য ‘করিডোর’ দেয়ার যে সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েছে তার প্রতিবাদ জানান।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, রাখাইন রাজ্য নিয়ে আমাদের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের মানবিক সাহায্য করে আসছে। বর্তমানেও বাংলাদেশে ১৪-১৫ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। মায়ানমারে গৃহযুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট মানবিক পরিস্থিতির প্রতি আমরা সংবেদনশীল। তা সত্তে¡ও দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অস্থিরতা, সশস্ত্র যুদ্ধ ও জাতিগত হানাহানিতে বিপর্যস্ত এই রাজ্যের জন্য মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠার বিষয়টি কেবলই মানবিক না। বরং এর সঙ্গে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত হয়ে পড়েছে। তাই বিস্তর বোঝাপড়া এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না।
তিনি বলেন, বিপর্যস্ত মানুষের জন্য মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা জরুরি। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, এই ধরনের করিডোর কেবল মানবিক রাখা যায় না। এর সঙ্গে সামরিক ও নিরাপত্তা প্রশ্ন জড়িয়ে যায়। ফলে মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে বা অন্য বিকল্পগুলোকেই বিবেচনা করা উচিৎ। কারণ এই ধরনের ক্ষেত্রে মিয়ানমার বা আরাকান আর্মি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য কোনও অংশীদার না। তাই এই বিষয়ে তাড়াহুড়ো না করে বুঝেশুনে সবার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নুর উল্লেখ করেন যে, মানবিক করিডরকে অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে সরকারের অস্পষ্ট বক্তব্য বিভ্রান্তির জাল তৈরি করেছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি এবং নির্বাহী সমন্বয়ক আবুল হাসান রুবেল একটি বিবৃতিতে বলেছেন, মানবিক করিডর অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আলোচনা এবং জাতীয় মতৈক্য তৈরি অপরিহার্য, যেহেতু এটি জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার সাথে জড়িত।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বার্থে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে রাখাইনে মানবিক করিডোর দেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন। আন্তঃদেশীয় মানবিক করিডরের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কোন আলোচনা ও সম্মতি ছাড়া অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ জাতিকে নিয়ে পাশা খেলার শামিল।
তিনি আরও বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার যেমন সাম্রাজ্যবাদী ভারতের স্বার্থে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়েছিল। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারও কি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে রাখাইনে মানবিক করিডোর দিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের ক্রীড়নক হিসেবে বাংলাদেশকে গাজা বা ইউক্রেন বানাতে চাইছে?
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, রাখাইনে ‘কথিত’ মানবিক করিডোর দেয়া নিয়ে সরকারের মধ্যকার পরস্পর বিরোধী অবস্থান উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, আরাকানে করিডোর দেয়ার চিন্তা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি করবে। মানবিক করিডোর ভবিষ্যতে সামরিক করিডরে পরিনত হতে পারে। তাই রাজনৈতিক দলসমূহের সাথে বোঝাপড়া ছাড়া করিডোর প্রদানের উদ্যোগ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।
সাইফুল হক বলেন, মিয়ানমারের এই অঞ্চল কেন্দ্র করে দীর্ঘ দিন ধরে পরাশক্তিসমূহের বহুমাত্রিক তৎপরতা রয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে ভ‚ -রাজনৈতিক স্বার্থের বিরোধ। মায়ানমারের অভ্যন্তরে, বিশেষ করে আরাকান অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রæপের বিরোধাত্বক সশস্ত্র তৎপরতাতো রয়েছেই। এরকম একটি পরিস্থিতিতে রাখাইন অঞ্চলে যুদ্ধমান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর সাথে বোঝাপড়া ব্যতিরেকে করিডোর প্রদানের চিন্তা হবে আত্মঘাতী।