
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন লুটপাটের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে ব্যাংক খাতে। যতই দিন যাচ্ছে নেতিবাচক প্রভাব ততই প্রকট আকারে দৃশ্যমান হচ্ছে। ঋণের নামে লুটপাট ও সেই টাকা পাচার করার কারণে ব্যাংক খাত প্রবল তারল্য সংকটে পড়েছে।
খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়ছে। ব্যাংকের অকার্যকর সম্পদে বেড়ে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে আয়। বেড়ে যাচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ, কমে যাচ্ছে মূলধনের হার। প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে ও রিজার্ভ তহবিলের পরিমাণ কমে ব্যাংক খাতের ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে এমন লুটপাট হয়েছে যা বিশ্বের মধ্যে নজিরবিহীন। এখন লুটপাট বন্ধ হওয়ায় ও সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করায় ব্যাংক খাত কিছুটা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ব্যাংক খাত স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। লুটপাটের টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
এ কারণে ব্যাংক খাতের তারল্যের শূন্যতা আছে। যেসব অর্থ লুট করে নেওয়া হয়েছে সেগুলো এখন এখন খেলাপি হচ্ছে। এ কারণে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এখন তা বেড়ে ২০ শতাংশে পৌঁছেছে। এটি ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে পৌঁছে যেতে পারে। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে ব্যাংক খাতের সব সূচকে নেতিবাচক অবস্থা আরও প্রকট হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত জুলাই সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে (তিন মাসে এক প্রান্তিক) আগের প্রান্তিকগুলোর ব্যাংক সম্পদ বা ঋণ কিংবা বিনিয়োগ থেকে আয় ও মূলধন বিনিয়োগ থেকে আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে সম্পদ থেকে আয় হয়েছিল দশমিক ৫৯ শতাংশ বা ১০০ টাকায় আয় হতো ৫৯ পয়সা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আয় হয়েছিল দশমিক ৬২ শতাংশ বা ১০০ টাকায় ৬২ পয়সা। গত সেপ্টেম্বরে আয় হয়েছে দশমিক ৩৪ শতাংশ বা ১০০ টাকায় ৩৪ পয়সা। খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণে এ খাত থেকে আয় কমেছে। এছাড়া ঋণ বা বিনিয়োগের বিপরীতে অর্থ আদায় করা হচ্ছে না, খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে ও খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে নানা ছাড় দেওয়া হয়েছে। এসব কারণে এ খাত থেকে আয় কমে গেছে। অর্থ ব্যাংক খাতের আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশই আসে এ খাত থেকে।
একই কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন বিনিয়োগ থেকেও আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ খাতে আয় ছিল ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ বা ১০০ টাকায় ১০ টাকা ৭০ পয়সা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এ খাত থেকে ১০০ টাকায় আয় হয়েছে ১০ টাকা ৫৪ পয়সা। গত সেপ্টেম্বরে আয় হয়েছে ১০০ টাকায় ৭ টাকা ৪২ পয়সা বা ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ।
ব্যাংকের প্রধান আয়ের এ দুটি উৎস থেকে আয় কমার কারণে সব সূচকে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
খেলাপি ঋণ বাড়ায় সম্পদ থেকে ব্যাংকগুলোর আয় এতটাই কমেছে যে, গত জুলাই সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১১টি ব্যাংক এ খাত থেকে কোনো আয়ই করতে পারেনি। ৫ শতাংশের কম আয় করেছে ২০টি ব্যাংক।
৫ শতাংশের বেশি থেকে ১০ শতাংশের কম আয় হয়েছে ১০টি ব্যাংক ও ১০ শতাংশের বেশি আয় করেছে ২০টি ব্যাংক। প্রতিবেদনে বলা হয়, খেলাপি ঋণ বাড়ায় অকার্যকর সম্পদের মান বেড়েছে। যেগুলো খেলাপি হয়ে গেছে সেগুলো থেকে কোনো আয় হচ্ছে না। অর্থনীতি বা শিল্প বাণিজ্যের বিকাশেও এগুলো কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। এতে ব্যাংকগুলোর সম্পদের মানে উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটেছে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট সম্পদ দশমিক ৮৭ শতাংশ কমে ২৫ লাখ ২৪ হাজার ১৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণসহ নিয়মিত ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোতে নির্ধারিত হারে প্রভিশন রাখতে হয়। এতে ব্যাংকগুলোর সার্বিকভাবে ঝুঁকির মাত্রা কমে যায়। কিন্তু খেলাপি ঋণ এখন আকাশছোঁয়া গতিতে বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী প্রভিশন রাখতে পারছে না। কারণ একদিকে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ বাড়ছে, অন্যদিকে আয় কমছে। ব্যাংক আয় থেকেই প্রভিশন সংরক্ষণ করে। যে কারণে এখন প্রভিশন চাহিদা অনুযায়ী রাখতে পারছে না। এতে প্রভিশন খাতে ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে। আগের তুলনায় গত জুলাই সেপ্টেম্বরে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৮ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রভিশন সংরক্ষণের হার ছিল ৮৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কমে দাঁড়িয়েছে ৬৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে এ হার আরও কমে ৬৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আলোচ্য প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ আরও বাড়ায় ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ যেমন বেড়েছে। তেমনি বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতি। এতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন রাখার হার আরও কমেছে। এ খাতে কমপক্ষে ১০ শতাংশ মূলধন রাখতে হয়। গত সেপ্টেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। তবে বেশিরভাগ ব্যাংক মূলধন সংরক্ষণে সক্ষম হয়েছে। সরকারি ও লুটপাটের শিকার ব্যাংকগুলোতে এর ঘাটতি বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংক খাতের ঝুঁকির কারণগুলোর মধ্যে ঋণ ঝুঁকি, বাজার ঝুঁকি ও পরিচালনগত ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য।
এই তিন খাতেই ঝুঁকি বেড়েছে। তবে ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা কম হওয়ায় এ খাতে ঝুঁকির মাত্রা সবচেয়ে বেশি। কোনো কারণে ব্যাংকগুলোর শীর্ষ ৩ জন ঋণগ্রহীতার খেলাপি হলে ওই ব্যাংকের ওপর এর বড় ধাক্কা আসবে। এতে মূলধন পর্যাপ্ততার দিক থেকে স্থিতিস্থাপকতার ওপর সর্বাধিক প্রভাব ফেলতে পারে। এতে খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতে কমপক্ষে ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। তখন মূলধনও কমে যাবে।
এদিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণও। বর্তমানে মোট ঋণের ৮২ শতাংশ আদায় অযোগ্য কু-ঋণে পরিণত হয়েছে। যেগুলো থেকে আদায়ের হার খুবই কম। এখন লুটপাটের বা পাচারের যেসব ঋণ খেলাপি হচ্ছে সেগুলোও আদায় করা কঠিন। ফলে এসব ঋণও নির্ধারিত সময় পার হলেও কু-ঋণে পরিণত হবে। এসব ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। এতে ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতির প্রবণতা আরও বেড়ে যাবে। পাশাপাশি বাড়বে মূলধন ঘাটতিও।
প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার করার জন্য ব্যাপক সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। নতুন করে টাকা পাচার ও জালিয়াতি ঠেকানো হয়েছে। এতেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ব্যাংক খাত। গ্রাহকদের আস্থা বাড়ায় এখন আমানতের হার বাড়তে শুরু করেছে।