Image description

রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১২৯ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে সরকারের মাধ্যমে ‘প্রশাসক’ নিয়োগে তৎপরতা চালাচ্ছে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সংগঠনের মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রশাসকদের তালিকাও তৈরি করছে তারা। তবে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল প্রশাসক নিয়োগের বিরোধী। তাদের ভাষ্য, এনসিপিকে সুবিধা দিতেই এ আয়োজন; এটি মানা হবে না।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯ সংশোধন করে অন্তর্বর্তী সরকার একটি কমিটি গঠনের বিধান যুক্ত করেছে। কমিটির সদস্যরা কাউন্সিলরের ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন সহায়তা ও নাগরিক সেবা এনসিপি নেতাদের মাধ্যমে করতে এই তৎপরতার অভিযোগ উঠেছে। এ লক্ষ্যে সাক্ষাৎকার নিয়ে সম্ভাব্য প্রশাসকের তালিকা করার গুঞ্জনও রয়েছে। তবে গুঞ্জন ও অভিযোগ নাকচ করেছে এনসিপি।

 

দলটির সংশ্লিষ্ট নেতাদের বক্তব্য, সিটি নির্বাচনে স্থানীয় কারা সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন, ছায়া সরকারে কারা থাকবেন– সে তালিকা হয়েছে।

বিএনপি সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ঘোর বিরোধী হলেও দলটির স্থানীয় পর্যায়ের কতিপয় নেতা তালিকায় নাম দিয়েছেন। আগে স্থানীয় নির্বাচন চাওয়া জামায়াতে ইসলামীর কয়েক নেতার নামও রয়েছে। এবি পার্টিসহ আরও কয়েকটি দলের নেতারা ‘প্রশাসক’ হওয়ার দৌড়ে আছেন। যদিও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানিয়েছেন, ওয়ার্ড ‘প্রশাসক’ নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়নি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু গতকাল বুধবার সমকালকে বলেছেন, ‘বিএনপির মূল লক্ষ্য জাতীয় নির্বাচন। সিটির ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রশাসক বসানো বিধিসম্মত নয়।’ দলটির একাধিক নেতা বলেছেন, বিভিন্ন দলের নেতাদের এনসিপিতে ভেড়াতেই প্রশাসক করার টোপ দেওয়া হচ্ছে। বিএনপির তৃণমূল নেতাদেরও টানা হচ্ছে। এ প্রলোভনে সাড়া না দিতে দলীয় নির্দেশনা রয়েছে।

শেখ হাসিনার পতন ঘটানো অভ্যুত্থানের নেতাদের উদ্যোগে গঠিত এনসিপি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে বলে অভিযোগ কয়েকটি দলের। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করা দলটি ‘কিংস পার্টি’ কিনা– এ প্রশ্নও তোলা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় কমিটি হলেও জেলা-উপজেলায় সংগঠন নেই এনসিপির। রমজানের পর দেশজুড়ে সংগঠন বিস্তারের কথা বলছে দলটি।

বিএনপিসহ অন্যান্য দলের ভাষ্য, স্থানীয় সরকারের ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে নিয়োগ করা প্রশাসকরা এনসিপির তৃণমূলের সংগঠক হয়ে কাজ করবেন। তাদের মাধ্যমে সরকারি বিভিন্ন ভাতা, সুবিধা, সহায়তা বণ্টন হলে তাতে শুধু এনসিপির ভিত্তিই তৈরি হবে না; আগামী নির্বাচনে তারা সুবিধাও পাবে।

জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের সমকালকে বলেন, ‘প্রশাসক নিয়োগের দরকার কী? স্থানীয় নির্বাচন হলে তো জনপ্রতিনিধিত্ব শূন্যতা থাকে না।’

গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে এনসিপির ভিত্তি তৈরির জন্যই প্রশাসক নিয়োগের চেষ্টা চলছে। এ জন্য লেনদেনের কথাও শোনা যাচ্ছে। এনসিপি নেতারা সাক্ষাৎকার নিয়ে তালিকা করছেন– এমন খবরও আসছে। তালিকা ধরে প্রশাসক নিয়োগ দিলে সরকারই বিতর্কিত হবে। প্রশাসক নিয়োগ এত জরুরি মনে করলে সরকার নীতিমালা করে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারত।’

গত ২৭ সেপ্টেম্বর দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের সব কাউন্সিরলকে অপসারণ করে সরকার। একই দিন ৩২৩ পৌরসভার কাউন্সিলরকেও অপসারণ করা হয়। এর আগেই অপসারণ করা হয় আওয়ামী লীগ নির্বাচিত সিটি ও পৌরসভার মেয়রদের। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদেরও আগস্টে অপসারণ করে সরকার। মেয়র ও চেয়ারম্যান পদে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হলেও কাউন্সিলর, ভাইস চেয়ারম্যান এবং সদস্যপদগুলো শূন্য রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া স্থানীয় সরকারের বাকি সব প্রতিষ্ঠান চলছে জনপ্রতিনিধি ছাড়াই।

শুধু চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে আদালতের রায়ে মেয়রের দায়িত্ব পালন করছেন বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ পেয়েছেন মোহাম্মদ এজাজ। তিনি জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন।

জনপ্রতিনিধি না থাকায় সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে– কারণ দেখিয়ে স্থানীয় সরকারের সব স্তরে প্রশাসক নিয়োগে গত ২৪ ডিসেম্বর উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদকে চিঠি দেয় ফ্যাসিবাদবিরোধী তৃণমূল মঞ্চ নামে সংগঠন। এর আহ্বায়ক আলী নাছের খান এনসিপির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক এবং সদস্য সচিব আলাউদ্দীন মোহাম্মদ এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব।

আলাউদ্দীন মোহাম্মদ গতকাল সমকালকে বলেন, লেনদেনের অভিযোগ শুধু মিথ্যাই নয়, হাস্যকরও। কেউ কি অভিযোগ করেছে প্রশাসক হতে টাকা দিয়েছে? এনসিপি কি প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে? এ ক্ষমতা এনসিপির নেই। তিনি বলেন, এনসিপি ওয়ার্ডভিত্তিক ছায়া সরকারের তালিকা করছে। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলেরই এমন তালিকা থাকে বা থাকা উচিত। সরকারকে কারা জবাবদিহিতে রাখবেন, কারা জনগণের কাছে যাবেন– এ জন্যই তালিকা। এখান থেকেই আগামী নির্বাচনে দল-সমর্থিত প্রার্থী দেওয়া হতে পারে।

এনসিপি সংসদের আগে স্থানীয় নির্বাচন চায়। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তত তিন উপদেষ্টাও আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে বলেছেন। ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও আগে স্থানীয় নির্বাচনের সুপারিশ করেছে। বিএনপি এর বিরোধিতা করছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা বহুবার প্রকাশ্যেই বলেছেন, আগে সংসদ নির্বাচন, পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে পারে।

গতকাল বুধবারও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেছেন, এখনও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয় সরকারের বিবেচনাধীন। নির্বাচনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগে ‘প্রশাসক’ নিয়োগের প্রশ্ন অবান্তর। জনগণ প্রাত্যহিক নানা সেবার জন্য স্থানীয় সরকারের ওপর নির্ভরশীল। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদে জনপ্রতিনিধি না থাকায় এসব সেবা ব্যাহত হচ্ছে। দুর্ভোগ নিরসনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে বারবার বলছি। এ বিষয়ে সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃত জনপ্রতিনিধি দিয়ে স্থানীয় সরকার পরিচালনাই সর্বোত্তম। 

এ ব্যাপারে বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেছেন, সংসদের আগে অন্য নির্বাচন তারা মানবেন না।