পেশাদারিচর্চার সন্ধানে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা
28 Sep, 2014
সম্প্রতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা সাংবাদিককে হারিয়েছি। এ বি এম মূসা, গিয়াস কামাল চৌধুরী, মাহবুবুল আলম ও বেনজির আহমেদ নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকার জন্য আমাদের কাছে তাঁরা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এই চার বিশিষ্ট সাংবাদিকের মৃত্যুতে আয়োজন করা হয় একাধিক শোকসভা। এসব শোকসভায় বক্তাদের প্রায় সবাই আমাদের সাংবাদিকতায় পেশাদারির ওপর গুরুত্ব দেন। এ বি এম মূসা ও গিয়াস কামাল চৌধুরী স্মরণে আয়োজিত এক শোকসভায় বক্তারা বলেছেন, দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকে জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিয়ে তাঁরা সাংবাদিকতা করতেন। তাঁরা সাংবাদিকতায় যে পেশাদারির চর্চা শুরু করেছিলেন, তা নতুন প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে। এসব বক্তব্যের নির্যাস হলো, বর্তমানে বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় পেশাদারিচর্চার অভাব রয়েছে।
এ বি এম মূসা ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। এই দলের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত হলেও তিনি সাংবাদিকতায় কখনো দলীয় দৃষ্টিকোণের পরিচয় দেননি। গত প্রায় ১০ বছর লেখায় এবং টিভি টক শোতে সব দলের কড়া সমালোচনা করেছেন। কাউকে ছাড় দেননি। বর্তমান সরকারের কোনো কোনো কাজের সমালোচনায় মুখর ছিলেন বলে মৃত্যুর পর সাবেক সংসদ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় প্রথা অনুযায়ী তাঁর জানাজা করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি সংসদে শোক প্রস্তাবও নেওয়া হয়নি। এতে মূসা ভাইয়ের কোনো ক্ষতি নেই, বরং জাতীয় সংসদ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে রইল।
গিয়াস কামাল চৌধুরী বিএনপির সমর্থক বলে সাংবাদিকতায় দলীয় আচরণ করেছেন- এ কথা কেউ বলতে পারবেন না। ভয়েস অব আমেরিকার ঢাকা প্রতিনিধি হিসেবে তিনি সব সময় পেশাদারি মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। ইউনিয়ন নেতা হিসেবেও সবার জন্য একই রকম সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন।
মাহবুবুল আলম সাংবাদিকতার বাইরেও দায়িত্ব পালন করেছেন। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে দীর্ঘদিন কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ২০০৬-০৭ সালে জাতির ক্রান্তিলগ্নে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তবে সাপ্তাহিক দ্য নিউ নেশন ও দ্য ডায়ালগ এবং ১৮ বছর দৈনিক দ্য ইনডিপেনডেন্টের সম্পাদক হিসেবে পেশাদারি মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন, সব সময় সফল না হলেও। ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন অমায়িক ও পরিচ্ছন্ন স্বভাবের মানুষ। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি তখন বাসসের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ডি পি বড়ুয়াকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আমি প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব নিলে আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?' প্রতিষ্ঠানে সাধারণত ধরে নেওয়া হয় প্রথম ব্যক্তি বিদায় নিলে দ্বিতীয় ব্যক্তি সেই পদ লাভ করবেন। সম্ভবত সেই ধারণার আলোকে মাহবুবুল আলম ফোন করেছিলেন ডি পি বড়ুয়াকে।
তাঁদের মাঝে সবচেয়ে নিভৃত জীবন যাপন করতেন বেনজির আহমেদ। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী বেনজির ভোরের কাগজের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও পরে সম্পাদক, সাপ্তাহিক একতার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক এবং যায়যায়দিনের নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে বরাবরই একজন নীতিমান সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মালিকের সঙ্গেও আপস করেননি। ব্যক্তি পর্যায়ে সব সময় সমাজতান্ত্রিক আদর্শ ধারণ করেছেন।
পেশাদারিচর্চার সন্ধানে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা
এই চার সাংবাদিকের বিদায় আমাদের সাংবাদিকতার জন্য স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতির কারণ। তাঁদের সঙ্গে আমি একই প্রতিষ্ঠানে কখনো কাজ করিনি। কিন্তু বিভিন্ন সময় পেশাগত কাজে যুক্ত হয়েছি। কাছ থেকে দেখেও আমার মনে হয়েছে পেশাদারিকে তাঁরা গুরুত্ব দিতেন। সাম্প্রতিক সময়ে এই দিকটারই অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। সে জন্যই স্মরণসভায় বক্তারা সাংবাদিকদের প্রতি পেশাদারিচর্চার আহ্বান জানিয়েছেন।
আসলে গত দুই দশকে মিডিয়াজগতে পুঁজিবিন্যাসে নতুন ধারা শুরু হওয়ার পর নীতিগত একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে সংবাদপত্র ও টিভি সাংবাদিকতায়। সরাসরি অথবা পরোক্ষে কিছু মিডিয়া প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে বেশি তৎপর। সাংবাদিকতা পেশার নৈতিকতা সেখানে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। সাংবাদিক ইউনিয়নের দ্বিধাবিভক্তি, সাংবাদিকতায় কোনো রকম অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্পাদক হতে পারা, একই ব্যক্তির সম্পাদক ও প্রকাশক হওয়া সাংবাদিকতায় এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য দায়ী। ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হওয়ায় পেশাজীবীদের কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের ক্যাডারের ভূমিকা পালনের সুযোগ পেয়েছেন। অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্পাদক হয়ে কেউ কেউ সিনিয়র সাংবাদিকদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে গিয়ে সংবাদপত্র ও টিভি সাংবাদিকতায় হাস্যকর পরিস্থিতি তৈরি করছেন। আর সম্পাদক-প্রকাশক একই ব্যক্তি হওয়ায় প্রতিনিয়ত আপস করছেন বাণিজ্যিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে।
এই পরিস্থিতিতে নবীন সাংবাদিকদের অনেকে দায়িত্বহীনতারও পরিচয় দিচ্ছেন। পেশাদারি মনোভাব এড়িয়ে তাঁরা কিছু সিনিয়র সাংবাদিকের ছত্রচ্ছায়ায় মালিকের তোষামোদ করে চাকরি রক্ষা করাটাই প্রধান কাজ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
একসময় স্বার্থবাদী দলীয় সিন্ডিকেটেড রিপোর্টিং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। এর প্রভাব এখনো রয়েছে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে মূসা ভাই বলেছিলেন, 'সাংবাদিকদের সাহসী হতে হবে।' এই সাহস বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টের জন্য, সত্য বলার জন্য। এটাই হলো পেশাদারি সাংবাদিকতা।
বহু বছর আগে সাংবাদিক ইউনিয়ন দাবি করেছিল ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা ছাড়া কেউ সম্পাদক হতে পারবেন না, এমন আইন করতে হবে। সে সময় মন্ত্রীরাও তাতে সায় দিয়েছিলেন ভাষণ দেওয়ার সময় (আমাদের সময়, ২২ জুন ২০০৬, অনলাইন সংস্করণ)। কিন্তু সরকার সেই দিকটি শেষ পর্যন্ত আমলে নেয়নি। সাংবাদিকরাও তা নিয়ে বড় ধরনের কোনো আন্দোলন করেননি। এর ফায়দা লুটছেন রাজনীতিক ও এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী সাংবাদিক। বিবৃতি দিয়ে ইউনিয়ন নেতারা বলেছিলেন, 'সাংবাদিকসমাজের দীর্ঘদিনের এ দাবি বাস্তবায়ন না করায় কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই শুধু মালিকানার জোরে অনেক মালিক অথবা পেশাজীবী সাংবাদিক নন এমন ব্যক্তিরা সংবাদপত্রের সম্পাদক হচ্ছেন। তাঁরা অনেকেই তাঁদের দলীয় রাজনীতি অথবা ব্যবসায়িক স্বার্থে সংবাদমাধ্যমকে এবং পেশাজীবী সাংবাদিকদের ব্যবহার ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার করছেন।' (ইত্তেফাক, ৯ জুন ২০১০, পৃ. ১)। এ কারণে সাংবাদিকতায় পেশাদারি ক্রমে অপসৃয়মাণ।
আর পেশাদারি থাকবেই বা কী করে? এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে শৃঙ্খলাহীন পেশা। এখানে যখন খুশি, যাকে খুশি যেকোনো পদে দায়িত্ব দেওয়া যায়। অর্থের জোরে সাংবাদিকতায় কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্পাদক হওয়া যায়। দেশে শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী হতে হলে নির্দিষ্ট কিছু অবশ্যপালনীয় পূর্বশর্ত রয়েছে; কিন্তু সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য কোনো নির্ধারিত নীতিমালা নেই। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারী বা প্রকাশকের ইচ্ছাটাই চূড়ান্ত বলে গণ্য হয়। সাংবাদিকতা 'ওপেন' পেশা- এমনটা ভেবে রিপোর্ট বা ফিচার লেখার ক্ষমতা রয়েছে, এটা প্রকাশক মনে করলেই একজনকে সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম বা পূর্বশর্ত মানার বাধ্যবাধকতা নেই। সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশের শর্ত তাই একটাই- নিয়োগকর্তার খুশি হওয়া। কিন্তু যুক্তি প্রদর্শনে পারদর্শী হলেও কোনো ব্যক্তি আদালতে কোনো মামলা পরিচালনা করতে পারেন না, তাঁর প্রয়োজন পড়ে ল ডিগ্রি, অ্যাডভোকেট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং বার কাউন্সিলের সনদ। বাদী কিংবা বিবাদী খুশি হলেই কাউকে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন না। সরকারি তো বটে, বেসরকারি স্কুল-কলেজেও শিক্ষকতা করতে গেলে একজনকে কিছু পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয়। সব পেশার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য, সাংবাদিকতা ছাড়া। এই বিশৃঙ্খলার কারণে মেধাবী তরুণদের অনেকে এই পেশা ছেড়ে যাচ্ছেন, অনেকে আগ্রহী হচ্ছেন না।
অভিজ্ঞতাহীন মালিক-সম্পাদকরা তথ্য-ব্যবসার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছেন সাংবাদিকতাকে। সামাজিক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া এবং ব্যক্তির প্রাইভেসি ও সম্মানের বিষয়টি না ভেবে যেকোনো তথ্য ও ছবি প্রকাশে দ্বিধা করছে না কোনো কোনো সংবাদপত্র। তারা কারো প্রাইভেসি রক্ষার ভদ্রতাটুকু পালন করছে না। টেলিভিশনও মৃত ব্যক্তির পাশে থাকা শোকাহত স্বজনকে 'অনুভূতি' প্রকাশের জন্য বাধ্য করে। রানা প্লাজার ধ্বংসাবশেষের মধ্যে জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে আটকে থাকা এক অসহায় মানুষের কাছে টিভি রিপোর্টার যখন অনুভূতি জানতে চান তখন তা সাংবাদিকতা নয়, অসহায় মানুষের কষ্ট নিয়ে প্রতিযোগিতার নামে স্রেফ তথ্য-ব্যবসা। শিশু অধিকার নিয়ে আয়োজিত এক আলোচনা বৈঠকে বক্তারা উল্লেখ করেন, সাংবাদিকরা শিশুদের নিয়ে রিপোর্ট করার সময় সংবেদনশীলতার পরিচয় দেন না। এটাও পেশাদারি সাংবাদিকতার অভাব।
সাংবাদিকতায় পেশাদারিচর্চার জন্য নিয়োগবিধি তৈরি করতে হবে। এন্ট্রি পয়েন্টে নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বীকৃত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউট থেকে সাংবাদিকতায় বুনিয়াদি কোর্স সম্পন্ন করা বাধ্যতামূলক শর্ত থাকতে হবে। বুনিয়াদি কোর্স সম্পন্ন করার সনদ ছাড়া কাউকে সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি জোর দিতে হবে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ওপর।
লেখক : সাংবাদিক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন