
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাইফ সাপোর্ট থাকা মাগুরার আট বছরের সেই শিশুটিকে আনা হয় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। সেদিনই গাজীপুরের শ্রীপুরে আরেকটি শিশুকে ধর্ষণ করা হয়। একই দিনে ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলায় পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেপ্তার হন এক শিক্ষক। আবার ওই রাতেই কেরানীগঞ্জে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের খবর আসে।
এমনিতে অব্যাহতভাবে চলতে থাকা নারী ও শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন, নারীদের দলবদ্ধভাবে হেনস্তা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে রাতে–দিনে প্রতিবাদ হচ্ছিল দেশের বিভিন্ন জায়গায়। কিন্তু ৮ মার্চ নারী দিবসের বিভিন্ন আয়োজনে-অনুষ্ঠানে-আলোচনায় দেশের নারী ও কন্যাশিশুদের নিরাপত্তার বিষয়টি সেভাবে উঠে আসেনি বলে মনে হয় এখনকার রাজনীতিতে সক্রিয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী শেখ তাসনিম আফরোজ ইমির।
মূলত এই 'ক্ষোভ' থেকে এবং দেশব্যাপী নারী ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও হেনস্তার প্রতিবাদে পাঁচ দফা দাবি নিয়ে নারী দিবসের রাতেই পথে নেমে আসেন ইমি। অবস্থান নেন ঢাকার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনের ফুটপাতে।
শুরুতে ওই অবস্থানে ইমি ছিলেন একা। পরে তার সঙ্গে সংহতি জানাতে আসেন কেউ কেউ। আজ শনিবার তাদের এই অবস্থানের অষ্টম দিন চলছে।
সরকারের কাছে ইমির পাঁচ দফা দাবিগুলো হলো—ধর্ষণ ও বলাৎকারের বিচারের সার্বিক কার্যক্রম ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পন্ন করা এবং রায় দ্রুত কার্যকরের ব্যবস্থা করা, দেশের প্রতিটি খানায় একজন নারী পুলিশ কর্মকর্তার নেতৃত্বে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে একটি ইমার্জেন্সি ক্রাইসিস রেসপন্স টিম গঠন, ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশের ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের ওপর যে বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে, সেই ধারায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেও যুক্ত করা, ভিকটিমের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং নারী ও শিশুর ওপর সংঘটিত সব ধরনের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির জন্য উদ্যোগী ভূমিকা নেওয়া।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের সামনে কথা হয় ইমির সঙ্গে। এ সময় তার সঙ্গে আরও কয়েকজন নারী-পুরুষকে সেখানে অবস্থান করতে দেখা যায়। লাগাতার অবস্থানের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কোন কারণটি কাজ করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সারাদেশেই কন্যাশিশুদের প্রতি নিপীড়ন, নারীদের বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা ও ধর্ষণের ঘটনা তো ঘটছিলই। সবগুলো ঘটনাই তো আমাদের সবার ক্ষোভটাকে পুঞ্জীভূত করছিল। আমার কাছে মাগুরার শিশুটির ঘটনা এর শেষ পেরেক ছিল।'
ইমি বলতে থাকেন, '৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস ছিল। নারী দিবসের বিভিন্ন আয়োজনে আমার মনে হয়নি যে নারীদের নিরাপত্তা এবং আমাদের কন্যাশিশুদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি সেভাবে আলোচনায় উঠে এসেছিল। তখন আমি আরও বেশি ক্ষুব্ধ হই। আমার মনে প্রশ্ন জাগে—নারীদের আয়োজনে নারীদের সমস্যা কেন অ্যাড্রেস করা হচ্ছে না? এসময় আমার মনে হয় যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। কিছু একটা করতে হবে। সেই সিদ্ধান্ত থেকেই রাস্তায় বেরিয়ে আসা এবং অবস্থান নেওয়া।'
এভাবে টানা এক সপ্তাহের অবস্থানের পরেও সরকারের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানান ইমি। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'যতক্ষণ না আমি আমার দাবি আদায় করতে পারব, ততক্ষণ আমার কর্মসূচি চালিয়ে যাব।'
ইতোমধ্যে তার এই অবস্থান কর্মসূচিতে কিছু ব্যক্তির পাশাপাশি চারটি সংগঠন সংহতি জানিয়েছে বলে দাবি করেন ইমি। ওই সংগঠনগুলো হলো—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও রাষ্ট্রচিন্তা।
ইমি বলেন, 'এই উদ্যোগটা আমার। কিন্তু আমার সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সবসময় কেউ না কেউ থাকছে।' তার এই অবস্থানের বিপরীতে সরকারের আচরণকে 'অবহেলামূলক ও অত্যন্ত দুঃখজনক' বলে অভিহিত করেন তিনি। আরও বলেন, 'আমি একটা যৌক্তিক দাবি নিয়ে দাঁড়িয়েছি। রাষ্ট্রের উচিত ছিল দাবিগুলো শোনা। সেটি শুনে আমার ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করা। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।'
ইমি জানান, তিনি জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে শামসুন্নাহার হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ে তিনি এখানে দাঁড়াননি।
ইমি বলেন, 'আমি এমন কোনো দাবি জানাইনি যেটা বাস্তবায়ন করা কঠিন। আমার এক নম্বর দাবির ব্যাপারে আমি ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছিলাম। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা উদ্যোগী হলে দুই ঘণ্টার মধ্যে অ্যাকশন নেওয়া সম্ভব ছিল। প্রতি থানায় একটা করে টিম গঠন করে দেওয়া। সেটা হয়নি। এই যে অবহেলা; এর চেয়ে দুঃখজনক কিছু হয় না।'
এ সময় কথা হয় সেখানে অবস্থান নেওয়া জাকিয়া শিশির নামের আরেক নারীর সঙ্গে। নিজেকে একজন শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। বলেন, 'এই দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে, একজন নারী হিসেবে ইমির সঙ্গে সংহতি জানাতে আজকে দ্বিতীয় দিন এখানে এসেছি।'
এই প্রতিবাদে শামিল রাষ্ট্রসংস্কার ছাত্র আন্দোলনের লামিয়া ইসলাম বলেন, '৮ মার্চ নারী দিবসে অনেক জায়গা থেকে দাওয়াত পাচ্ছিলাম। দেখলাম যে অনেক রকমের এলিট প্রোগ্রাম হচ্ছে। সেখানে এই প্রোগ্রামটি ছিল ব্যতিক্রম। তাই ধর্ষণের বিচার নিশ্চিতে দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে এখানে এসেছি।'