অনিয়ম বন্ধ না হলে নৌ দুর্ঘটনা বন্ধ হবে না
24 Aug, 2014
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ভারত ও মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা অতিক্রম করে ৫৬টি অভিন্ন নদী বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এসব নদী অসংখ্য শাখা নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ের সঙ্গে যুক্ত। দক্ষিণাঞ্চলের ৬টি জেলা- ভোলা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ঝালকাঠি ও বরিশালের সঙ্গে ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, শরীয়তপুর ও খুলনা জেলায় সড়ক পথে যেতে হলে একাধিক ফেরির সাহায্যের প্রয়োজন হয়। একইভাবে বৃহত্তর ফরিদপুর, খুলনা, যশোর ও কুষ্টিয়ার জেলাগুলোয় যেতে হলেও ফেরি পারাপার প্রয়োজন। চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ থাকলেও এ দুটি জেলা থেকে রাজধানীতে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে লঞ্চযাত্রায় অনেকে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমুদ্র পথ ও নদীপথে যাত্রাকে সবচেয়ে নিরাপদ ভাবা হয় এবং অন্যান্য দেশে সমুদ্র পথ ও নদীপথে চলাচলের সময় দুর্ঘটনার হার চলাচলের অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় তুলনামূলক কম। পাশ্চাত্যের এক দেশ থেকে অপর দেশে বিলাসবহুল জাহাজে ভ্রমণ জনপ্রিয় ও আনন্দদায়ক হওয়ায় সারা বছরই সমুদ্র ও নৌপথে এসব দেশের নাগরিকরা এক দেশ থেকে অপর দেশে এবং নিজ দেশের এক স্থান থেকে অপর স্থানে ভ্রমণ করে থাকে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদীবন্দরগুলোতে যেসব যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী লঞ্চ এবং বিভিন্ন আকৃতির অন্যান্য জলযান চলাচল করে, এসব জলযানের চলাচল যেন নির্বিঘ্নে হয় তা দেখভালের জন্য সরকারের বেশ কয়েকটি বিভাগ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হল অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সংস্থা, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর, নৌ বাণিজ্য অধিদফতর ইত্যাদি। একটি লঞ্চ চলাচল উপযোগী কি-না সে বিষয়ে প্রতি বছর সরকারি সংস্থা থেকে লঞ্চ মালিকদের প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ করতে হয়। তাছাড়া একটি লঞ্চে কত যাত্রী ভ্রমণ করতে পারবে এবং কী পরিমাণ পণ্য পরিবহন করা যাবে তা নির্ধারিত করে দেয়া থাকে। বিভিন্ন টার্মিনাল থেকে লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে টার্মিনালে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তার অনুমোদন গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। বিভিন্ন জেলায় যাতায়াতের জন্য যে সংখ্যক লঞ্চের প্রয়োজন, সাধারণ অবস্থায় লঞ্চের সংখ্যা তার চেয়ে বেশি হওয়ায় লঞ্চ মালিকদের সমিতি প্রতিদিন কোন টার্মিনাল থেকে কয়টি লঞ্চ ছেড়ে যাবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। প্রায়ই দেখা যায়, অধিক লাভের আশায় অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্য নিয়ে লঞ্চগুলো চলাচল করছে। এটি তখনই সম্ভব হয়, যখন মালিকপক্ষ যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে শুধু বেশি লাভের আশায় ইচ্ছাকৃতভাবে কিছুসংখ্যক লঞ্চকে বসিয়ে রাখে।
ঢাকা শহরে প্রায় দুই কোটি লোক বসবাস করে। ঢাকার প্রায় অর্ধেক অধিবাসী প্রতি বছর দুটি ঈদের সময় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বাবা-মা, ভাই-বোন বা আÍীয়-স্বজনের সঙ্গে উৎসব উদযাপন করে থাকে। তাদের অনেকে সড়ক পথে রেল ও বাসে যাতায়াত করে থাকে, আবার অনেকে নৌপথে লঞ্চে যাতায়াত করে। এ সময় যানবাহনে আসনের তুলনায় যাত্রীসংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতিটি যানবাহনেই অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করা হয়। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের ব্যাপারে সতর্ক বার্তা দেয়া হয়, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের কার্যক্রমগুলো চলে।
প্রতিটি ঈদ উৎসবের সময় অধিক যাত্রী হওয়ার অর্থ অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে অধিকসংখ্যক যানবাহনের চলাচল। এভাবে যাত্রী নিয়ে সড়ক পথে বাস ও নৌপথে লঞ্চ চালাতে গিয়ে প্রতিবছরই দুর্ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। সড়ক পথে দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় নিহত ব্যক্তির পরিবারকে সরকার বা দুর্ঘটনাকবলিত বাস মালিক কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ প্রদান করেন না। লঞ্চ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে নিকট অতীতেও সরকার বা লঞ্চ মালিকদের সংগঠনের পক্ষ থেকে নিহত ও আহতের পরিবারকে কোনোরূপ ক্ষতিপূরণ দেয়া হতো না। বিগত দুয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে লাশ দাফন ও ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু অর্থ প্রদান করা হলেও লঞ্চ মালিকদের সংগঠন সেভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদানে এগিয়ে আসছে না।
স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত বিভিন্ন লঞ্চ দুর্ঘটনায় ১২ হাজারের কাছাকাছি যাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের খুব অল্পসংখ্যকই সরকারের পক্ষ থেকে যৎসামান্য ক্ষতিপূরণ লাভ করেছেন। লঞ্চ দুর্ঘটনায় যে ১২ হাজার যাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের অধিকাংশের মৃত্যুর জন্য কর্তৃপক্ষের অবহেলাই দায়ী। আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ হলে কোন ধরনের লঞ্চ চলাচল করতে পারবে এবং কোন ধরনের লঞ্চ চলাচল করতে পারবে না সে বিষয়ে বিধিবিধান রয়েছে। কিন্তু এ বিধিবিধান প্রতিপালনে বিভিন্ন টার্মিনালে সরকারের যে কর্মকর্তা রয়েছে, অন্যায়ভাবে তার পকেট পূর্ণ হলে কোনো বিধিবিধানের আর বালাই থাকে না। সরকারের পক্ষ থেকে লঞ্চে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং ত্র“টিপূর্ণ ও সনদবিহীন লঞ্চ চলাচল নিষিদ্ধ বিষয়ে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করা হলে লঞ্চ দুর্ঘটনা কমিয়ে বা শূন্যে নিয়ে আসা সম্ভব। কিন্তু সর্ষের ভেতর ভূত থাকলে অর্থাৎ এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দুর্নীতিগ্রস্ত হলে দুর্ঘটনা কমবে না বরং বেড়েই চলবে। প্রতিটি লঞ্চ দুর্ঘটনার পরই দেখা যায়, সরকারের পক্ষ থেকে এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু তদন্তের পর কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী হিসেবে যাদের চিহ্নিত করে থাকে, বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, তাদের কারও বিরুদ্ধে কখনও কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
বিভিন্ন লঞ্চ দুর্ঘটনায় দেখা গেছে, দুর্ঘটনার পর লাশ উদ্ধারে নিহতদের পরিবার ও দেশের সাধারণ জনমানুষ যতটুকু তৎপর ও আন্তরিক, সরকারের বিভিন্ন সংস্থার লোকজন ততটা তৎপর ও আন্তরিক নয়। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীদের পরিবার ও জনসাধারণের প্রচুর অভিযোগ ও অনুযোগ রয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা বা রেল দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হলে তাৎক্ষণিকভাবে লাশ উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব; কিন্তু লঞ্চ নিমজ্জিত হলে এমনও দেখা গেছে দুর্ঘটনাস্থলের ২০-২৫ মাইল ভাটি থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তাছাড়া নিমজ্জিত লঞ্চ উদ্ধারে সময়ক্ষেপণ হলে লাশের চেহারা বিকৃতির কারণে অনেক সময় অনেক লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। লঞ্চ দুর্ঘটনায় যে কোনো পরিবারের সদস্য নিহত হলে পরিবারটিকে লাশ ফেরত পেতে অনেক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়। আর লাশ যদি ফেরত পাওয়া না যায়, সেক্ষেত্রে ভাগ্যাহত পরিবারটিকে অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটাতে হয়।
বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক ও রেলপথে যে সংখ্যক যাত্রী চলাচল করে, সে তুলনায় নৌপথে যাত্রী চলাচল করে কম। কিন্তু প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় যে হারে লোক মারা যায়, তা নৌপথে যাত্রীসংখ্যার তুলনায় বিবেচনায় নিলে নৌ দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রায় সমান বা সামান্য বেশি। দেশের এ পর্যন্ত একশর কাছাকাছি নৌ দুর্ঘটনায় বেশ কয়েক সহস যাত্রী নিহত হয়েছে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর নিহতের স্বজনদের লাশ উদ্ধারে দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি অবস্থান করতে দেখা যায়। অবস্থানস্থল প্রত্যন্ত ও দুর্গম হলে নিহতের স্বজনদের ভোগান্তির অন্ত থাকে না। এসব স্বজনকে নিজ উদ্যোগেই থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। নৌদুর্ঘটনায় নিহতের স্বজনরা খুব কম ক্ষেত্রেই আশপাশের গ্রামের লোকজন থেকে থাকা ও খাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য পেয়ে থাকেন।
২০১২ সালে ঢাকা শহরের সন্নিকটে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১২ শতাধিক লোক নিহত হলে উদ্ধার অভিযানে প্রায় ৩ সপ্তাহ লেগে যায়। এ সময় নিহতের স্বজনদের প্রতি বিভিন্ন সংগঠন থাকা ও খাওয়ার ব্যাপারে সাহায্যের হাত প্রশস্ত করে। জনসাধারণের পক্ষ থেকে এ ধরনের সাহায্য মহতী উদ্যোগ। রানা প্লাজাসহ বিগত ৫-৭ বছরে পোশাক শিল্পে দুর্ঘটনার কারণে যেসব শ্রমিক নিহত হয়েছেন, তাদের সরকার ও পোশাক শিল্প মালিকরা ছাড়াও দেশী ও বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাহায্য করেছে। যদিও কোনো সাহায্য ও ক্ষতিপূরণই অর্থ দ্বারা পরিমাপ্য নয়, তবুও আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে পোশাক কারখানার দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কারণে নিহতের পরিবার সামগ্রিকভাবে যে অর্থ সাহায্য পাচ্ছে, সে তুলনায় লঞ্চ দুর্ঘটনায় বা সড়ক পথে যারা নিহত হচ্ছেন, তাদের প্রাপ্তি সামান্য বা ক্ষেত্র বিশেষে শূন্য।
পোশাক কারখানার দুর্ঘটনায় নিহতদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন নিহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ের ব্যাপারে সোচ্চার। তাছাড়া পোশাক কারখানায় দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়া না হলে অন্যান্য কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করতে পারে এ আশংকায় সরকারও সব সময় সাধ্য মাফিক ক্ষতিপূরণ দিয়ে পরিস্থিতি অনুকূলে রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকে।
লঞ্চ দুর্ঘটনায় নিহতদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। তাই পোশাক কারখানার ক্ষেত্রে নিহত ও আহত সবাই একই পেশাভুক্ত হওয়ায় যেমন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও অন্যান্য কারখানার শ্রমিকরা এগিয়ে আসে, এদের ক্ষেত্রে সেটি পরিলক্ষিত হয় না।
আমাদের দেশে নৌদুর্ঘটনাসহ সড়ক, রেল ও পোশাক কারখানায় দুর্ঘটনায় যে হারে লোকজন নিহত হয়, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এভাবে নিহত হওয়ার নজির বিরল। কিন্তু অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হল, সেসব দেশে এ ধরনের দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও তিনি দুর্ঘটনা রোধে ব্যর্থতার দায় নিজ কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করেন। আমাদের দেশে প্রতিটি দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন দল ও জনগণের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রীদের ব্যর্থতার দায়ে পদত্যাগ দাবি করা হলেও এর প্রতি তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই বরং তারা গর্বভরে বলেন, আমরা কেন পদত্যাগ করব?
আমাদের দেশে নৌপথে যেসব লঞ্চ দুর্ঘটনা হচ্ছে, এর জন্য লঞ্চ মালিক ও সরকারের বিভিন্ন বিভাগের লোকজন সমভাবে দায়ী। উভয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলে দুর্ঘটনা রোধ সম্পূর্ণরূপে সম্ভব না হলেও সীমিত পর্যায়ে যে নিয়ে আসা সম্ভব, এ বিষয়ে বোধকরি কারও দ্বিমত নেই। আর যতদিন লঞ্চ মালিক এবং লঞ্চ চলাচলের সঙ্গে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের পথ খোলা থাকবে, ততদিন লঞ্চ দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে না।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন