
বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিচিত তিন তরুণ নেতার পথচলা এবার নতুন মোড় নিতে যাচ্ছে। নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী, আখতার হোসেন ও হাসনাত আব্দুল্লাহ—এই তিনজন একক লড়াই থেকে বেরিয়ে এসে ২৮ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হতে যাওয়া একটি নতুন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে যুক্ত হচ্ছেন।
তারা অতীতে বিভিন্ন সময়ে এককভাবে আন্দোলন করে আলোচনায় এসেছেন। সীমান্ত হত্যা, শিক্ষাখাতে দুর্নীতি ও প্রশাসনিক অনিয়মের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদমূলক কর্মসূচি ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এবার তারা দলীয়ভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী: সীমান্ত হত্যা বন্ধের আন্দোলন
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী। সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবিতে দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করেছেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় বারবার প্রতিবাদ জানালেও কার্যকর পদক্ষেপ না আসায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে এককভাবে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
তার এই প্রতিবাদ ধীরে ধীরে সামাজিক আন্দোলনে রূপ নেয় এবং জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়।
সীমান্ত হত্যা বন্ধের দাবি থেকে শুরু করে নাগরিক অধিকার রক্ষার বৃহত্তর আন্দোলনে তিনি যুক্ত হয়েছেন। এবার নতুন রাজনৈতিক দলে তিনি রাষ্ট্রীয় নীতি সংস্কারের দাবি নিয়ে কাজ করতে চান।
আখতার হোসেন: প্রশ্নফাঁস ও শিক্ষাখাতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একক অনশন
জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ১৪তম হয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে দীর্ঘ ২৯ বছর পর অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে তিনি সমাজসেবা সম্পাদক পদে জয়লাভ করেন।
২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ‘ঘ’ ইউনিট প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে একাই অনশন করেন।
তার একক অনশনের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। গণমাধ্যমের ব্যাপক কভারেজের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ আমলে নেয় এবং পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
ছাত্র অধিকার পরিষদ থেকে বেরিয়ে এসে আখতারের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর নতুন ছাত্র সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ আত্মপ্রকাশ করে।
শিক্ষাক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই থেকেই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করছেন।
হাসনাত আব্দুল্লাহ: প্রশাসনিক অনিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। ২০২২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে প্রশাসনিক দুর্নীতি, কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য ও দীর্ঘসূত্রিতা বন্ধের দাবিতে অনশন করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজে গাফিলতির কারণে শিক্ষার্থীদের হয়রানির শিকার হতে হয়। দীর্ঘসূত্রিতা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি একক লড়াই চালিয়ে গেছেন। তার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কয়েকটি নিয়ম সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।
তিনি মনে করেন, “একটি রাষ্ট্রের উন্নতির জন্য প্রশাসনিক কাঠামোর স্বচ্ছতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি জনগণ সহজে সেবা না পায়, তবে সিস্টেমের পরিবর্তন দরকার।”
নতুন রাজনৈতিক দলে তিনি প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কার ও জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করবেন।
আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের পথে:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে, যা পরে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এর ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৮ জুলাই গঠিত ৬৫ সদস্যের সমন্বয়ক টিম ৩ আগস্ট ১৫৮ সদস্যে উন্নীত হয়।
এরপর ২২ অক্টোবর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সমন্বয়ক টিম বিলুপ্ত করে চার সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। তখনই আন্দোলনের নেতারা জানান, তাদের কার্যক্রম এখানেই থামবে না, বরং দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করা হবে।
এই লক্ষ্য নিয়েই গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতীয় নাগরিক কমিটি (জানাক) আত্মপ্রকাশ করে, যা ইতোমধ্যে দেশের প্রায় ৩০০ থানায় কমিটি গঠন করেছে। নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছে এই সংগঠন।