Image description

বর্তমান বিপ্লবী সরকারের নীতি-আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষিত জাতীয় দুশমনদের সুরক্ষা প্রদান, ফ্যাসিবাদবিরোধী সাংবাদিক হয়রানি এবং স্বৈরাচারী আমলের লুটপাট অব্যাহত রাখার নীতি গ্রহণ করেছেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাহাবুব মোর্শেদ। পতিত স্বৈরাচার হাসিনা আমলে এ সংস্থায় কর্মরত যেসব সাংবাদিক নামধারী দুর্বৃত্ত বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও জনগণের বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ করেছেন, শতকোটি টাকা লুট করেছেন, তাদের সবাই এখনো আছে বহাল তবিয়তে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বাসসের সাবেক এমডি আবুল কালাম আজাদ, আনিসুর রহমান, সুভাষ চন্দ বাদল, স্বপন বসু, সাজ্জাদ হোসেন সবুজ, সাইফুল ইসলাম কল্লোল, শাহনাজ সিদ্দিকীসহ আরও অনেককেই জাতীয় দুশমন ঘোষণা করে। কিন্তু নবনিযুক্ত এমডি বিগত ৭ মাসে তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের পরিবর্তে সুরক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছেন।

 

এদিকে নবনিযুক্ত তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম গত মঙ্গলবার বাসস কার্যালয় পরিদর্শন করেন। এ সময় উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশ এখন ভারতসহ ঘরে-বাইরে অশুভ এক তথ্যযুদ্ধের সম্মুখীন। বিপ্লবে পরাজিতরা এই যুদ্ধে শিথিল হয়ে যায়নি। তিনি দেশের ভাবমূর্তি ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে বাসসকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। উপদেষ্টার বক্তব্যের সঙ্গে সংস্থায় বিরাজমান চালচিত্রের কোনোই মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ বাসসে স্থায়ীভাবে কর্মরত সাংবাদিকদের সিংহভাগই ফ্যাসিবাদের অনুচর। হাসিনা আমলে তাদের অনেকেই একটি বিদেশি রাষ্ট্রের মদদে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার হরণের পক্ষে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। শেখ হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতায় বেতন-ভাতার নামে সরকারি অর্থ হরিলুট করেছে।

তা ছাড়া বাসসে অন্তর্বর্তী সরকার নিযুক্ত এমডি মাহাবুব মোর্শেদের কর্মকাণ্ডেও সরকারের গৃহীত নীতি-আদর্শের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। তিনি সংস্থায় ভারতের অনুচরদের লালন এবং ফ্যাসিবাদবিরোধীদের দমননীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করে চলেছেন। তিনি পেশাগতভাবে সংস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রধান বার্তা সম্পাদকের পদটি দিয়েছেন সর্বকনিষ্ঠ মুর্শেদুর রহমানকে। যিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার স্বীকৃত এজেন্ট সাংবাদিক শ্যামল দত্তের খুবই ঘনিষ্ঠ। মুর্শেদের পুরো পরিবারই পতিত আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত। দায়িত্ব গ্রহণের পর এমডি মাহাবুব কমপক্ষে ১০ জন ফ্যাসিবাদবিরোধী সাংবাদিককে হয়রানি করেছেন। তুচ্ছ কারণে তাদের কাউকে কাউকে পদচ্যুতি ছাড়াও কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে বাসস চাকরিবিধি লঙ্ঘনের কাল্পনিক অভিযোগও আনা হয়েছে। এমডির স্বেচ্ছাচারী আচরণে বাসসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অন্যতম হলো সিনিয়র সাংবাদিক গুলাম আহাদ, রহিম উদ্দিন ও মুরসালিন নোমানী। অনেকেরই মাসিক ইনক্রিমেন্ট বন্ধ রেখেছেন বিনা কারণে।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, হাসিনা আমলে শতকোটি টাকা লুটপাটের পাশাপাশি যে চক্রটি বাসসকে ফ্যাসিবাদ প্রচারণার প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করেছিল, মাহাবুব মোর্শেদ তাদের ব্যাপারে চোখ বন্ধ রাখার নীতি গ্রহণ করেছেন। অভিযোগ যাচাইয়ে নিুোক্ত উদাহরণই যথেষ্ট হবে। সরকার পতনের পর বাসস ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং একই সঙ্গে ভারতের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম পিটিআইয়ের ঢাকা প্রতিনিধি আনিসুর রহমান দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন। চাকরিবিধি লঙ্ঘন করেই আনিস দীর্ঘদিন এমন কাজ করেছেন। এখনো করছেন। কিন্তু মাহাবুব মোর্শেদ আনিসের অতীতের অপকর্মের জবাবদিহি তলব না করে রহস্যজনক কারণে তার কথিত পদত্যাগপত্রটি গ্রহণে দুই মাস সময় ব্যয় করেন। তাকে পূর্ণ নিরাপত্তার আশ্বাস দেন এবং কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। অথচ খুব নগণ্য ঘটনায় তিনি অনেকের বিরুদ্ধেই চাকরিবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের বিরুদ্ধে কাজ করে শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কৃত হয়েছে আনিসুর রহমান। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশবিদ্বেষী ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের যোগসাজশে বাসস থেকে প্রচার করেছেন ভুয়া সংবাদ। তারই ধারাবাহিকতায় বিগত ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ রাত ৯টা দুই মিনিটে বাসস থেকে প্রচার করা হয় ভয়াবহ এক সংবাদ। সংবাদটির ক্রমিক নম্বর-৪০। ওই সংবাদের মূল প্রতিপাদ্য ছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র যোগসাজশে বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চায়। সুবীরসংশ্লিষ্ট ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রের বরাত দিয়েই এ জঘন্য কাজটি করা হয়। সাংবাদিকতার রীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতামতের তোয়াক্কা না করেই প্রতিবেদনটি প্রচার করেন তিনি। এ সংবাদ প্রচারের সঙ্গে সংস্থার আরও অনেকেই জড়িত ছিল। হাসিনা সরকারের বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের বৃহত্তর ক্ষেত্র তৈরির নিমিত্তে পরিকল্পিতভাবেই এটা করা হয়েছিল।

ভুয়া সংবাদটিতে দাবি করা হয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার জীবনের ওপর পরিচালিত সর্বশেষ হত্যা প্রচেষ্টা থেকে রক্ষা পেয়েছেন। তবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী সেই হত্যা প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের এ অপতৎপরতা নজরদারি করছিল। অত্র সংবাদে আরও বলা হয়, বিএনপিপ্রধান বেগম খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমান এ হত্যা প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ব্যর্থ এ হত্যা প্রচেষ্টার আগে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান লন্ডনে অন্তত তিনজন পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।

সংবাদটি প্রচারের পর নানা মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হলে বাসস অল্প সময়েই তা প্রত্যাহার করে নেয়। আনিস গংয়ের সংবাদটি প্রত্যাহারের মধ্যেই সীমিত ছিল না। অপরাধের চিহ্ন মুছে ফেলতে বাসস সার্ভার থেকে আইটেমটি গায়েব করে দেওয়া হয়। বাসসে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন। সংবাদটি ভারত-বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টকশোর হিড়িক পড়ে যায়। আওয়ামী নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায়। তদানীন্তন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের পরামর্শ দেন।

মাত্রাতিরিক্ত স্পর্শকাতর এ ঘটনায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর অফিস বাধ্য হয়েই একটি বিবৃতি প্রদান করে। এতে সুবীরের অপসাংবাদিকতার নিন্দা জানানো হয়। পরবর্তী সময়ে ২৫ সেপ্টেম্বর ইংরেজি দেনিক ডেইলি স্টার ‘প্রধানমন্ত্রী হত্যা প্রচেষ্টা : ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমের খবর প্রত্যাখ্যান’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ডেইলি স্টার বাসস থেকে এ ধরনের সংবাদ পরিবেশনে বিস্ময় প্রকাশ করে। ঘটনায় দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হলে তথ্য মন্ত্রণালয় ভুয়া সংবাদ পরিবেশনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়, কিন্তু ফলাফল হয় তার উলটো। পিটিআই প্রতিনিধি আনিসুর রহমান পদোন্নতি পেয়ে প্রধান বার্তা সম্পাদক থেকে হয়ে যান বাসসের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আর তার সহযোগী আশেকুন্নবী চৌধুরী লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে মিনিস্টার প্রেস।

মাহাবুব মোর্শেদের বিরুদ্ধে বাসসে স্বৈরাচার আমলের লুটপাটের ধারা বজায় রাখতে অভিন্ন নীতি ও কৌশল গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। গত ৩০ জানুয়ারি বাসসের সাবেক এক সিনিয়র সাংবাদিক পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর এক দরখাস্তে উল্লেখ করেছেন, হাসিনা আমলের মতো সংস্থাটিতে এখনো সরকারি অর্থের হরিলুট চলছে। অভিযোগে বলা হয়, এমডির জ্ঞাতসারে বর্তমান সরকার কর্তৃক গঠিত পরিচালনা বোর্ডের প্রথম সভার আলোচ্যসূচিতে স্বৈরাচার আমলের অনিয়ম-দুর্নীতির প্রসঙ্গটি বাদ দিয়েছেন। এমনকি বিগত ২২ অক্টোবর ২০২৪ প্রথম আলোতে এতদসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পরও বিষয়টি পরিচালনা বোর্ডের নজরে আনেননি।

অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, শেখ হানিার আমলে পরিচালনা বোর্ডের অনুমতি ছাড়াই তাবৎ প্রশাসনিক ও আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নিয়ম ভেঙে দলীয় ক্যাডার নিয়োগ, পদোন্নতি, সর্বোচ্চ বিশেষ বেতন গ্রেড প্রদানের মাধ্যমে সরকারি অর্থ হরিলুট করা হয়েছে। এ খাতে লুণ্ঠিত অর্থের পরিমাণ প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। খুব অল্প সময়ে কর্মরত মাত্র ১৭২ জনের মধ্যে ৫০ জনের মাসিক বেতন-ভাতা ২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। অপর ৩০ জন উন্নীত হয়েছে ১ নম্বর গ্রেডে, যাদের বেতন দেড় লাখ টাকার মতো। উপকারভোগীদের সিংহভাগই আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের ক্যাডার। তাদের প্রাথমিক নিয়োগ ও মাত্রাতিরিক্ত বেতন-ভাতা অবৈধ হলেও মাহাবুব মোর্শেদ এ ব্যাপারে একেবারেই নিস্পৃহ।

সাবেক বাসস এমডি আবুল কালাম আজাদ, প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ অনেকেই নিজেদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করছেন মর্জিমাফিক। প্রচলিত নিয়মের তোয়াক্ক না করেই বাগিয়ে নিচ্ছেন সর্বোচ্চ আর্থিক সুবিধা। বর্তমান নবীন এমডিও সাবেক ১০ বছরের একটানা এমডির সমপরিমাণ আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বিধি লঙ্ঘন করে। এদের আহরিত মাসিক বেতন-ভাতা, বিল পরীক্ষা করলে অবৈধ আর্থিক সুবিধার প্রমাণ মিলবে অবশ্যই। উদ্বেগের বিষয়, সাবেক ও বর্তমান এমডির সব বেআইনি অফিস আদেশগুলো অনুমোদনের জন্য সভার আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। স্বৈরাচারের দোসর আজাদের মতোই মাহাবুব মোর্শেদ নিয়োগ, পদোন্নতি গ্রেড পরিবর্তনসংক্রান্ত যেসব অফিস আদেশ জারি করেছেন, সবই অবৈধ। এতে পরিচালনা বোর্ডের এখতিয়ার এবং চাকরিবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। তার গৃহীত সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, যা দুর্নীতির নামান্তর।

অন্তর্বর্তী সরকার নিযুক্ত এমডি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই সংবাদপত্র শিল্পে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে চলেছেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) বাসসে স্বৈরাচার আমলের অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত এবং জড়িতদের বিচার দাবি করলে তিনি চরম ক্ষুব্ধ হন এবং ইউনিয়নকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে চিত্রিত করার অপপ্রয়াস চালান। তিনি ডিইউজের বৈধ সমাবেশ প্রতিহত করতে পুলিশের দ্বারস্থ হন। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার মতোই তিনি ডিইউজেকে জামায়াত ট্যাগ দিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারে লিপ্ত হয়েছেন। তার এতদসংক্রান্ত রাজনৈতিক বিদ্বেষপ্রসূত ফেসবুক পোস্টটি সরকারি চাকরিবিধির গুরুতর লঙ্ঘন। তার স্বেচ্ছাচারী আচরণে সাংবাদিকদের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভ ও চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ডিইউজে ১৭ মার্চের মধ্যে মাহাবুব মোর্শেদকে বাসস থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছে।

 

আবুল কালাম মানিক : সিনিয়র সাংবাদিক