Image description
ডাকসু নির্বাচনের আগে নতুন কমিটির দাবি

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটির মেয়াদ এক বছর। সে অনুযায়ী, গত ১ মার্চ সংগঠনটির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখা কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। এর আগে গত বছরের ১ মার্চ শাখা ছাত্রদলের ৭ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এতে সভাপতি হিসেবে গণেশ চন্দ্র রায় এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাহিদুজ্জামান শিপন দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ৭ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটির সবাই নিয়মিত শিক্ষার্থী নন। তাদের বেশির ভাগ স্নাতকে ভর্তি হয়েছিলেন এক যুগের বেশি সময় আগে। সেই হিসাবে তাদের নিয়মিত স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার কথা অন্তত অর্ধ যুগ আগে। বয়সও সবার ত্রিশোর্ধ্ব। ছাত্রদলের গঠনতন্ত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

অন্যদিকে, কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণের সাড়ে তিন মাস আগে গত ১৪ নভেম্বর ঘোষণা করা শাখা ছাত্রদলের ২৪২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। অভিযোগ রয়েছে, ঢাউস আকারের এই কমিটির অর্ধেকই বিগত দিনের আন্দোলন সংগ্রামে তেমন ভূমিকা ছিল না। তাছাড়া রয়েছে একাধিক বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারী। এরই জেরে পূর্ণাঙ্গ এই কমিটি ঘোষণার কয়েকদিনের মধ্যে ৬ নেতাকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়েছিল।

অভিযোগ রয়েছে, ঢাবি ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ এই কমিটিতে ‘ভাইনীতি’র প্রভাব রয়েছে। নেতৃত্বের গুণাবলিকে প্রাধান্য না দিয়ে চার নেতার (কেন্দ্রীয় ও ঢাবি শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক) অনুসারীদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এর ফলে ত্যাগীদের পরিবর্তে সুবিধাবাদিরা কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। পরবর্তীতে এরই প্রভাবে সংগঠনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে। আসন্ন ডাকসু নির্বাচনের আগে মেয়াদ উত্তীর্ণ বর্তমান কমিটি ভেঙে আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা ছিল এবং নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন নেতাদের দিয়ে নতুন কমিটি করতে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

শীর্ষ নেতাদের কারও নেই ছাত্রত্ব
ঢাবি শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এছাড়া কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি মাসুম বিল্লাহ ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে, সহ-সভাপতি হিসেবে আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষে, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন শাওন ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শামীম আক্তার শুভ ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে এবং সাংগঠনিক সম্পাদক নূর আলম ভুঁইয়া ইমন ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

অর্থাৎ কমপক্ষে এক যুগ আগে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন৷ সাধারণ হিসাব ধরলেও তাদের বয়স ৩০ পার হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কোর্সের শিক্ষার্থী হিসেবে সর্বোচ্চ আট বছরে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করা যায়। সেই সময়সীমা ধরলেও ৬ থেকে ৮ বছর আগে তাদের নিয়মিত ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার কথা।

সাবেক ৬ নেতার বলয়ে ঢাবি ছাত্রদল
সংগঠনটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছাত্রদলের কমিটি গঠন ও ভেঙে দেওয়া থেকে শুরু করে প্রায় সবই নিয়ন্ত্রণ করছে বিএনপি। এর ফলে কমিটি গঠন থেকে শুরু করে ভেঙে দেওয়া সব ধরনের সিদ্ধান্তে বিএনপি নেতাদের প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে সাবেক ৬ নেতার বলয়ে রয়েছে ঢাবি শাখা ছাত্রদল। এর মধ্যে সবাই সংগঠনটির সাবেক নেতা ও বর্তমানে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন।

বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও বর্তমান ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবের রাজনীতি করেন শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাসুম। বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল ও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছিরের রাজনীতি করেন শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় ও সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন।

ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের ভুঁইয়া জুয়েলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত শাখা ছাত্রদলের সহ-সভাপতি হিসেবে আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক, ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণের অনুসারী হিসেবে পরিচিত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নাছির উদ্দীন শাওন, একসময় সাবেক সভাপতি ফজলুর রহমান খোকনের রাজনীতি করতেন সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায়। তবে সভাপতির পদ পাওয়ার পর তিনি এখন বিএনপি নেতা বকুলের রাজনীতি করেন। ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আকরামুল হাসান ও ইকবাল হোসেন শ্যামলের একটি বলয় রয়েছে ঢাবি ছাত্রদলের বিভিন্ন পদে থাকা নেতাদের মধ্যে।

অভিযোগ রয়েছে, শাখা ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে কেন্দ্রীয় ও শাখা ছাত্রদলের শীর্ষ নেতাদের অনুসারীদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে তেমন পদ-পদবি দেওয়া হয়নি তাদের বাইরের বলয়ের নেতাদের অনুসারীদের। যার ফলে ২৪২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে একবারে নতুন মুখ যেভাবে পদ পেয়েছেন, সেভাবে ত্যাগীদের একটি বড় অংশ বাদ পড়েছেন।

সংগঠনে নেই চেইন অব কমান্ড 
ঢাবি ছাত্রদলের ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বড় অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি সদস্যবিশিষ্ট কমিটি। এর আগে এত বড় কমিটি ঢাবি ছাত্রদলের ছিল না। একাধিক ছাত্রদল নেতার অভিযোগ, ২৪২ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অন্তত অর্ধেক একবারে নতুন মুখ হিসেবে ছাত্রদলে পদ পেয়েছেন। এর ফলে ৫ আগস্টের আগে রাজপথে সক্রিয় থাকাদের তেমন মূল্যায়ন না করাতে কমিটির নিয়মিত কাজ দৃশ্যমান হচ্ছে না। কমিটির কাজ ফাংশন খুবই কম করছে। এর ফলে কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নিজের বলয়ের বাইরে যেতে পারছেন না শীর্ষ এই দুই নেতা। ফলে অন্য বলয়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে।

কোনো সভার আয়োজন করতে পারেননি সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক
সংগঠনের কাজকে গতিশীল করতে নিয়মিত সভার আয়োজন করতে হয়। এতে করে সংগঠনের কাজকে গতিশীল হওয়ার পাশাপাশি সাংগঠনিক কার্যক্রমও বৃদ্ধি পায়। তবে ঢাবি শাখার কোনো কর্মী সভার আয়োজন করতে পারেননি সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। রমজানের আগে শুধু ডাকসুর নির্বাচন নিয়ে বসেছিলেন তারা। তবে সেখানেও কর্মী সভা আয়োজনের জন্য একাধিক নেতা উচ্চবাচ্য করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শাখা ছাত্রদলের এক নেতা বলেন, এখনও কর্মী সভা হয়নি। আমাদেরও ইচ্ছে একটি কর্মী সভা আয়োজন করা হবে এবং এতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ করবো। কিন্তু এই কর্মী সভার আয়োজন করতে পারেনি। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সঙ্গেও কোনো সভার আয়োজন করা হয়নি।

হল কমিটিতে নতুনদের পদায়নের চেষ্টা ব্যর্থ
২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের ১২টি হলের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এরপর একাধিকবার নতুন কমিটি ঘোষণার গুঞ্জন উঠলেও তা আলোর মুখ দেখেনি।

সর্বশেষ ৫ আগস্টের আগে সবচেয়ে সক্রিয় অবদান রাখা চার সেশনের শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে গত অক্টোবরে (২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ সেশন) ঢাবির হল কমিটি করার বেশ গুঞ্জন উঠেছিল। তখন একেবারেই নতুন কর্মীদের দিয়ে হল কমিটি করার বেশ জোরেশোরে চেষ্টা চালিয়েছিল শাখা ছাত্রদল।

তবে ঢাবি শাখায় দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা এবং বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত থাকা এসব চারটির সেশনের নেতাদের তোপের মুখে হল কমিটিতে নতুনদের পদায়নের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর নতুন করে আর হল কমিটি দেওয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি বর্তমান কমিটির।

এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার ফোন এবং হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি কেন্দ্রীয় ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনের কাছে। তবে ঢাবি শাখা ছাত্রদল সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস জানিয়েছেন, তিনি অসুস্থ। তাই এসব প্রশ্নের উত্তর পরে এবং সাক্ষাতে এই প্রতিবেদককে দেবেন।

আর কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির জানিয়েছেন, তিনি এসব বিষয়ে পরে কথা বলবেন। যদিও এই প্রতিবেদক তাদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে প্রশ্ন লিখে হোয়াটসঅ্যাপে দিয়েছেন।