
মেহেরপুর শহরের ঘোষপাড়ার বাড়িটিতে যেন রাত নামত না। বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় সারি সারি গাড়ির ভিড় লেগেই থাকত। দলের, সমাজের নানা অপকর্ম, বদলি-পদায়নের তদবির ও দেনদরবারের জন্য লোকজন আসত। আগত লোকজনের ভিড়ে বোঝাই যেত না বাইরে রাতের অন্ধকার না দিনের আলো ফুটছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, দেনদরবার করে তবেই ফিরতেন অপেক্ষারতরা। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলত ভেতরের গোপন দেনদরবার।
ওই বাড়িতে হাজিরা না দিলে মন্ত্রীর আস্থাভাজন হওয়া যেত না। জেলা, পুলিশ প্রশাসনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসের কর্মচারীরাও হাজিরা দিতেন।
গত ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর পালিয়ে যাওয়ার পর মেহেরপুরের ওই বাড়িতেও নেমে আসে দুনিয়ার তাবৎ নীরবতা।
অপকর্মে জনক্ষোভ তৈরি হয়েছে ফরহাদ, শীলা ও তাঁদের চক্রের সদস্যদের ওপর। অবৈধ বাণিজ্যে ফরহাদ ও তাঁর স্ত্রী শীলার অঢেল সম্পদ ও অর্থ বেড়েছে। এর বেশির ভাগ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। জানা গেছে, তদবিরসহ বিভিন্ন অবৈধ বাণিজ্যে পাওয়া ঘুষের টাকা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফরহাদ বা তাঁর স্ত্রী শীলা গুনে গুনে গ্রহণ করতেন। অনলাইন জুয়া (ক্যাসিনো) নিয়ন্ত্রণ, স্কুল-কলেজে নিয়োগ বাণিজ্য, সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ—এসব কাজে তদবির বাণিজ্য করতেন শীলা। শীলা এই অবৈধ আয় দিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার ছেলের মাধ্যমে কানাডায় বাড়ি কিনেছেন বলে জানা গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় একাধিক মামলায় ফরহাদ, তাঁর স্ত্রী শীলা, ছোট ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুল, ভগ্নিপতি আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস কারাগারে আছেন। বোন শামীম আরা হীরা গ্রেপ্তার হলেও কিছুদিন পর তিনি জামিন পেয়ে কারাগারের বাইরে আছেন। ফরহাদের বড় ভাই সহিদ সাদিক হোসেন বাবুল, মেজো ভাই শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকবাল হোসেন বুলবুল বাড়িতে অবস্থান করলেও বাড়ির বাইরে বের হন না।
ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন ভগ্নিপতি : মেহেরপুরের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন ফরহাদের ভগ্নিপতি আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস ও ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুল। মূলত অন্যদের প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ নিয়ে বাবলু তা নিয়ন্ত্রণ করতেন। ২০২৩ সালের ২০ অক্টোবর সরফরাজ হোসেনের বিরুদ্ধে এক কোটি ৮০ লাখ টাকার চেক প্রত্যাখ্যানের (ডিজঅনার) মামলা করেন দেবাশীষ বাগচি নামের এক ব্যক্তি। মামলায় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মেহেরপুর অর্থঋণ আদালতের বিচারক ফরহাদের ছোট ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুলের এক বছর জেল, তিন কোটি ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করে রায় দেন। আদেশে বলা হয়, তিন কোটি ৬০ লাখ টাকা জরিমানার এক কোটি ৮০ লাখ টাকা বাদীকে এবং এক কোটি ৮০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে। বাদী দেবাশীষ বাগচি মৃদুলের ব্যবসায়ী অংশীদার ছিলেন।
দেবাশীষ বলেন, ২০১৫ সাল থেকে তিনি সরফরাজের সঙ্গে যৌথভাবে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ২০২০ সাল পর্যন্ত গণপূর্ত, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রকৌশল, এলজিইডিসহ বিভিন্ন সংস্থার ৩৫টি দরপত্র সরফরাজ প্রভাব খাটিয়ে বাগিয়ে নেন। এর আনুমানিক মূল্য ছিল প্রায় ২৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে সরফরাজ দেবাশীষকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেন। পাওনা টাকা বাবদ গত বছরের ১২ জুলাই এক কোটি ৮০ লাখ টাকার চেক দেন। কিন্তু টাকা উত্তোলন করতে গেলে দেবাশীষ দেখেন, ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা নেই। পরে আদালতে মামলা করেন তিনি।
দাপুটে ভাই-ভগ্নিপতি-ভাগ্নি : আব্দুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস ফরহাদের ভগ্নিপতি। তিনি পিরোজপুর ইউপির চেয়ারম্যান। মন্ত্রীর ভগ্নিপতি হওয়ায় বাবলুর বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস করত না। ১০ বছর পিরোজপুর ইউনিয়নের দাদ বিল তিনি দখলে রেখেছিলেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বিভিন্ন ভাতা ও সরকারি সুবিধা দিতে তিনি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতেন। গত ৫ আগস্টের পর স্থানীয়রা বাবলুর বাড়িতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন। পরে ঢাকার ভাটারা থেকে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন।
মেহেরপুর সরকারি বালিকা ও বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে দুটি ছয়তলাবিশিষ্ট একাডেমি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। প্রতিটি ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় কোটি টাকা। বালিকা বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের ঠিকাদার বাবলু, বালক বিদ্যালয়ের কাজের ঠিকাদার সরফরাজ। পাশাপাশি অবস্থিত বিদ্যালয় দুটির শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা অভিযোগ করছিলেন, ঠিকাদারদের লোকজন বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ দখল করে ভবনের নির্মাণসামগ্রী রেখেছিলেন। এগুলো সরিয়ে মাঠ পরিষ্কার রাখার কথা বলার সাহস তাঁরা করেননি। তবে ৫ আগস্টের পর মাঠ পরিষ্কার করা হয়েছে।
গত ২৯ আগস্ট মেহেরপুর শহরের ক্যাশবপাড়ায় ফরহাদ হোসেনের ফুফাতো ভাই শাজাহান সিরাজের ভাড়া বাড়ি থেকে কোটি টাকা মূল্যের বিপুল সরকারি মালামাল জব্দ করে যৌথ বাহিনী। এর মধ্যে ছিল বিনামূল্যে বিতরণের কোরআন শরিফ, কম্বল, বিভিন্ন ধরনের ক্রীড়াসামগ্রী, সেলাই মেশিন, হুইলচেয়ার, চিকিৎসকের অ্যাপ্রোন, পিইপি, শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রিপিস, অক্সিজেন সিলিন্ডার। ছিল শিক্ষার্থীদের টিফিন বক্সও।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মালেক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফরহাদ ক্ষমতার প্রভাবে তাঁর বড় ভাই শহিদ সাদিক হোসেন বাবুলসহ কয়েকজন আত্মীয়কে দিয়ে ৬৯ জনের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছিলেন। ৬৯ জনের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ক তালিকাভুক্ত করেছিলেন। আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবাদ করে সেই তালিকা বাতিল করিয়েছি। এ জন্য নানাভাবে আমাদের হয়রানি ও হুমকি দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘কারো কাছ থেকে দুই লাখ, কারো কাছ থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়েছেন তিনি।’
ফরহাদের ভাগ্নে সাবেক ছাত্রনেতা ও ব্যবসায়ী নেতা আমিনুল ইসলাম খোকনও ছিলেন আরেক ত্রাস। তাঁর বড়বাজারের কার্যালয়ে বসত সালিস। কোনো কাজ করাতে তাঁর সুপারিশ লাগত। হাসপাতাল, সমাজসেবা, ব্যবসা ক্ষেত্রে সুপারিশ তদবির চলত তাঁর হুকুমে।
ফরহাদ, তাঁর স্ত্রী শীলা, ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুল, ভগ্নিপতি আব্দুস সামাদ বাবুল বিশ্বাস কারাগারে আছেন। ভাগ্নে খোকন আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তাঁদের ঘনিষ্ঠ অনেকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।