Image description

ভাড়ায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে চলছিল গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার বাসিন্দা হানিফের সংসার। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসারে টানাপোড়েন থাকলেও সুখে-শান্তিতেই দিন কাটছিল তার। তবে বিপত্তি ঘটে স্ত্রী নুরজাহানের সঙ্গে ময়লা পানি ফেলা নিয়ে প্রতিবেশীর। প্রতিবেশী শ্রীপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আক্তার মাস্টারের বোন ফারজানা। ৫ আগস্ট ফারজানা লোকজন নিয়ে কয়েক দফায় মারধর করেন হানিফ ও তার স্ত্রীকে। তাতেও ক্ষোভ মেটেনি। অটোরিকশা চালক হানিফকে আওয়ামী লীগ নেতা সাজিয়ে ঠুকে দেন হত্যা মামলা। এজাহারে তার বিরুদ্ধে বিজিবির কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে একজনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। তবে এই হানিফ কিংবা নুরজাহান একাই নন, শ্রীপুরের গ্রামে গ্রামে এমন অনেক ভুক্তভোগী রয়েছেন। বাদ যাননি বিএনপির নেতাকর্মীরাও। এখানেই শেষ নয়, থানায় এজাহারের আগে খসড়া এজাহার লিখে সেগুলো বিভিন্ন জনকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে অর্থ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে আক্তার মাস্টার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে। দাবি করা টাকা পেলে এজাহার থেকে নাম বাদ দিয়ে নতুন করে লেখা হতো এজাহার। এ ছাড়া ঝুট ব্যবসা থেকে শুরু করে সব জায়গায় একক আধিপত্য তৈরি করেছেন এই আক্তার মাস্টার। টাকার বিনিময়ে শেল্টার দেন পতিত সরকারের নেতাকর্মীদেরও। আক্তার মাস্টারের এক ভাই ঢাকার একটি থানার ওসি হওয়ায় ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে কোনো মামলা, অভিযোগ কিংবা জিডিও নেয় না স্থানীয় থানা পুলিশ। সরেজমিন শ্রীপুর ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আক্তারুল আলম মাস্টার বা আক্তার মাস্টার গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কন্সস্টেবল নুরুল ইসলামের ছেলে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এক যুগ আগেও অভাব আর অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আক্তার বড়। ছোট ভাই রাজধানীর একটি থানার ওসি। আক্তার মাস্টারের রাজনৈতিক জীবন শুরু জাতীয় পার্টির মাধ্যমে। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১-৯২ সালে শ্রীপুর কলেজ শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। কলেজ শাখার ভিপি ফরিদ আহমেদ চুন্নুর সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে ফের দল বদল করেন। যোগ দেন বিএনপিতে। এ সময় তিনি স্থানীয় সাইটালিয়া দাখিল মাদ্রাসায় শিক্ষকের চাকরি নেন। বাগিয়ে নেন তেলিহাটি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতির পদ। পরে দায়িত্ব পান উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের। এর পরই শনৈ শনৈ উন্নতি তার। আওয়ামী শাসনামলে বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর স্টিমরোলার চলতে থাকলেও ব্যতিক্রম ছিলেন আক্তার মাস্টার। বিগত সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল, আওয়ামী লীগ নেতা ফরিদ সরকার, খসরু মাদবরের সঙ্গে মিলে শিল্পকারখানার ঝুট ব্যবসা করতেন। ওবায়দুল কাদেরের ভাগিনা পরিচয় দেওয়া আলী হায়দার রতনের সঙ্গে মিলে ভূমি অধিগ্রহণ জালিয়াতির কারবারে হাত পাকিয়েছে তিনি। একাধিকবার গণমাধ্যমেরও শিরোনাম হন। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলে টাকার বিনিময়ে কমিটি বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জানা গেছে, আক্তার মাস্টার স্থানীয় সাইটালিয়া দাখিল মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিরত থাকলেও দীর্ঘদিন তিনি প্রতিষ্ঠানে না গিয়ে বেতন-ভাতা উত্তোলন করেছেন। সম্প্রতি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তবে পদ নিয়েছেন বিএনপির জাতীয়তাবাদী শিক্ষক সংগঠন অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম সদস্য।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২১ সালের ১৭ আগস্ট তার নানা অনিয়ম নিয়ে সংবাদ করতে গেলে গাজীপুরে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক হোসাইন বাবুকে মারধর করে আলোচনায় আসেন আক্তার মাস্টার। সে দিনই তার বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী। সে মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। সেটিকে প্রচার করেন রাজনৈতিক মামলা হিসেবে।

মামলায় দলীয় নেতাকর্মীরাও বাড়িছাড়া

শ্রীপুর পৌর স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য শেখ ওমর ফারুক দীর্ঘদিন থেকে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত। আওয়ামী শাসনামলে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন নিজের বাবা-দাদার জমি একটি গার্মেন্টস কোম্পানিকে ভাড়া দিয়েছেন, সেখানে ঝুট ব্যবসার শর্তে। সব ঠিকঠাকই চলছিল। তবে ক্ষমতার পালাবদলে সেখানে বাগড়া দেয় আক্তার মাস্টারের বাহিনী। দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের চাঁদা। সেই চাঁদার টাকা না দেওয়ায় দিনদুপুরে তিনটি কাভার্ডভ্যান ভর্তি ঝুট মালপত্র নিয়ে যাওয়া হয় ডাকাতি করে। কাভার্ডভ্যান কিংবা মাল, কোনোটারই আর খোঁজ মেলেনি। ডাকাতির নেতৃত্ব দেন আক্তার মাস্টারের ডান হাত হিসেবে এলাকায় পরিচিত শ্রীপুর পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক গফুর মণ্ডল। সেই ডাকাতির সিসিটিভি ফুটেজ কালবেলার হাতে রয়েছে। এরপর থানা পুলিশ থেকে শুরু করে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি শেখ ওমর ফারুক। উল্টো হয়েছেন হত্যা মামলার আসামি।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর শ্রীপুরে প্রায় এক ডজন মামলা হয়েছে। প্রথম থেকেই এসব মামলার নেপথ্যে ছিলেন আক্তার মাস্টার। মামলায় শত শত মানুষের নাম যুক্ত করে বা বাদ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। অনেক মামলায় বিএনপির নেতাকর্মী ও সাধারণ অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নামও যোগ করা হয়েছে। এরপর মামলা রেকর্ড হওয়ার আগে খসড়া এজাহার তাদের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। টাকা দিলে বাদ দেওয়া হয় নাম। এমন অন্তত ৩টি এজাহার এসেছে কালবেলার কাছে। যেসব এজাহার বিভিন্ন মানুষের কাছে পাঠিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করে নাম পরিবর্তন করেছেন। সর্বশেষ গত ২০ ফেব্রুয়ারি শ্রীপুর থানায় একটি হত্যা মামলা হয়, ওই মামলায় শ্রীপুরের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনজন শিক্ষককেও আসামি করা হয়েছে। গাজীপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হাই মণ্ডল, মহিলা দলনেত্রী মর্জিনা আফসারের দুই দেবর বর্তমান ওয়ার্ড কমিটির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলামসহ একাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দখল করে নিয়েছেন বাড়িঘর।

আক্তার মাস্টারের একসময়ের ব্যবসায়িক অংশীদার আলী হায়দার রতনকেও মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করেন। মামলা থেকে রতনকে রক্ষার জন্য তার কেয়ারটেকার আব্দুল হামিদের মাধ্যমে ৪৫ লাখ টাকা দাবি করেছেন। সেই টাকা আদায় করে মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার আলোচনা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আব্দুল আউয়াল কলেজের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি হতে চেয়েছিলেন আক্তার মাস্টার। পদ না পেয়ে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা স্থানীয় বিএনপি নেতা খোকন সরকারকে দুটি হত্যা মামলার আসামি করেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। এলাকার সাধারণ লোকজনকে মামলা দিয়ে হয়রানি করায় স্থানীয়রা আক্তার মাস্টারের বিরুদ্ধে গত ২৬ জানুয়ারি শ্রীপুরে মানববন্ধন করেন।

স্থানীয়দের আরও অভিযোগ, আলহাজ নওয়াব আলী আদর্শ বিদ্যালয়ের সভাপতির পদ দিতে প্রধান শিক্ষককে নানামুখী ভয়ভীতি দেখান আক্তার মাস্টার। তার এই হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন স্থানীয়রা। এ ছাড়া বিএনপির রাজনীতিতে জড়িত হিসেবে এলাকায় পরিচিত তারেক আজিজ। তার দাদা মাওলানা আব্দুল জলিল ছিলেন তেলেহাটি ইউনিয়ন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। চাচা অ্যাডভোকেট আবু জাফর সরকার বর্তমানে তেলেহাটি বিএনপির সভাপতি। চাচার সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকায় আক্তার মাস্টার তারেক আজিজকে একটি হত্যা মামলায় ২১৮ নম্বর এজাহার নামীয় আসামি করেছেন। মো. সালাহ উদ্দিন নামে অন্য একজনের বাড়িসহ ৭০ শতাংশ জমি একটি কোম্পানির কাছে বিক্রির চেষ্টা করেন আক্তার মাস্টার। উদ্দেশ্যে, জমি বিক্রির দালালির টাকা পকেটে নেওয়া। কিন্তু সালাহ উদ্দিন জমি বিক্রিতে রাজি না হওয়ায় তাকে ৩টি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। আক্তার মাস্টারের সঙ্গে গত প্রায় ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে জমি সংক্রান্ত বিরোধ চলছিল স্থানীয় মানিক মণ্ডলের। এর জের হিসেবে আক্তার মাস্টারের নির্দেশে ২০০৫ সালে মানিক মণ্ডলকে গলা কেটে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার। সেই মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন। মামলা তুলে নিতে মানিক মণ্ডলের পরিবারকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছেন আক্তার মাস্টার ও তার বাহিনী। গত ৫ আগস্টের পরে মানিক মণ্ডলের বাড়ি দখলের উদ্দেশ্যে অন্তত দুবার হামলা করেছে আক্তার মাস্টারের লোকজন। এসব ঘটনায় শ্রীপুর থানায় অভিযোগ দিতে গেলে মামলা নেয়নি পুলিশ। উল্টো মানিক মণ্ডলের ছেলে মো. কামরুল হাসানের বিরুদ্ধেই দেওয়া হয়েছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটায় দায়ের হওয়া একাধিক হত্যা মামলা।

জানতে চাইলে মানিক মণ্ডলের ছেলে মো. কামরুল হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা অভিযোগ নিয়ে গেলেই পুলিশ আক্তার মাস্টারের ভাই ওসিকে ফোন দেন। এরপর আর আমাদের কোনো সাহায্য করে না পুলিশ। এভাবে জমি নিয়ে বিরোধের জেরে স্থানীয় আল আমিন তালুকদার ও মোস্তফা কামাল নামে আরও দুই ব্যক্তিকে হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে।

স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা বলেন, ‘বিগত সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে শ্রীপুরে আক্তার মাস্টারকে পাওয়া যায়নি। আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা হলে তিনি রাজধানীর উত্তরায় চলে যেতেন। কর্মীদেরও কোনো খবর রাখেননি। কমিটি বিক্রির মাধ্যমে দলের ত্যাগী কর্মীরা বাদ পড়ায় শ্রীপুরে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হয়েছে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনেও আক্তার মাস্টার ছিলেন নিরাপদ স্থানে। শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত হলে ৫ আগস্ট শ্রীপুরে ফেরার পথে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীরের বাড়ির সামনে ছাত্ররা তার গাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ওই যাত্রায় পালিয়ে বাঁচেন আক্তার।’

অর্ধশত কারখানার ঝুটের নিয়ন্ত্রক আক্তার মাস্টার:

শ্রীপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর যোগসাজশে গত ১৫ বছর ঝুট ব্যবসা চালিয়ে গেছেন আক্তার মাস্টার। ৫ আগস্টের পর একক নিয়ন্ত্রণে নেন এই কারবারের। তেলিহাটি ইউনিয়নের অর্ধশত কারখানার পুরো ঝুট ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রণ এখন তার হাতে। কয়েকটি কারখানায় দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গেও সংঘর্ষ জড়ানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাওনা পল্লী বিদ্যুৎ মোড়ে এসিআই কোম্পানির প্রিমিয়াফ্লেক্স প্লাস্টিক কারখানায় দীর্ঘদিন থেকে ঝুট ব্যবসা করতেন সাখাওয়াত হোসেন নামে এক ব্যবসায়ী। ৫ আগস্টের পর মামলা দিয়ে সাখাওয়াতকে এলাকাছাড়া করে কারখানার নিযন্ত্রণ নেন আক্তার মাস্টার। একইভাবে নোমান গ্রুপের তালহা স্পিনিং মিলস, নোমান স্পিনিং মিল, হাসিন সোয়েটার, এস আর সোয়েটার, আম্মান বাংলাদেশ, নর্দান, ডিবিএল গ্রুপের মাওনা ফ্যাশন, বিবিএস কেবলসহ কয়েক ডজন কারখানার ঝুট ও বাতিল যন্ত্রাংশের ব্যবসা এখন তার নিয়ন্ত্রণে। ইউনিয়ন বা উপজেলার কোনো নেতাকর্মীকেও পাত্তা দেন না তিনি।

জানা গেছে, তেলিহাটি ইউনিয়ন পরিষদের আওয়ামী লীগ সমর্থক চেয়ারম্যান বাতেন সরকারকে নিজ পদে বহাল করতে ৫০ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ আক্তার মাস্টারের বিরুদ্ধে। পরে আওয়ামী লীগের প্যানেল চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়ে তার কাছ থেকেও মোটা অঙ্কের টাকা নেন তিনি। এ ছাড়া প্রতি ইউপি সদস্যদের মামলা ও গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে অর্ধলাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। গত ৯ ফেব্রুয়ারি শ্রীপুর থেকে গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য চয়ন ইসলামকে আশ্রয় দিয়েছিলেন আক্তারুল আলম মাস্টার। চয়নকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করতে গেলে আক্তার মাস্টার ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে ছাত্রদের রোষানলে পড়ে পালিয়ে যান।

আত্মীয়ের জমি বাঁচাতে অন্যের জমিতে রাস্তা

জানা গেছে, তিন কোটি টাকায় এমসি বাজার হাজী ছোট কলিম স্কুল সড়কে সাধারণ মানুষের জমি দখল করে নোমান গ্রুপের কারখানায় যাওয়ার জন্য রাস্তা নির্মাণের কাজ হাতে নেন আক্তার মাস্টার। কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ ছাড়াই সড়কের জন্য দখল করা হয়েছে স্থানীয় লোকজনের জমি। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী সবুজ খান কালবেলাকে বলেন, ‘সড়কের এক পাশে আক্তার মাস্টারের আত্মীয়দের জমি, তাদের জমি ও স্থাপনা রক্ষা করতে আমাদের জমির ওপর দিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক খান ও আলমগীর হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তা তৈরির কাজ করছেন আক্তার মাস্টার। কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি।

ভাওয়াল এস্টেটের জমি থেকে মাটি বিক্রি

স্থানীয়রা জানান, গাজীপুরের টেংকার মৌজায় মো. আজিজুল হক, দুলু মিয়া ওরফে সিদ্দিক মিয়া, মো. সোহেল, মো. সুজন মিয়া, মোছা. শিল্পি আক্তারের পরিবার বংশপরম্পরায় প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এক খণ্ড জমিতে মাটির ঘর বানিয়ে বসবাস করছে। জমিটি সরকারের খাস ও ভাওয়াল এস্টেটের। ক্ষমতার পালাবদলে সেই জমিতে কুনজর পড়ে আক্তার মাস্টারের। রাতের আঁধারে বসবাসকারীদের বাড়ির পাশের জমির মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে আক্তার মাস্টারের লোকজন। সেইসঙ্গে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়।

বোনকে তালাক দেওয়ায় ৮ মামলায় আসামি রাশেদ

আকতারুল আলম মাস্টারের বোন ফারজানা আক্তারের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় স্থানীয় রাশেদুল হাসানের। এই দম্পতির দুটি কন্যা সন্তান রয়েছে। তবে বনিবনা না হওয়ায় এক সময় তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আক্তার মাস্টারের বোনকে তালাক দেওয়ার পরই রাশেদুলের জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। একের পর এক মামলায় রাশেদুলের জীবন এখন বিপর্যস্ত। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের আগে অন্তত ৫টি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় অব্যাহতি পেয়েছেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর নতুন করে আবার শুরু হয়েছে হয়রানি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ের সহিংসতার ঘটনায় দায়ের হওয়া অন্তত দুটি হত্যা মামলাসহ ৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে রাশেদুলকে। একের পর এক মামলায় রাশেদুল এখন এলাকাছাড়া। আর এই সুযোগে রাশেদুলের ৬ তলা বাড়ি, বাড়ির পাশের ৭০ শতাংশ কৃষিজমিসহ সব জমিজমা সম্পত্তি দখল করে নিয়েছেন বিএনপি নেতা আক্তার মাস্টার ও তার লোকজন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আক্তার মাস্টারের বোন ফারজানা স্থানীয় টেংরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। তবে রাশেদুলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলে ফারজানা দীর্ঘদিন স্কুলে অনুপস্থিত ছিলেন। তার অনুপস্থিত থাকায় তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওমর ফারুক সেটি শিক্ষা অফিসকে জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। এরপর ফারজানাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর জের ধরে ৫ আগস্টের পরে প্রধান শিক্ষক ওমর ফারুক এবং ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধেও দেওয়া হয়েছে হত্যা মামলা।

জানতে চাইলে আত্মগোপনে থাকা রাশেদুল ইসলাম মোবাইল ফোনে কালবেলাকে বলেন, ‘স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার পর আমার বিরুদ্ধে ৫টি হয়রানিমূলক মামলা করেছে তারা। সব মামলায়ই আমি খালাস পেয়ছি। ৫ আগস্টের পরে নতুন করে আরও দুটি হত্যা মামলাসহ ৩টি মামলায় আসামি করা হয়েছে আমাকে। ওইসব মামলার কারণে আমি আত্মগোপনে আছি। আর ওইদিকে আক্তার মাস্টারের লোকজন আমার ৬ তলা বাড়ি, কৃষিজমিসহ সব সম্পত্তি দখল করে নিয়ে গেছে। আমার মা আমার বাড়িতে থাকতে পারছেন না। আমার দুটি মেয়ে, তাদেরও আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছে। তাদের এক ভাই পুলিশে চাকরি করে, সে এখন ঢাকার একটি থানার ওসি। তার প্রভাবের কারণে আমরা পুলিশি কোনো সহায়তাও পাই না।

পুলিশের বক্তব্য

আক্তার মাস্টারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর থানার ওসি মো. জয়নুল আবেদীন কালবেলাকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সঠিক নয়। আক্তার বা তার পরিবারের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আর সব মামলার বাদীই পাবলিক। তাদের আমি চিনিও না। আমি আসার পরে মাত্র দুটি মামলা হয়েছে। বেশিরভাগ মামলা কোর্টে হয়েছে। যারা বাদী তারাই আসামি করেছে। আমি এসব ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আক্তার মাস্টার এলাকার বিএনপি নেতা হিসেবে তাকে আমি চিনি।

যা বললেন আক্তার মাস্টার

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা আক্তারুল আলম মাস্টার ওরফে আক্তার মাস্টার কালবেলাকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। আমি বা আমার কোনো লোকজন এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই।’ নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের দলীয় কোনো নেতাকর্মীকে হয়রানিমূলক মামলায় জড়ানো হলে আমরা বলে রাখি, কিছু করা যাবে না। তারা আমাদের লোকজন। যারা আওয়ামী লীগ করত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলার বাদী কারা, সেটা আমি জানি না।