বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান সেনাপতি অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার আওয়ামী লীগের 'মিথসিটি' বা 'কল্পনগরে' আবার ঝড় তুলেছেন, প্রচণ্ড ঝড়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তারা বাস্তবতার চেয়ে 'মিথ' বা কল্পকাহিনীর ওপর বেশি নির্ভরশীল। সেই 'কল্পনগরের' লীগবসতি যেন খোন্দকারের 'গ্রন্থবোমায়' বিধ্বস্ত। এর আগে তিনি আরও একবার ঝড় তুলেছিলেন 'মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর' গ্রন্থটি লিখে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে গ্রন্থটি প্রকাশ করে। লেখার প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে চার বছর পর হঠাৎ যখন চতুর্দিকে হৈচৈ ওঠে তখন ২০১৩ সালে ৭ এপ্রিল 'এ কে খন্দকার রাজাকার হবেন কবে' শিরোনামে এই কলামেই একটি লেখা লিখেছিলাম। এবার বোধহয় রাজাকার হয়েই গেলেন মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকার! তার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটটা ফেরত দেওয়ার ফরমান জানি কবে জারি হয়ে যায়! 'প্রথমা' প্রকাশনী কর্তৃক অতি সম্প্রতি প্রকাশিত তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দালিলিক গ্রন্থ '১৯৭১ : ভেতরে বাইরে' প্রকাশের পর আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থক বেনিফিশিয়ারি মহলের ছটফটানি দেখে মনে হয়, এ কে খন্দকার বুঝিবা তাদের সর্বনাশ করে দিয়েছেন। সংসদের ভেতরে লীগ সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার ও সংসদ সদস্যরা এবং বাইরে শাসক লীগের নানা কিসিমের নেতা-পাতিনেতা যেভাবে অস্থির আচরণ করছেন, তা দেখে-শুনে মনে হয় প্রসঙ্গটি সহসা থামছে না, মিটছে না। জাতীয় সংসদে এ কে খন্দকারের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে তার শাস্তি দাবি করেছেন কেউ। কেউ বলেছেন, এই গ্রন্থ প্রকাশ স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র! পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এ কে খন্দকারকে দিয়ে এ গ্রন্থ লিখিয়েছে এমন কৌতূহলোদ্দীপক মন্তব্যও করেছেন প্রধানমন্ত্রীর এক ঘনিষ্ঠ আত্দীয় ও সিনিয়র নেতা-এমপি। কী এমন লিখেছেন যে, এ কে খন্দকারকে এমন হেনস্থা হতে হবে?
প্রকাশিত গ্রন্থ '১৯৭১ : ভেতরে বাইরে'র মূলত দুটি বিষয় নিয়ে একপক্ষীয় প্রশ্নবিদ্ধ সংসদে এবং বাইরে তোলপাড় করে ফেলছেন লীগ সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টার এবং '৭১ সালে যারা শিশু কিংবা বালক-বালিকা ছিলেন সেই বয়সের বিভিন্ন স্তরের নেতা-নেত্রীরাও। এক. ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন, সেই ভাষণ তিনি 'জয় বাংলার' পর 'জয় পাকিস্তান' বলে শেষ করেছিলেন এবং দুই. স্বাধীনতা যুদ্ধের কোনো দিকনির্দেশনা বঙ্গবন্ধু দিয়ে যাননি। স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটাকেই আওয়ামী লীগ দালিলিক প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করে। সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বাধীনতার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই উচ্চারণটাই আওয়ামী লীগের বড় পুঁজি। 'প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, 'তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে 'এবং' জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে, ... প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি (প্রতিষ্ঠান) গড়ে তুলুন এই আহ্বানকে তারা বলছেন দিকনির্দেশনা। বলে নেওয়া দরকার যে, আমরা বঙ্গবন্ধুর ক্যাসেটবন্দী যে ভাষণটি শুনি তা তার হুবহু ভাষণ নয়। প্রথম যখন ক্যাসেটটি বাজারজাত করা হয়, তার ওপর লেখা ছিল বক্তৃতার মূল অংশ। এ কে খন্দকার বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ শেষে জয় বাংলার পর 'জয় পাকিস্তান' বলেছেন বলে তার গ্রন্থে যে দাবি করেছেন বহুল প্রচারিত ক্যাসেটে তা নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. হাবিবুর রহমান তার 'বাংলাদেশের তারিখ' গ্রন্থের প্রথম সংস্করণে বঙ্গবন্ধু 'জয় পাকিস্তান' বলেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। যার কথা এখন অনেক লীগপন্থিও বিশ্বাস করে না, যিনি জয়নাল হাজারী সম্পর্কে বলেছিলেন যে, মিডিয়া তাকে গডফাদার বানিয়েছে- যেমন বিএনপি শাসনামলে বলা হয়েছিল যে, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি, সেই বিলাতবাসী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অবশ্য সাক্ষী দিয়েছেন যে, বিচারপতি হাবিবুর রহমান নাকি তাকে বলেছেন, তিনি ৩ জানুয়ারি আর ৭ মার্চের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছিলেন বয়সের ভারে, স্মৃতিভ্রমের কারণে। বয়সের কারণে ১৯৯৮-৯৯ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমান স্মৃতিভ্রমের শিকার ছিলেন এটা কারও জানা নেই। খন্দকার সাহেবের গ্রন্থে উলি্লখিত স্লোগান নিয়ে জনমত এখন শার্পলি বিভক্ত। লীগ সরকার এ ব্যাপারে কেন এভাবে রি-অ্যাক্ট করল বুঝতে পারি না। সরকারপক্ষের লোকজন এবং তাদের, বিশেষ করে তাদের দলের মালিকানায় যে সব প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া আছে তারা বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেননি তা প্রমাণের জন্য যেভাবে ঘুম হারাম করে এর পেছনে, ওর পেছনে ছুটছে তাতে জনমনে কৌতূহল আরও বেড়ে যাচ্ছে।
তোফায়েল আহমেদ, আমীর হোসেন আমু, শেখ সেলিম, সরকারি জাসদ নেতারা এমনকি সরকারি ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন এবং লীগ সরকারের সমর্থক ও বিভিন্ন সরকারি পদ লাভকারী বেনিফিশিয়ারি শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য সরকারের কোনো উপকারে আসছে না। এরা সত্য-মিথ্যা যাই হোক সরকারি কলের গানই তো বাজাবেন। টিভি পর্দায় চেহারা দেখলেই মানুষ আগে থেকে বলে দিতে পারে কে সরকারের দালাল। পরিস্থিতিটা এখন একেবারেই সাংঘর্ষিক পর্যায়ে। সরকারপক্ষ বলছে- না, বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান বলেননি। বিএনপি সরাসরি কিছু না বলে আকারে-ইশারায় বোঝাতে চাইছে, হ্যাঁ, তিনি বলেছেন। এ কে খন্দকার তো বইয়ে লিখেই দিয়েছেন এবং এখন পর্যন্ত তিনি তার অবস্থানে অটল। পঞ্চাশের নিচে যাদের বয়স তারা কনফিউজড।
তবে বিষয়টি নিয়ে লীগ সরকারের রুদ্রমূর্তি ধারণের কোনো প্রয়োজন কী ছিল? বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথোপকথন উল্লেখ করে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বিচারপতি রহমানের ৩ জানুয়ারি ও ৭ মার্চের মধ্যে গুলিয়ে ফেলার কথা বলেছেন। ৩ জানুয়ারি ও ৭ মার্চের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ২ মাস ৪ দিনের। ৩ জানুয়ারি ও ৭ মার্চের ঘটনা একটি আরেকটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই ৩ জানুয়ারি উচ্চারিত স্লোগান ৭ মার্চেও উচ্চারণে দোষের কিছু দেখি না। ৩ জানুয়ারি ১৯৭১ সম্পর্কে পাঠকদের, বিশেষ করে পঞ্চাশ-নিম্ন বয়সের পাঠকদের একটা ধারণা থাকা ভালো। সেদিন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের দলীয় শপথ গ্রহণের দিন ছিল। পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধু দলীয় এম,এন,এ,এমপিএদের শপথ পড়িয়েছিলেন। শপথ নামাটি ছিল সুলিখিত। তোফায়েল আহমেদ, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ সবাই ওই শপথনামায় লিখিত জয় বাংলার সঙ্গে 'জয় পাকিস্তান' স্লোগানটিও পাঠ করেছিলেন। জনাব অলি আহাদের প্রামাণ্য ও অবিতর্কিত রাজনৈতিক গ্রন্থ 'জাতীয় রাজনীতি : ১৯৪৫ থেকে ৭৫'-এর ৩৮৮ পৃষ্ঠায় শপথনামাটির হুবহু উল্লেখ আছে। শপথনামার শেষে লেখা ছিল জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান। লেখক উল্লেখ করেন, "এই অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় ভাষণ সমাপনান্তে 'জয় বাংলা' ও 'জয় পাকিস্তান' ধ্বনি দ্বারা বাঙালির দাবি-দাওয়া আদায়ের অঙ্গীকার ঘোষণা করেন।" এই শপথনামার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ তাৎপর্যপূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট। ৮ মার্চ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রধান শিরোনাম ছিল : সংসদে যাওয়ার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর চার দফা। অলি আহাদ তার উলি্লখিত গ্রন্থের ৪০৩ পৃষ্ঠায় দফা বা শর্তগুলো উল্লেখ করেন : (ক) সামরিক আইন প্রত্যাহার করিতে হইবে, (খ) সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে হইবে, (গ) হত্যার তদন্ত করিতে হইবে, (ঘ) জনপ্রতিনিধিগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে হইবে।' পাঠক, এটা তো বোঝা কারও জন্য কষ্টকর নয় যে, দাবি বা শর্তগুলো উত্থাপন করা হয়েছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। কাজেই সেই সভায় জয় বাংলার পর বঙ্গবন্ধু যদি 'জয় পাকিস্তান' বলেছেন বলে ইতিহাসের সাক্ষ্য বেরিয়ে আসে, তাহলে কী বঙ্গবন্ধু 'হাবিয়া দোজখে' চলে যাবেন? বঙ্গবন্ধুর গগনচুম্বী ভাবমূর্তি কী এতটুকুও টলবে? না, নিশ্চয়ই না। যখন পরিস্থিতিটা পাকিস্তানিদের সঙ্গে সমঝোতা সংলাপের পর্যায়ে, ১৫ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো সংলাপ হয়েছেও; সেই রাজনৈতিক বাস্তবতায় কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে বঙ্গবন্ধু বা অন্য কোনো বাঙালি নেতা জয় পাকিস্তান স্লোগান দিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার গৌরব ক্ষুণ্ন বা ম্লান হয় না। ১৯৭১ সালের ৮ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানসহ পৃথিবীর কোনো সংবাদ মাধ্যম এমন কথা বলেনি যে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বা যুদ্ধ শুরু করার হুকুম দিয়েছেন। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি। বঙ্গবন্ধুর রণকৌশল বুঝতে হবে। তিনি যার যা কিছু আছে তা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বলেছেন- সেটা স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকনির্দেশনা ছিল বলে মনে করেননি এ কে খন্দকার। আওয়ামী লীগের তখনকার দ্বিতীয় প্রধান নেতা হিসেবে সাধারণ্যে বিবেচিত শহীদ তাজউদ্দীন আহমদও তা-ই বলেছেন। এ ব্যাপারে আমরা তাজউদ্দীন আহমদের শরণাপন্ন হতে চাই। তার মতো উদ্ধৃত করছি তার কন্যা শারমিন আহমেদের লেখা 'তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা' গ্রন্থ থেকে।
"পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চের ভয়াল কালরাতে আব্বু গেলেন মুজিব কাকুকে নিতে। মুজিব কাকু আব্বুর সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন সেই ব্যাপারে আব্বু মুজিব কাকুর সাথে আলোচনা করেছিলেন। মুজিব কাকু সে ব্যাপারে সম্মতিও দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী আত্দগোপনের জন্য পুরান ঢাকায় একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল। বড় কোনো সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আব্বুর উপদেশ গ্রহণে মুজিব কাকু এর আগে দ্বিধা করেননি। আব্বুর সে কারণে বিশ্বাস ছিল যে, ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে মুজিব কাকু কথা রাখবেন। মুজিব কাকু আব্বুর সাথেই যাবেন। অথচ শেষ মুহূর্তে মুজিব কাকু অনড় রয়ে গেলেন। আব্বু বিস্ময় ও বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। ... তিনি বললেন, 'মুজিব ভাই, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হলেন আপনি। আপনার নেতৃত্বের ওপরই তারা সম্পূর্ণ ভরসা করে রয়েছে।' মুজিব কাকু বললেন, 'তোমরা যা করবার কর। আমি কোথাও যাব না।' আব্বু বললেন, 'আপনার অবর্তমানে দ্বিতীয় কে নেতৃত্ব দেবে এমন ঘোষণা তো আপনি দিয়ে যাননি। নেতার অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি কে হবে, দলকে তো তা জানানো হয়নি। ফলে দ্বিতীয় কারো নেতৃত্ব প্রদান দুরূহ হবে এবং মুক্তিযুদ্ধকে এক অনিশ্চিত ও জটিল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।"
'... পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আব্বু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে এসেছিলেন এবং টেপ রেকর্ডারও নিয়ে এসেছিলেন। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর প্রদানে মুজিব কাকু অস্বীকৃতি জানান। আব্বু বলেছিলেন, 'মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে, কারণ কালকে কী হবে, আমাদের সবাইকে যদি গ্রেফতার করে নিয়ে যায়, তাহলে কেউ জানবে না, কী তাদের করতে হবে।
(তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা গ্রন্থের পৃষ্ঠা-৫৯, ৬০ ও ৬২)
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামও প্রায় একই কথা বলেছেন। "... আমাদের একটা সিক্রেট প্ল্যান ছিল যে, যখনই মিলিটারি টেক ওভার হবে তাজউদ্দীন ভাই, কামাল হোসেন ও আমি একত্রিত হব এবং নেঙ্ট কী করব সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। কনটিনজেনসি প্ল্যান নিয়ে আমরা আলোচনা করতাম। বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাদের এ পরিকল্পনার বিষয়টি নিয়ে কথা বলা জরুরি মনে করি। তাজউদ্দীন ভাই দুদিন আমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন আমাদের কনটিনজেনসি প্ল্যানের জন্য। বঙ্গবন্ধু ডাইরেকটিভ দিলেন না। বললেন, এখন দেশ স্বাধীন হবে। তোমরা নিশ্চিন্ত থাক। ... কিন্তু পরবর্তীতে আমরা কী করব সে সম্বন্ধে কোন নির্দেশ দিলেন না।" (তাজউদ্দীন আহমদ : নেতা ও পিতা গ্রন্থে আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার, পৃষ্ঠা-২৬৩-২৬৪)
৬ সেপ্টেম্বর 'তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবন' শীর্ষক এক আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও প্রায় একই মন্তব্য করে বলেন, 'তাজউদ্দীন একটি লিখিত বিবৃতি ও বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর রেকর্ড করতে একটি টেপরেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাক্ষরও পেলেন না, কণ্ঠস্বরও পেলেন না।'
পাঠক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্যে, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মন্তব্যে এবং ৬ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা সম্পর্কে যা উঠে এসেছে তা থেকে এ কে খন্দকারের এ সম্পর্কিত বক্তব্য কী ভিন্ন বলে মনে হয়?
শেষ করতে চাই আবার ওই স্লোগান প্রসঙ্গ দিয়ে। সরকার পক্ষ প্রাণপাত চেষ্টা করছে এ কে খন্দকারের বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণ করতে। একে-ওকে দিয়ে বলাচ্ছেন- না, বঙ্গবন্ধু 'জয় পাকিস্তান' বলেননি। কারা বলছেন? হয় শাসক লীগের লোক, নতুবা লীগ সরকারের বেনিফিশিয়ারি। অপরদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধীরা পক্ষ নিয়েছেন এ কে খন্দকারের। বিষয়টি এখন বাকযুদ্ধের মাধ্যমে ফায়সালার পর্যায়ে নেই। এখন চাই দালিলিক প্রমাণ। ঐতিহাসিক সেই ভাষণের একেবারে 'র' কপিটি কী জোগাড় করা যায় না? এ কে খন্দকার এবং তার বক্তব্যের সমর্থকদের তা জোগাড় যে করতেই হবে। এ কে খন্দকারের বইটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। 'হাওয়া' হয়ে গেল কেন বুঝতে পারছি না। বইটির ওপর যা বলছি তা পত্রপত্রিকায় যেটুকু দেখেছি এবং 'সংসদ' অধিবেশনে যা দেখেছি-শুনেছি তার ওপর ভিত্তি করেই। ১০ সেপ্টেম্বর জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনে 'এ কে খন্দকার : ভেতরে বাইরে' শিরোনামে একটি সুচিন্তিত লেখা লিখেছেন। সুলিখিতও বটে। লেখাটি পড়ে আমার মতো তার অগণিত পাঠক তৃপ্ত। আমার লেখার যে সামান্য কজন নিয়মিত পাঠক আছেন তাদের আমি এ প্রসঙ্গে কী বলি? মাহমুদুর রহমান মান্না ফেসবুকের পোস্টিং থেকে তার বক্তব্যের স্বপক্ষে কয়েকটি সূত্রের উল্লেখ করেছেন। সেগুলো ছিল- ১. কবি শামসুর রাহমানের 'কালের ধূলোয় লেখা' বই। ২. নির্মল সেনের 'আমার জীবনে ৭১-এর যুদ্ধ'। ৩. সেক্টর কমান্ডার কাজী নূরুজ্জামান-এর Remembers of Bangladesh liberation war ১৯৭১। ৪. আহমদ ছফার প্রবন্ধ সংকলন থেকে সলিমুল্লাহ খানের সম্পাদনায় 'বেহাত বিপ্লব ১৯৭১' বই। ৫. যুগান্তর পত্রিকার ৭ মার্চ ২০১১ তারিখে আতাউস সামাদের লেখা 'যেভাবে আমরা পেলাম দিনটি' কলাম। ৬. বদরুদ্দিন উমরের লেখা 'আমার জীবন (তৃতীয় খণ্ড) ও ৭. সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হাবিবুর রহমানের 'বাংলাদেশের তারিখ' নামক বইয়ের প্রথম সংস্করণ।' তিনি অবশ্য মন্তব্য করেছেন যে, উদাহরণগুলোর সত্যাসত্য যাচাইয়ে সময় তিনি পাননি। তবে এর কয়েকটা নিয়ে যে বিতর্ক হয়েছে তা উল্লেখ করেছেন। কবি শামসুর রাহমানের 'কালের ধুলোয় লেখা' বইয়ের মন্তব্যটি পেয়েছি। তাতে তিনি লিখেছেন, '... বঙ্গবন্ধু এই বলে তাঁর ভাষণ শেষ করেন, ... রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- জয়বাংলা। জয় পাকিস্তান।' অলি আহাদ সাহেবের 'জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫' বইয়ের কোথাও লেখায় উল্লেখ আছে। বইটি আমি পড়েছি। না, তাতে ৭ মার্চের ভাষণে 'জয় পাকিস্তান' উল্লেখ নেই। এখন যে ভাষণটি সর্বত্র শোনা যায় বইতে তা-ই আছে হুবহু। তবে ৩ জানুয়ারি শপথনামায় 'জয় পাকিস্তান' উল্লেখ আছে- যা বইয়ে সনি্নবেশিত রয়েছে। আমিও জনাব মান্নার সঙ্গে একমত, সত্যের অনুসন্ধান চলুক না।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন