
দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবাদাতা স্টারলিংককে নিজ নিজ দেশে নিয়ে আসতে চায় বাংলাদেশ ও ভারত। দুই দেশের সরকারের মধ্যে নানা বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও একটা বিষয়ে তাদের লক্ষ্য এক। তা হলো ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সংস্থা স্টারলিংককে তাদের নিজ নিজ দেশে নিয়ে আসা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওয়াশিংটন ডিসিতে গিয়ে ইলন মাস্কের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেছিলেন। তারপর গত সপ্তাহে ভারতের দুই ইন্টারনেট ও টেলিকম জায়ান্ট–এয়ারটেল ও রিলায়েন্স জিও মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পরপর ঘোষণা করেছে যে স্টারলিঙ্কের সঙ্গে তাদের সমঝোতা চূড়ান্ত, যার মাধ্যমে ওই সংস্থাটি ভারতে তাদের পরিষেবা দিতে পারবে।
ভারতে স্টারলিংক কবে আর কীভাবে চালু হবে তা নিয়ে এখনও অনেক অস্পষ্টতা রয়েছে, তবে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা সবাই একমত যে এদেশের কমিউনিকেশন খাতে সেটা একটা যুগান্তকারী ঘটনা হতে চলেছে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোদি যে দিন যুক্তরাষ্ট্রে ইলন মাস্কের সঙ্গে দেখা করেন (১৩ ফেব্রুয়ারি), ঠিক সে দিনই বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও মাস্কের সঙ্গে টেলিফোনে দীর্ঘ সময় কথা বলেন।
বাংলাদেশে স্টারলিংক ‘লঞ্চ’ করার জন্য সেদিন মাস্ককে অনুরোধ জানিয়েছিলেন ড. ইউনূস। কয়েকদিন পরে তিনি চিঠি লিখে বাংলাদেশ সফরে আসার জন্যও ইলন মাস্ককে আমন্ত্রণ জানান।
মাত্র ৯০ দিনের ভেতর বাংলাদেশে স্টারলিংকের যাত্রা শুরু করা সম্ভব বলেও ওই চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
এরপর স্টারলিংকের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেছে, সে দেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে গ্রাউন্ড আর্থ স্টেশন স্থাপন ও আরও নানা অবকাঠামোগত বিষয়ে স্টারলিংকের বোঝাপড়াও সম্পন্ন হয়েছে।
সুতরাং ভারত ও বাংলাদেশ – দুই প্রতিবেশী দেশেই স্টারলিঙ্কের পরিষেবা পাওয়াটা এখন নেহাত আর কিছু সময়ের অপেক্ষা বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে, যদিও অতীত অভিজ্ঞতা বলে এই দুটো দেশেই বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে শেষ মুহূর্তেও নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়ে থাকে।
উল্লেখ করা যেতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটানে ইতোমধ্যে স্টারলিংক সার্ভিস চালু হয়ে গেছে। বস্তুত ২০২৪ সালের ডিসেম্বরেই ভুটানে স্টারলিংকের ইন্টারনেট প্ল্যান চালু হয়ে গিয়েছিল, তবে কোম্পানির পক্ষ থেকে তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
এই অঞ্চলের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ভারত বা বাংলাদেশ – যেখানেই স্টারলিংক আগে চালু হোক, স্যাটেলাইট-নির্ভর ইন্টারনেট পরিষেবার একটা চাহিদা যে এই দেশগুলোও অনুভব করছে সেই ইঙ্গিত কিন্তু স্পষ্ট। এমনকি গৃহযুদ্ধে দীর্ণ মিয়ানমারও চাইছে তাদের দেশে স্টারলিংক আসুক।
এখন প্রশ্ন হলো, স্টারলিংক ভারত বা বাংলাদেশে এলে বাড়তি কী সুবিধা মিলবে? প্রযুক্তিগত সুবিধার বাইরেও কি স্টারলিংককে এনে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক সুবিধা আশা করছে এই দেশগুলো?
স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেট পরিষেবায় অনুমতি দেওয়ার মানে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে আপস করা, এই ধরনের আশঙ্কাকেই বা কীভাবে ‘অ্যাড্রেস’ করা হবে?
সবচেয়ে বড় কথা, এই পরিষেবার খরচ কি আদৌ সাধারণ মানুষের নাগালের ভেতর থাকবে? না কি শুধু ধনী কর্পোরেটরাই স্টারলিংক ‘অ্যাফোর্ড’ করতে পারবে?
স্টারলিংক কী, এর বিশেষত্ব কোথায়?
স্টারলিংক হলো আসলে একটি স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা, যেটি অপারেট করে ইলন মাস্কের মালিকানাধীন এরোস্পেস কোম্পানি স্পেসএক্স। এই মুহূর্তে ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়া-অস্ট্রেলিয়া-আফ্রিকা জুড়ে বিশ্বের শতাধিক দেশে স্টারলিংকের পরিষেবা পাওয়া যায়।
গত বছরের জানুয়ারির হিসাব অনুযায়ী, পৃথিবীকে ঘিরে বিভিন্ন কনস্টেলেশনে এই কোম্পানির প্রায় হাজার সাতেক 'লো-আর্থ অরবিট' (এলইও) স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ আছে – যেগুলোর মাধ্যমে তারা ভূপৃষ্ঠে ইন্টারনেট পরিষেবা দিয়ে থাকে।
ইলন মাস্ক দাবি করেছেন, মহাকাশে স্টারলিংকের এই 'মেগাকনস্টেলেশন' প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে ঢেলে সাজানো হবে এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা স্টারলিংক গ্রাহকরা তার সুবিধা পাবেন।
সাবেকি ব্রডব্যান্ড সার্ভিস যেখানে ভূগর্ভস্থ কেবল বা টাওয়ারের ওপর নির্ভরশীল, স্টারলিঙ্কের স্যাটেলাইটগুলো কিন্তু পৃথিবীর বুকে ছোট ছোট 'ইউজার টার্মিনালে'র সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমেই ইন্টারনেট পরিষেবা দিয়ে থাকে।
যেহেতু এক্ষেত্রে টাওয়ার বসানোর বা মাটির নিচে কেবল পাতার কোনো ঝামেলা নেই, তাই দুর্গম প্রত্যন্ত প্রান্তরে বা গ্রামীণ এলাকাতেও খুব সহজে স্টারলিংকের পরিষেবা পাওয়া সম্ভব। গ্রাহকের কাছে শুধু কোম্পানির ছোট 'ইউজার টার্মিনাল'টি থাকলেই যথেষ্ঠ।
অতি দুর্গম জায়গা থেকেও বেশ সহজে স্ট্রিমিং, ভিডিও কল, অনলাইন গেমিং বা রিমোট ওয়ার্কিং করা যায় বলেই স্টারলিংক দুনিয়াজুড়ে এত জনপ্রিয় হয়েছে।
তবে বিশ্বে স্টারলিংক বৃহত্তম স্যাটেলাইট-নির্ভর ইন্টারনেট প্রোভাইডার হলেও তারা একমাত্র নয়-ওয়ানওয়েব ইউটেলসেট, আমাজনের প্রোজেক্ট কুইপার, ভায়াস্যাট কিংবা হিউজেসনেটের মতো আরও অনেক কোম্পানিই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেট পরিষেবা দেয় বা দিতে চলেছে।
ইউটেলসেটে আবার ভারতীয় কোম্পানি এয়ারটেলেরও বিপুল লগ্নি আছে, যদিও তারা এদিকে ভারতে স্টারলিঙ্কের সঙ্গেও সমঝোতার কথা ঘোষণা করেছে।
গত ১১ মার্চ যখন এয়ারটেল স্টারলিংকের সঙ্গে তাদের অংশীদারিত্বের কথা ঘোষণা করেছিল, পর্যবেক্ষকরা সেটাকে ভারতের ডিজিটাল কানেক্টিভিটির ক্ষেত্রে একটা 'ক্যু'-র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
সুনীল ভারতী মিত্তালের কোম্পানি এয়ারটেল তখন প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছিল, সারা দেশজুড়ে তাদের যে রিটেল স্টোরের (খুচরো দোকান) বিশাল নেটওয়ার্ক আছে, সেখান থেকেই স্টারলিংক তাদের নিজস্ব ডিভাইস বিপণন ও বিতরণ করতে পারবে। এর ফলে ভারতে স্টারলিংকের প্রাথমিক বিনিয়োগও অনেক কম করতে হবে।
এই মুহূর্তে ভারতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের বাজারে সবচেয়ে বড় 'প্লেয়ার' হলো মুকেশ আম্বানির মালিকানাধীন রিলায়েন্স জিও – যাদের সারা দেশে ১ কোটি ৪০ লক্ষেরও বেশি 'কেবল-ওলা' ইন্টারনেট গ্রাহক আছে।
এয়ারটেল-স্টারলিংকের সমঝোতার ফলে জিও যখন বিপাকে পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে, ঠিক তখনই মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ভেতর জিও প্ল্যাটফর্মস লিমিটেডও ঘোষণা করে তারাও স্টারলিংকের সঙ্গে অনেকটা একই ধরনের পার্টনারশিপে যাচ্ছে। ফলে ভারতের প্রধান দুই কমিউনিকেশন জায়ান্ট – ভারতী এয়ারটেল ও রিলায়েন্স জিও – উভয় কোম্পানিই এখন ইলন মাস্কের স্টারলিংকের সঙ্গে বোঝাপড়া করে গ্রাহকদের স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট পরিষেবা দেওয়ার দিন গুনছে।
তবে এই দুটো সমঝোতাই ভারতের রেগুলেটরি অথরিটির অনুমোদন সাপেক্ষে হবে বলে জানানো হয়েছে, অর্থাৎ সরকারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমতি পাওয়ার পরই কেবল স্টারলিংক সে দেশে ব্যবসা করতে পারবে।
জাতীয় নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে?
এয়ারটেল ও জিও-র সঙ্গে সমঝোতার ঘোষণার পর ভারতে স্টারলিংক পরিষেবা পাওয়াটা এখন আর অল্প কিছু সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করা হচ্ছে। তবে ঘটনা হলো, বহু চেষ্টা করেও এতদিন কিন্তু স্টারলিংক ভারতে ব্যবসা করার অনুমোদন পায়নি।
ভারতে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্টারলিংক নিজেদের নথিভুক্ত করেছিল সেই ২০২১ সালের নভেম্বর মাসেই। এর কয়েক দিন পরেই কেন্দ্রীয় সরকার একটি বিবৃতি দিয়ে ঘোষণা করে, এই কোম্পানি কিন্তু এখনও ব্যবসা করার প্রয়োজনীয় লাইসেন্স পায়নি – কাজেই সাধারণ মানুষ এদের সঙ্গে কোনো চুক্তি না করলেই ভালো করবেন।
বস্তুত স্টারলিংককে নিয়ে ভারতে যাবতীয় সন্দেহ বা অবিশ্বাসের মূলে আছে এই প্রশ্নটাই – এই স্যাটেলইটনির্ভর পরিষেবা জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে না তো?
দিল্লিতে তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওই বিশেষজ্ঞর কথায়, ‘ঠিক যে কারণে টিকটক-সহ অনেকগুলো চীনা অ্যাপকে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বলতে পারেন অনেকটা একই কারণে স্টারলিংককে এতদিন এ দেশে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।’
এর মাঝে গত ডিসেম্বরেই ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেটের কর্মকর্তারা জানান, মাদকবিরোধী একটি অভিযানে গিয়ে তারা চোরাকারবারিদের কাছ থেকে স্টারলিংকের ডিভাইস উদ্ধার করেছেন।
কয়েক সপ্তাহ পরেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর থেকে খবর আসে, সেখানে চলমান গৃহযুদ্ধে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী পাচার করে আনা স্টারলিংক ডিভাইস ব্যবহার করছে।
মণিপুরে উদ্ধার করা অস্ত্রশস্ত্রের যে ছবি ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী প্রকাশ করেছিল, তাতে একটি স্টারলিংকের ডিভাইসও দেখা যায়।
এক্স হ্যান্ডলে সেই ছবির জবাব দিয়ে ইলন মাস্ক অতঃপর লেখেন, ‘এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভারতের আকাশে স্টাররিঙ্কের স্যাটেলাইট বিম সুইচ অফ করা আছে।’
তবে যেকোনো কারণেই হোক, স্টারলিংককে ঘিরে ভারতের সরকারি মহলে সন্দেহ ও সংশয় আপাতত অনেকটাই কেটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
‘এর একটা কারণ হতে পারে স্টারলিংক ভারতে তাদের যন্ত্রপাতি কিন্তু নিজেরা বেচবে না, এগুলো বিলি করা হবে এয়ারেটল ও জিও-র মতো দুটো ভারতীয় কোম্পানির মাধ্যমে। ভারতে স্টারলিংকের নিজস্ব কোনো গ্রাহকও থাকবে না, এরা হবেন ওই দুটি কোম্পানির গ্রাহক।”
‘আমি অনুমান করছি স্টারলিংকের ডিভাইসে এখানে একটা কোনো বাড়তি সফটওয়্যার যোগ করা হবে, যাতে ডেটা মনিটরিং করার একটা সুযোগ থাকে। এটা যদিও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া, তবে হতেই পারে সেই কাজও অনেক দূর এগিয়ে গেছে।’ বলেন দিল্লির একজন নামী ইন্টারনেট প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ।
প্রসঙ্গত, ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ কিন্তু সে দেশে স্টারলিংক আনার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে বলছে – এর মাধ্যমে মুক্ত ইন্টারনেটের অধিকারই আরও জোরালো হবে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ভবিষ্যতে সরকারগুলো যাতে কোনো অজুহাতে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে না পারে, তা নিশ্চিত করতেই স্টারলিংককে বাংলাদেশে ডাকা হয়েছে।
তিনি আরও লেখেন, ‘বাংলাদেশে স্টারলিঙ্কের আসার অর্থ হচ্ছে, ভবিষ্যতে এ দেশে কোনো সরকার ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে পারবে না। অন্তত নতুন কোনো ইন্টারনেট বন্ধের চেষ্টার আঘাত বিপিও ফার্ম, কল সেন্টার ও ফ্রিল্যান্সারদের ওপর আসবে না।’
তবে সম্প্রতি ইউক্রেনে আমেরিকার হুমকির মধ্যে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, একটা দেশে স্টারলিংকের থাকা না-থাকা শুধু সে দেশের সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে না – আমেরিকাও সেখানে অবধারিত প্রভাব খাটাতে চাইবে।
সূত্র: বিবিসি।