জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা চব্বিশের উত্তাল জুলাই আন্দোলনকে বলপ্রয়োগে দমাতে গিয়ে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনামলের চূড়ান্ত পতন ঘটে এই দিনে। আর দুঃশাসনের দায় নিয়ে বিদায় ঘটার পর এখন চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে দলটি।
৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। শুধু সভাপতিই নন, দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত সব পর্যায়ের নেতারাই হয় দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন, নয়তো আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালানোসহ টানা ১৫ বছরের শাসনামলে গুম, খুন ও বেসামাল দুর্নীতির অভিযোগে এরই মধ্যে শেখ হাসিনাসহ দলটির কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে বিচারপ্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ফলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ৬ মাসেও রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অবস্থান ও ভূমিকা এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের তৎপরতা। তবে আত্মগোপনে ও বিদেশে অবস্থান করে সামাজিকমাধ্যমে নেতাদের এমন কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন দলটির কর্মী-সমর্থকদের অনেকে। এসব ঘটনায় নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। তবে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর সম্প্রতি আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের পদত্যাগসহ বেশ কিছু দাবি সামনে রেখে লিফলেট বিতরণ, বিক্ষোভ, অবরোধ ও হরতালের মতো কয়েকটি কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়েছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেউ আওয়ামী লীগের নামে কোনো ধরনের লিফলেট বিতরণ বা কর্মসূচিতে অংশ নিলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে।
জুলাই আন্দোলনের মধ্যে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারসহ অতীতের গুম, খুন ও দুর্নীতির বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করার কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। শুধু সরকার নয়, জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে এমন মনোভাব প্রকাশ করে আসছেন। এ অবস্থায় অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছেÑ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিষ্যৎ তাহলে কোন পথে? প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছরের ইতিহাসে অনেক চড়াই-উতরাই পার হলেও এমন শোচনীয় অবস্থায় কখনও পড়তে দেখা যায়নি দলটিকে। কখনই তারা এমন নেতৃত্ব সংকটে পড়েনি, এমনকি পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পরেও না।
গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ১০ দিন পর ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে কোনো কর্মসূচি পালন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। যারা সেদিন সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল তাদের ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে প্রতিরোধ করেছে ছাত্র-জনতা। এরপর গত ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করলেও মাঠে নামতে পারেননি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এই অবস্থার মধ্যে সম্প্রতি নতুন করে আবার কর্মসূচি ঘোষণা করে গোপনে লিফলেট বিতরণ শুরু করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। লিফলেট বিতরণের সেই চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। সরকারের পক্ষ থেকেও কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ‘পতিত স্বৈরাচারের সাঙ্গপাঙ্গরা অনেক কিছু করতে চাচ্ছে। তারা লিফলেট বিতরণ করছে। তারা অনলাইনে অপতথ্য ছড়াচ্ছে। এই সরকারকে নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে। পতিত স্বৈরাচারকে প্রাইম মিনিস্টার বলছে। আমাদের কড়া বার্তা, যারা এসব লিফলেট বিতরণ করবেন, এ ধরনের কর্মসূচিতে যাবেন, তাদের গ্রেপ্তার করা হবে, আইনের আওতায় আনা হবে।’
লিফলেট বিতরণের অভিযোগে মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কর্মসূচি পালনের নামে আওয়ামী লীগ মাঠে নামার চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তারা বরাবরই বলে আসছেন, শেখ হাসিনাসহ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটিকে রাজনীতি করতে দেবেন না। এই প্রসঙ্গে সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ গণমাধ্যমে বলেন, ‘তারা যদি আবার এখানে এসে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে, কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করার চেষ্টা করে, তাহলে দেশের মানুষই তাদের প্রতিহত করবে।’
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর মামলা-হামলার ভয়ে দেশের বেশিরভাগ এলাকার আওয়ামী লীগ নেতারা গা ঢাকা দিয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা আরও অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। লিফলেট বিতরণসহ আওয়ামী লীগের হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিকে ঘিরে দলটির তৃণমূলের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে নেতৃত্বশূন্য অবস্থার মধ্যে নতুন কর্মসূচি ঘোষণার মাধ্যমে সাধারণ নেতাকর্মীদের আরেক দফা বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন তারা। অন্যদিকে ভারতে পলাতক থাকা অবস্থায় সেই দেশের মিডিয়াতে নেতাদের সাক্ষাৎকার দেওয়া নিয়েও ক্ষোভ ঝেড়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের এই ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি ভারতে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটিতে আ ক ম মোজাম্মেল হক, নাহিম রাজ্জাক, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, পঙ্কজ দেবনাথ, সাইফুজ্জামান শিখর, আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও মাহবুব-উল আলম হানিফের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে।