
পতিত আওয়ামী লীগের আমলে দেশ-বিদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত হলেও ভবিষ্যতে মানবাধিকার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে চলতে চায় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এজন্য পুলিশের এই এলিট ফোর্স শৃঙ্খলাবহির্ভূত কাজে জড়িত সদস্যদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ তদন্ত সেল যুগোপযোগী করেছে। পাশাপাশি সংস্থাটির সব ধরনের কাজের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে মানবাধিকার সেলও গঠন করা হয়েছে।
পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে র্যাবের পক্ষ থেকে এক প্রেজেন্টেশনে এসব কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। রাজধানীর রাজারবাগে পুলিশ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ওই সেমিনারে র্যাব মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান নিজের সংস্থার ওপর উপস্থাপন তুলে ধরেন।
পুলিশ সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন গতকাল বুধবার পুলিশ অডিটোরিয়ামে আয়োজিত সেমিনারে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে র্যাব ছাড়াও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি, ট্যুরিস্ট পুলিশ, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট, হাইওয়ে পুলিশ, এপিবিএন, রেলওয়ে পুলিশ, নৌ পুলিশ ও শিল্প পুলিশের পক্ষ থেকে আলাদা প্রেজেন্টেশন তুলে ধরা হয়। পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলমসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা এসব প্রেজেন্টেশনের ওপর আলোচনা করেন।
সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি (ভারপ্রাপ্ত) গাজী জসীম তার উপস্থাপনায় বলেন, জুলাই-২০২৪-এর রাজনৈতিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী অনুসন্ধানের জন্য সিআইডির পক্ষ থেকে বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রীদের এবং প্রভাবশালীদের সন্দেহজনক সম্পদের উৎস ও প্রকৃতি নিয়ে নিবিড় অনুসন্ধান চালাচ্ছে তার সংস্থা।
পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের প্রেজেন্টেশনে উঠে আসে, মামলার তদন্তের জন্য যে নির্ধারিত বাজেট দেওয়া হয়, তা অপ্রতুল। এজন্য অনেক সময় তদন্ত কর্মকর্তাকে নিজের পকেট থেকেই খরচ করতে হয়। অজ্ঞাতপরিচয়ে উদ্ধার করা লাশের ব্যবস্থাপনার পেছনে ন্যূনতম বরাদ্দ না থাকায় তদন্ত কর্মকর্তারা বিপাকে পড়ছেন। লাশ উদ্ধার থেকে শুরু করে ময়নাতদন্ত পর্যন্ত লাশ ব্যবস্থাপনার সব ক্ষেত্রেই তদন্ত কর্মকর্তার পকেটের টাকা যাচ্ছে। পুলিশের ইউনিটগুলোর উপস্থাপনায় সাইবার স্পেস ব্যবহার করে সংঘটিত অপরাধ এবং এর নিয়ন্ত্রণে চ্যালেঞ্জগুলো উঠে আসে। গত মঙ্গলবার পুলিশ অডিটোরিয়ামে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবারের পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধন করেন এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ দেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, গতকাল সিআইডির উপস্থাপনা দিয়ে দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি গাজী জসীম তার উপস্থাপনায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত নানা ইউনিটের সাফল্যগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে এখন অপরাধ তদন্ত আরও কার্যকরভাবে পরিচালনা করছে সিআইডি। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বিশেষ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী ও প্রভাবশালীদের সন্দেহজনক সম্পদের উৎস খুঁজতে গঠিত এই কমিটি এরই মধ্যে হাজার কোটি টাকার সম্পদ শনাক্ত করেছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রায় ৫ হাজার ৮০০ শতাংশ জমি। এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল, ইউনিক, সিকদার গ্রুপসহ বড় বড় করপোরেট গ্রুপের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে বলেও তিনি উপস্থাপনায় তুলে ধরেন। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু মামলা দায়ের করার তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, কক্সবাজারের একটি মামলায় ১০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। ফরেনসিক শাখার অগ্রগতি নিয়েও তথ্য উঠে আসে সিআইডির প্রধানের উপস্থাপনায়। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ডিএনএ, ডিজিটাল ও কেমিক্যাল ফরেনসিকের মাধ্যমে বহু ক্লুলেস মামলার রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব হয়েছে বলে জানান তিনি।
এসব সাফল্যের মধ্যেও নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতার তথ্য উঠে আসে তার উপস্থাপনায়। যানবাহনের অভাব, তদন্তের খরচ, নিজস্ব স্থাপনার অভাব, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের ঘাটতির পাশাপাশি দক্ষ কর্মী পদায়নে সীমাবদ্ধতা এবং অনিয়মিত বদলি আতঙ্কে কর্মীদের মধ্যে হতাশা ভর করার বিষয়টি তুলে ধরেন তিনি। তার বক্তব্যে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবগুলোর প্রযুক্তি উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বাজেটের অভাব ও মাঠপর্যায়ে ল্যাব না থাকায় অনেক সময় তদন্ত বিলম্বিত হওয়ার বিষয়টিও উঠে আসে।
পরে র্যাব মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান র্যাবের পক্ষ উপস্থাপনা তুলে ধরেন। তার বক্তব্যে উঠে আসে, র্যাব এখন নিয়মিত কাজের পাশাপাশি বাহিনীর সদস্যদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ওপর জোর দিচ্ছে। এজন্য মানবাধিকার সেল ও অভ্যন্তরীণ তদন্ত সেল গঠন করা হয়েছে। পাশাপাশি র্যাব এখন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন বিধিমালায় পরিচালিত হলেও র্যাব আইন ২০২৪ (খসড়া) প্রণয়নের উদ্যোগের কথাও জানান তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত র্যাব ৪৪২টি হত্যা মামলায় ১ হাজার ৪৮৭ জন এবং নাশকতা মামলায় ১৫৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানান তিনি।
র্যাব মহাপরিচালক বলেন, র্যাব ভবিষ্যতে জনগণের আস্থা অর্জন করে দায়িত্ব পালন করতে চায়। এজন্য জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ, যোগাযোগ সহজীকরণ, আভিযানিক সক্ষমতা বাড়ানো এবং প্রশিক্ষণ পরিকল্পনার কথা বলেন তিনি। প্রশিক্ষণ পরিকল্পনায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি ইউএন, ইন্টারপোল, এফবিআইসহ আন্তর্জাতিক সংস্থা ও উন্নত দেশের নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে যৌথ প্রশিক্ষণ আয়োজনের কথা বলেন তিনি।
এ ছাড়া হাইওয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে দেওয়া উপস্থাপনায় মহাসড়কের নিরাপত্তা নিয়ে নানা কার্যক্রম উঠে আসে। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা চ্যালেঞ্জ, অপ্রতুল জনবল ও যানবাহন নিয়েও আলোচনা হয়। পুলিশ ইউনিটগুলোর উপস্থাপনায় অবকাঠামো ও যানবাহন সংকট, স্বাধীন সাইবার ইউনিট গঠন, নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ এবং অতিরিক্ত দায়িত্বের জন্য আলাদা নীতিমালা প্রণয়নের দাবির বিষয়টিও উঠে আসে।