
দলের জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ ছেড়ে আসার ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল। এখনো আত্মপ্রকাশ করেনি, নামও জানা যায়নি— এমন একটি দলের নেতৃত্ব দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ ছেড়ে আসার মতো অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটিয়েছেন নাহিদ ইসলাম।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে নতুন একটি রাজনৈতিক দল। সেই দলের নেতৃত্ব দেবেন নাহিদ ইসলাম। আর এ কারণেই তিনি উপদেষ্টার পদ ছাড়লেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারাই নতুন রাজনৈতিক দলটির শীর্ষ পদগুলোর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। নতুন দলের আহ্বায়ক পদে নাহিদ ইসলামের মনোনয়ন নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কারো কোনো আপত্তি ছিল না। সদস্যসচিবসহ অন্যান্য পদগুলোতে কে আসবেন, মূলত তা নিয়ে মতবিরোধ ছিল বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে। সমঝোতার ভিত্তিতে সদস্যসচিব পদে আখতার হোসেনের নাম অনেকটাই চূড়ান্ত। নতুন দলের অন্যান্য শীর্ষ পদগুলোর নেতৃত্বে কারা আসবেন, তাও ইতোমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে বলে জাতীয় নাগরিক কমিটি সূত্রে জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র নাহিদ ইসলাম কোটাবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করে দেশব্যাপী পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। ওই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছিলেন নাহিদ ইসলাম।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদ থেকে নাহিদ ইসলামের পদত্যাগ করার সিদ্ধান্তকে ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ এবং একই সঙ্গে ‘সম্ভাবনাময়’ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকারে তার ধীরস্থির ও দৃঢ় নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছে। তার উপদেষ্টা পদ ছেড়ে রাজনৈতিক দলে আসার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন নেটিজেনরাও। নতুন রাজনৈতিক দলটি কীভাবে দাঁড়াবে এবং সেখানে নাহিদ ইসলামের ভূমিকা ও নেতৃত্ব কেমন হবে, তা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঝুঁকির দিক হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দল এখনো আত্মপ্রকাশ করেনি। ভালো ও গঠনমূলক রাজনৈতিক চর্চা করতে না পারলে, মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে না পারলে দলটির সঙ্গে অনিশ্চয়তায় পড়বে নাহিদ ইসলামের ভবিষ্যৎ। আর সম্ভাবনার দিক হচ্ছে, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকে ভালো রাজনৈতিক চর্চা হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলো জনবান্ধব সরকার উপহার দিতে অনেকটা ব্যর্থ। সেই জায়গাটাতে নতুন রাজনৈতিক দলের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা ও আগ্রহ প্রবল। এটাকে কাজে লাগিয়ে নতুন রাজনৈতিক দলকে এগিয়ে নিতে পারলে নাহিদ ইসলাম সফল হবেন।
বিএনপি এবং জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল নতুন রাজনৈতিক দলের আগমনকে স্বাগত জানিয়েছে, এটিকেও ইতিবাচকভাবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। তবে দেশে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের জন্য জায়গা তৈরি করার কঠিন সংগ্রামে নামতে হবে নতুন দলকে। শুধু গঠনমূলক ও জনকল্যাণমুখী রাজনীতিই নতুন দলকে সফলতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে আসন্ন নতুন দল ও তাদের নেতাদের অনেক বেশি সহনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত হওয়ার বিকল্প নেই বলেও মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
উপদেষ্টা পদ ছেড়ে রাজনৈতিক দলে আসা নাহিদ ইসলামের জন্য কতটা ঝুঁকির কিংবা কতটা সম্ভবনাময় জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. শামছুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, একদিকে একটা ঝুঁকি আছে, আরেক দিকে আছে সম্ভাবনা। আসলে ঝুঁকি নিয়েই রাজনীতিতে এগিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, ঝুঁকি থাকবে তারপরও নাহিদ ইসলামের সরকার থেকে পদত্যাগ করে জনগণের কাতারে চলে আসা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল ঘটনা। সেটাও কিন্তু তিনি করেছেন এক হিসেবে। তিনি একটা ঝুঁকি নিয়েছেন।
রাজনীতির এই শিক্ষক আরও বলেন, নাহিদ ইসলাম যদি একনিষ্ঠভাবে তার যে ক্যাপাসিটি আছে, সেটাকে কাজে লাগাতে পারেন, যদি সবাইকে নিয়ে চলতে চান তাহলে হয়তো এগিয়ে যাবেন। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেও তিনি যদি একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন তাহলে তিনি আগামীতে আরও ভালো করতে পারবেন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তার নেতৃত্বের জন্য তিনি মার্কিন সাময়িকী টাইমের ‘হানড্রেড নেক্সট ২০২৪’ তালিকায় স্থান পেয়েছেন। টাইমের ওই তালিকায় নাহিদ ইসলামকে লিডারশিপ ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তার সম্পর্কে মার্কিন সাময়িকীটিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে একজনকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করার জন্য ২৬ বছরের বেশি বয়স পার হতে হয়নি নাহিদ ইসলামকে।
বিশ্বজুড়ে উদীয়মান নেতা, যারা ভবিষ্যৎ গঠন করছেন এবং নেতৃত্বের পরবর্তী প্রজন্মের সংজ্ঞা নির্ধারণ করছেন, তাদের হানড্রেড নেক্সট তালিকায় রাখা হয়।
উপদেষ্টার পদ ছেড়ে নতুন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত নাহিদ ইসলামের প্রসঙ্গে সম্ভাবনার কথাই বলেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
তিনি ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অন্যতম ধারালো রাজনৈতিক মন-মানসিকতার অধিকারী নাহিদ ইসলাম। তার বয়স মাত্র ২৬ এবং ইতিমধ্যে একজন নৃশংস স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে একটি সফল অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি দেশের রাজনীতিতে আরো কয়েক দশক দরে বড় ভূমিকা পালন করবেন। আর আল্লাহ জানেন, একদিন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীও হতে পারেন।
জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি নতুন দলের ঘোষণা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম।
মঙ্গলবার সরকারি গাড়ি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় প্রবেশ করেন নাহিদ ইসলাম। সেখানে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে আসেন পায়ে হেঁটে। সরকার থেকে দায়িত্ব ছেড়েই নাহিদ বলেন, ‘লড়াই এখনো শেষ হয়নি। নতুন রূপে শুরু হচ্ছে। ’
নিজের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে নাহিদ লেখেন, জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ, যোদ্ধা ও আপামর জনগণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়ে আগস্টে সরকারে যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই স্বপ্ন কেবল সরকারের ভেতরে থেকে পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই আজ আমি সরকার থেকে বিদায় নিচ্ছি— একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি নিয়ে।