
জাকিয়া খাতুনের মূল পেশা ছিল বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা। পঞ্চগড় ড. আবেদা হাফিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক তিনি ছিলেন। পরে মহিলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন তিনি।
আওয়ামী লীগ নেত্রী মাহমুদা বেগম কৃকের খুঁটির জোরেই জাকিয়া হয়ে উঠেন প্রভাবশালী নেত্রী। এছাড়া আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদেরসহ একাধিক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে ছিল তার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা।
জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই তিনি স্কুলে আসেন না। শারীরিক অসুস্থতাজনিত ছুটিতে থেকেও নিয়মিত বেতন-ভাতাদি গ্রহণ করে চলেছেন।
পঞ্চগড় পৌরসভার সাবেক মেয়র ও মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী জাকিয়া খাতুন। ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভোটারবিহীন নির্বাচনে বিনা ভোটের মেয়র ছিলেন তিনি। সম্পূর্ণ ফিল্মি কায়দায় দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করে মেয়র বনে যান তিনি। বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে হেন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। দলীয় পরিচয় আর ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি অল্প সময়েই বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। বনে গেছেন জিরো থেকে হিরো।
বর্তমানে সাবেক মেয়র জাকিয়া খাতুন হত্যা, নাশকতা, বিএনপি অফিস ভাঙচুরসহ বেশ কয়েকটি মামলার পলাতক আসামি। এদিকে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে জাকিয়া খাতুনের মূল পেশা ছিল বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা। তিনি ছিলেন পঞ্চগড় ড. আবেদা হাফিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক। তার স্বামী মো. আনোয়ার হোসেন মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগে করণিকের চাকরি করেন। এরপর মহিলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার সুবাদে জাকিয়া খাতুন এখন ধনকুবের। অথচ স্কুলশিক্ষকের মাত্র ২২ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে এখন বাড়ি-গাড়ি, ধনসম্পদ কি নেই তার? জুলাই বিপ্লবের আন্দোলন ঠেকাতে শ্রমিক হত্যাসহ নজিরবিহীন অপকর্মের পরও তিনি এখনো অধরা।
জাকিয়া খাতুনের বিরুদ্ধে অন্যতম প্রধান অভিযোগের মধ্যে রয়েছে-বিভিন্ন খরচের নামে পৌরসভার অর্থ লুটপাট, মাস্টাররোলে কর্মচারী নিয়োগ, পৌরসভার বরাদ্দ আনার নামে ঠিকাদারদের কাছ থেকে নজিরবিহীন চাঁদাবাজি, পৌরসভার কোটি কোটি টাকার কাজে নিজেই ঠিকাদারি করা, পৌরসভার বিভিন্ন কেনাকাটার নামে লুটপাট, বিভিন্ন দোকানপাট বরাদ্দের নামে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ, তদবির বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর তিনি গা-ঢাকা দেন। বাসাবাড়ি সব ফেলে পঞ্চগড় থেকে উধাও হয়ে যান।
অভিযোগ রয়েছে, শুধু নিজে লাভবান হওয়ার জন্য জাকিয়া খাতুন ২০২১-২২ অর্থবছরে পঞ্চগড় পৌরসভার সামনে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সুপার মার্কেট নির্মাণ করেন। স্থানীয় এক প্রভাবশালী ঠিকাদারকে এ কাজটি দিয়ে তিনি বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন। এদিকে এ মার্কেটটি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করায় গত তিন বছর ধরে এখন পরিত্যক্ত পড়ে আছে। এছাড়া জাকিয়া খাতুন শুধু ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য পৌরসভার টাকায় মূল গেটের সঙ্গে কয়েকটি দোকানঘরও নির্মাণ করে সেগুলো ভাড়া দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। একই সঙ্গে তার আমলে প্রতিটি অর্থবছরে পৌরসভার বড় বড় উন্নয়নমূলক কাজের ঠিকাদারি নিতেন তিনি। আর কাজগুলো দেখভাল করতেন তার স্বামী আনোয়ার হোসেন।
বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে, জাকিয়া খাতুন এখন ঢাকায় তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। জানা যায়, কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী মাহমুদা বেগম কৃকের খুঁটির জোরেই জাকিয়ার এত আয়-উন্নতি। এছাড়া আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদেরসহ একাধিক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে ছিল তার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা। আর এসব কাজে লাগিয়ে তিনি বড় বড় কাজের তদবির, চাকরির তদবিরসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে কোটি কোটি টাকা কামাই করেছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তিনি পৌর মেয়র থাকাকালীন ক্ষমতার অপব্যবহার করে একই সঙ্গে পঞ্চগড় ড. আবেদা হাফিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক হিসাবে ও পৌরসভার মেয়র হিসাবে বেতন-ভাতাদি নিয়েছেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।
তবে ওই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই শারীরিক অসুস্থতাজনিত ছুটিতে থেকেও নিয়মিত বেতন-ভাতাদি গ্রহণ করে চলেছেন এবং ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি স্কুলেও আসতেন না। একদিন এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে যেতেন। আর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরও তিনি চাকরিতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাকিয়া খাতুন ২০২০ সালে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরপরই ঢাকার বনশ্রীতে দুই কোটি টাকা দিয়ে অভিজাত আধুনিক একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন। একই সঙ্গে তার মেয়েকে বিপুল অর্থ ব্যয় করে পড়াচ্ছেন ঢাকার একটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। একই সঙ্গে মেয়েকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়ার জন্য ৪০ লাখ টাকা দিয়ে কিনেছেন লেটেস্ট মডেলের প্রিমিও এফ মডেলের গাড়ি। এছাড়া তার বাবার বাড়ি দিনাজপুর শহরেও গড়ে তুলেছেন কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে বাড়ি ও বিপুল সহায়-সম্পত্তি।
পঞ্চগড় সদর থানার ওসি মাসুদ পারভেজ বলেন, জাকিয়া খাতুনের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ কয়েকটি অভিযোগে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।