|
জসিম উদ্দিন
|
|
আন্তর্জাতিক সমর্থনে হত্যার উৎসব
17 Jul, 2014
গাজায় জনবসতির ওপর নারকীয় বোমা হামলার জন্য ফুটবল উত্তেজনার সময়টি বেছে নেয়া হয়। ফুটবলে ঘুম পাড়িয়ে গণনিধনে নামে নেতানিয়াহুর শত শত জঙ্গিবিমান। তিন ইসরাইলি কিশোর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি এক মাস আগের। এ ঘটনায় একজন ফিলিস্তিনি কিশোরও প্রাণ হারায়। ঠিক এ সময় ওই ঘটনাটিকে ছুতো হিসেবে ব্যবহার করা একটি অজুহাত খুঁজে নেয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। হামাস শাসিত গাজার জনপদকে নিঃশেষ করাই এ হামলার প্রধান লক্ষ্য। কারণ এ অঞ্চলটির নাগরিকেরা এমন একটা কর্তৃপক্ষকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে বাছাই করেছে যাদের বড় অপছন্দ করে ইসরাইল।
তিন কিশোর হত্যায় হামাস জড়িত, এমন কোনো যোগসূত্র দেখাতে পারেনি নেতানিয়াহু সরকার। ইসরাইলি মিডিয়া এ নিয়ে কোনো তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি। তবু সরকার ও মিডিয়া যৌথভাবে বিকারগ্রস্ত এক উন্মাদ প্রচারণা চালায় হামাসের বিরুদ্ধে। ইসরাইলের নাগরিক নিরাপত্তার অজুহাত তুলে হামলার ক্ষেত্র তৈরি করে তখনই গণহারে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের শাস্তি দেয়। হামাসকে সহযোগিতার অভিযোগে কয়েক শ’ ফিলিস্তিনিকে কারাবন্দী করে। সন্দেহভাজনদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেয় ও ছয়জনকে হত্যা করে। পুরো শহর অবরুদ্ধ করে রেখে গাজায় বিমান হামলা চালায়। সে ঘটনায় দু’জন জড়িত ছিল। তাদের সাথে হামাসের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের লক্ষ্য ছিল কয়েকজন কারাবন্দীকে মুক্ত করা। অপহরণ করা ইসরাইলি কিশোরদের বিনিময়ে তা হাসিল করার পরিকল্পনা করেছিল তারা। ঠিক এ ঘটনাটিকে কাজে লাগানো হয়েছে হামাসবিরোধী প্রচারণার কাজে। এর চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে পুরো গাজা উপত্যকায় নেমে এসেছে গণহত্যা। ইসরাইলি কিশোরদের হত্যার প্রতিশোধ নয় বরং এটিকে একটা ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হলো।
কিশোর হত্যার ঘটনাটি ওখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। সম্প্রতি ফাতাহ ও হামাস নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। ঠিক এই সময়ে আগের ঘটনাটিকে টেনে আনা হলো, যে ঘটনার সাথে গাজার নেতৃত্বের দূরতম সম্পর্কও নেই। গাজার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ধ্বংস করা এ হামলার প্রধান লক্ষ্য।
হামলার সপ্তম দিন পর্যন্ত এক হাজার ২৬০ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। হামাস প্রায় ৮০০ রকেট নিক্ষেপ করেছে। ইসরাইলের কামানবিধ্বংসী নিরাপত্তাব্যবস্থা এগুলোকে আকাশেই ধ্বংস করে দিয়েছে। এ সময় তিনজন ইসরাইলি আহত হন। তাদের আহত হওয়ার সাথে হামাসের রকেট হামলার কোনো সম্পর্ক নেই। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালানোর সময় ওই তিনজন আহত হন। আহতের তুলনা হচ্ছে তিন অনুপাত ১২৬০। একজন ইসরাইলি আহত হওয়ার বিপরীতে ৪২০ জন ফিলিস্তিনিকে আহত করা হয়েছে। আহত ফিলিস্তিনিদের বেশির ভাগই গুরুতর জখম হয়েছেন বোমার আঘাতে। নিহতের কোনো ঘটনা নেই ইসরাইলিদের মধ্যে। অন্য দিকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৯২ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। ১৯২ জন এর বিপরীতে শূন্যের অনুপাত করলে সংখ্যার বিচারে সেটা অসীম হয়ে যায়। ২০১২ সালে ঠিক একই ধরনের সংখ্যানুপাতে ফিলিস্তিনিরা গণহারে প্রাণ দিয়েছেন। পরের প্রতিটি আক্রমণ আগেরটির চেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে। আগের সব ভয়াবহতাকে এবারের হামলার ভয়াবহতা ছাড়িয়ে গেছে।
হামলার ব্যাপকতা এত বেশি যে, কোনো জায়গা এখন আর নিরাপদ নয়। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে বিবিসি জানাচ্ছে, গাজায় ভয়ানক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। পুরো গাজা একটি ধ্বংসস্তূপ। সেখানে সর্বত্র আগুন জ্বলছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দূত যুক্তরাজ্য থেকে জানাচ্ছেন, এমন একটু জায়গায়ও অবশিষ্ট নেই যেখানে কেউ লুকাতে পারে। নেই কোনো আশ্রয়, নেই কোনো বাঙ্কার, আক্রান্ত বাড়িঘরগুলোতে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে থাকছেন তারা। বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় এলেই সরাসরি আক্রমণে প্রাণ হারানোর আশঙ্কা বেশি। এ অবস্থায় ইসরাইলি সেনাবাহিনী লিফলেট ছড়িয়ে বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়ার জন্য উত্তর গাজাবাসীকে হুমকি দিয়েছে। তাদের লিফলেটের ভাষাও ভয়ঙ্কর। বিমান থেকে ছুড়ে ফেলা লিফলেটে লেখা রয়েছে, ‘দ্রুত যারা বাড়িঘর ছাড়তে ব্যর্থ হবে, সেসব ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়বে। সাবধান!’ ওই এলাকায় প্রায় এ লাখ লোকের বসবাস। পুরো গাজার জন্য জাতিসঙ্ঘের যে উদ্বাস্তু শিবির স্থাপন করেছে, তাতে সর্বাধিক ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।
গাজায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যারা বেঁচে আছেন তারা পড়ছেন মহাবিপদের মধ্যে। অব্যাহত হামলায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পানির কূপ ও সরবরাহ লাইন ধ্বংস হয়ে পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে বেশির ভাগ এলাকায়। পুরো শহর ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। হাসপাতালের জ্বালানিও কয়েক দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। জরুরি অপারেশনও আর করা যাবে না। অর্থাৎ গুরুতর আহতরা জরুরি চিকিৎসার অভাবে প্রাণ দেবেন।
গত ছয় বছরের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো ইসরাইল গাজার নাগরিকদের ওপর এভাবে হামলা চালাল। ভারী অস্ত্র, বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে এক লাখ ৭০ হাজার নাগরিকের গাজা শহরে। তারা সঙ্ঘবদ্ধ কোনো সামরিক শক্তি নয়, নিরপরাধ একটি বেসামরিক জনসমাজ। যাদের কোনো শক্তিশালী সেনাবাহিনী নেই, নেই অস্ত্রশস্ত্র, তাদের ওপর চালানো হলো পুরো দস্তুর সামরিক আক্রমণ। দানবীয় হত্যালীলার বাস্তবতা এড়িয়ে গিয়ে পশ্চিমা কূটনীতিক মহল এবং মূলধারার সংবাদমাধ্যম বরাবরের মতো নগ্নভাবে ইসরাইলের পক্ষ নিয়েছে। বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সামরিক হামলা, জাতিসঙ্ঘ চার্টার অনুযায়ী আগ্রাসন, যা মৌলিক আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিবিরোধী। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুন থেকে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা পর্যন্ত সবাই জোর দিয়ে বলছেন, হামাসকে অবশ্যই রকেট হামলা বন্ধ করতে হবে। অথচ ইসরাইলের প্রতি সম্মান দেখিয়ে অনুরোধ করা হচ্ছে ‘সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের’। ইসরাইলি হামলায় প্রায় ২০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন এক হাজারেরও বেশি বেসামরিক ব্যক্তি। অন্য দিকে হামাসের নিক্ষিপ্ত রকেটে এখন পর্যন্ত একটি হতাহতের ঘটনা নেই। গাজা যখন আগুনে জ্বলছে, জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ একটি প্রস্তাবের ভাষা কী হবে তা নিয়ে বিতর্ক করছে। রোম যখন পুড়ছে নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল। নিরাপত্তা পরিষদ যাতে কোনোভাবে নিন্দা প্রস্তাব আনতে না পারে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল জুটি সেটা নিশ্চিত করেছে। ‘প্রত্যেকটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নিজেদের রক্ষা করার অধিকার রয়েছে।’ এ ধরনের লাইন সংযুক্তি বিষয়ও মেনে নিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। এই টানাপড়েনে একটি বিবৃতিও দিতে পারেনি নিরাপত্তা পরিষদ।
সরলভাবে বললে বলতে হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরাইলের এ পৈশাচিক বর্বরতায় বরাবরের মতো সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলতে সারা বিশ্বের মানুষ এমনটি মনে করলে ভুল হবে। বিশ্বব্যাপী মানুষেরা এ ধরনের বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছেন এবারো। কিন্তু ঘাড়ের ওপর চড়ে বসা নেতৃত্ব মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এ গণহত্যা নিয়ে প্রতারণাপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তার বক্তব্যের নির্যাস দাঁড়ায় গাজাবাসী ‘মানুষ নয়’। তারা স্রেফ কিছু প্রাণী যাদের ব্যাপারে কোনো দায়দায়িত্ব নেই ইসরাইল সরকারের। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিবিএসকে তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুতে আমরা দুঃখিত; কিন্তু এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ দায় হামাসের।’ কিভাবে এ দায় হামাসের হতে পারে? যেখানে বোমা হামলা হচ্ছে নেতানিয়াহুর নির্দেশে। ভোটে ওই এলাকার জন্য নির্বাচিত হওয়াই কি হামাস এবং তাদের ভোট দেয়া ওই এলাকার সাধারণ মানুষের অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘ এবং পশ্চিমারাইতো এ ব্যবস্থার নাম দিয়েছে গণতন্ত্র। গণতন্ত্র রক্ষা এবং এর অগ্রগতি নিয়ে সারাবিশ্বে তারা সদা তৎপর। সেই গণতন্ত্রচর্চাই ফিলিস্তিনিদের জন্য হয়ে গেল অপরাধ!
ফিলিস্তিনি জনগণের বেঁচে থাকার অধিকার অস্বীকার করা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যম বিবিসির কয়েকটি ছবি বিশ্লেষণ করলে এ চিত্রই প্রকাশ পাবে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমটিও ইহুদিদের পক্ষপাতপুষ্ট। তবে স্রেফ সংবাদমূল্যের বিবেচনায় এ ধরনের ছবি না ছেপে তারা পারেনি। আট-দশ বছরের একটি ফিলিস্তিনি শিশু রাস্তায় পড়ে চিৎকার করে কাঁদছে। এ শিশুর বাবা বিমান হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার মতো কেউ নেই। এমনকি, একটু পরে ইসরাইলি বিমান হামলায় সে নিজে যে প্রাণ হারাবে না, তারও নিশ্চয়তা নেই। এ ছবির ওপরে বিবিসি যে ছবিটি পোস্ট করেছে, তা কন্যা শিশুসহ এক ইসরাইলি মায়ের। হামাসের নিক্ষিপ্ত কামানের গোলার বিস্ফোরণে ভয় পেয়েছে শিশু কন্যাটি। মা তাকে স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। দু’জন ডাক্তার ও কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী তাদের ঘিরে ধরে আছেন। আদর করে শিশুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন ডাক্তার। এ দুটো ছবি বিশ্ব মোড়লদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরেছে। একটি জনগোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে বিশ্বসম্প্রদায়। অন্য গোষ্ঠীর প্রাণ রক্ষার দাবিকেও অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। আরো যেসব ছবি রয়েছে তা প্রায় একই চিত্র প্রকাশ করছে। ইসরাইলি সৈন্যরা উপভোগ করছে বিশ্বকাপ ফাইনাল। একই সময় গাজা থেকে পাওয়া ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ভয়াবহ আক্রমণে গুঁড়িয়ে যাওয়া একটি জনপদের দৃশ্য। দাউ দাউ করে আগুনে জ্বলছে কয়েকটি ভবন। গাজার আকাশ ধোঁয়ার বিশাল কুণ্ডলির অন্ধকারে ছেয়ে আছে। পাশে এক গলিতে একটি লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে উদ্বিগ্ন প্রতিবাদী এক যুবক। ইসরাইলি সৈন্যদের ফুটবল উৎসবে যোগ দিতে কোনো অসুবিধা হয়নি। ঠিক ওই সময় একটি ক্যাফেতে ফুটবল দেখতে গিয়ে বোমা হামলায় প্রাণ দেন ছয়-সাত জন ফিলিস্তিনি।
ফ্রান্স যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মানবতা ও মনুষ্যবোধের বিকৃতিকে উলঙ্গ করেছে। তারাও হামাসের রকেট হামলার নিন্দা জানিয়েছে। তা হলে হিসাব দাঁড়াচ্ছে ১৯২ জনের প্রাণহানি তাদের মতেও কোনো অপরাধ নয়। অপরাধ হচ্ছে হত্যার শিকার গাজাবাসীর জবাবি হামলা। এ হামলায় এখন পর্যন্ত একজন ইসরাইলি হতাহত হয়নি। জাতিসঙ্ঘ ও যুক্তরাষ্ট্রও একই ধরনের মনোভাব পোষণ করেছে। তাদের মতে, এতে মানবাধিকারের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসঙ্ঘের মতো ইসরাইলের প্রতি ফ্রান্সের একই রকমের সফট আহ্বান ‘টু শো রেসট্রেইন্ট’। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসঙ্ঘের মতো মুখোশের আড়াল নেয়নি ফ্রান্স। তারা সরাসরি ইসরাইলের কুকর্মের প্রতি সমর্থন দিয়েছে। হামলা বন্ধের আহ্বানের অর্থ বরাবরের মতো ইসরাইল বোঝে। অর্থাৎ নির্বিচার হত্যা চালালে কোনো সমস্যা নেই।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চরম পক্ষপাত যথেচ্ছ উপভোগ করে চলেছে ইসরাইলের খুনি সরকারগুলো। এর সাথে সমান্তরাল অবস্থান নেয় মূলধারার সংবাদমাধ্যম। খবর প্রকাশ ও শব্দচয়নে সব সময় পক্ষপাতের মাধ্যমে ইসরাইলের অবস্থানকে যৌক্তিক পরিণতি দেয় এ অসাধু চক্র। জনগণের নির্বাচিত একটি দলের প্রতি তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। গণতন্ত্রিক ভাবধারার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের স্লোগানকে অথচ তারা সবসময় ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। সমানে তারা হামাসকে মিলিটেন্ট বাহিনী বলে চালিয়ে দিচ্ছে। কী আচরণ করলে হামাস মিলিটেন্ট হবে না সে ধরনের যুক্তিতর্কের অবতারণা তারা করছে না। বোমা হামলার প্রথম ধাপে গাজার পুলিশ স্টেশনগুলো উড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাভাবিক অঙ্গ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এভাবে ধ্বংস করে দেয়ার পর রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হামাসের দায়িত্ব কী হবে; এরপর কি তারা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে? হাত-পা গুটিয়ে বসে যুবকেরা অকাতরে প্রাণ দিলে মিডিয়া সম্ভবত তাদের ওপর থেকে মিলিটেন্ট তকমা প্রত্যাহার করবে। নিজেদের ওপর চেপে বসা মিলিটেন্ট তকমা প্রত্যাহার হবে, এই আশায় যদি তারা প্রতিরোধ ছেড়ে দেয়, তবে ওই অঞ্চলে ফিলিস্তিনের অস্তিত্ব অবিলম্বে শেষ হয়ে যাবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। মিডিয়ার আবদারে সাড়া দিলে বহু আগেই পুরো এলাকাটি ইসরাইলি আগ্রাসনের শিকার হয়ে আরব বসতি শূন্য হয়ে যেত। পশ্চিমাদের মতো তাদের সৃষ্ট মিডিয়াও এটিই চায়। তারা ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পক্ষে সাফাই গাইছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর এ মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ তার অভিপ্রায় শেষপর্যন্ত পূরণ হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক চাপ আক্রমণ বন্ধ করতে ইসরাইলকে বাধ্য করতে পারবে না। সামরিক অভিযান উদ্দেশ্য হাসিল না পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।’ প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে ইয়ালুন হামাসকে সমূলে ধ্বংস করার ডাক দিয়েছেন, যা প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিন নির্মূল করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে।
প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০১২ সালের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। গাজায় একটি গণনিধন হয়ে যাওয়ার পর মধ্যস্থতা করার এ প্রস্তাব বাস্তবায়ন হবে মিসরের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্র বিনা শর্তে ইসরাইলকে সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। তাদের মধ্যস্থতায় কখনো একটি নিরপেক্ষ শান্তি আলোচনা হতে পারে না। অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে মিসর থেকে মুসলিম ব্রাদারহুডকে এক প্রকার উচ্ছেদ করা হয়েছে। তারা চাপের মুখে পড়ায় হামাস এখন বন্ধুহীন। এ দুর্বলতাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব মিসরের পক্ষ থেকে রাখা হয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছে হামাস। তারা এটিকে আত্মসমর্পণ করার শামিল বলে মনে করছেন।
ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন সমর্থন দিচ্ছে, আরব ও ইসলামি দুনিয়া তখন চরম দায়িত্বহীন থাকছে। আরব লীগের মহাসচিব নাবিল আল-আরাবি এ ভয়াবহ সন্ত্রাসের তীব্র নিন্দা শুধু নয়, পারেন গাজা উপত্যকায় হত্যাযজ্ঞ বন্ধে একটি উদ্যোগ নিতে। তিনি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছেও আহ্বান জানাতে পারেন। তুরস্ক ও ইরানের উচিত একই সমান্তরালে বিবৃতি দান। ইসলামি সম্মেলন সংস্থার কাছে কোনো কিছু আশা না করাই ভালো। ফিলিস্তিনি জনগণের প্রাণ রক্ষার জন্য প্রয়োজন ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেয়া। সেটা হতে পারে, নানা ধরনের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের বহু নিষেধাজ্ঞা বিভিন্ন সময়ে আরোপ করেছে সামান্য কোনো অপরাধে। নিজেদের অপছন্দের কারণে নিরপরাধ রাষ্ট্রকেও তারা অবরোধের মুখোমুখি করেছে।
ইহুদিদের মধ্যে একটি বর্বর গোষ্ঠী রয়েছে, তারা পৈশাচিক কায়দায় ফিলিস্তিনি হত্যাকে একটি উৎসব হিসেবে উদ্যাপন করছে। আলজাজিরার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দ্য স্ট্রিম-এ এ ধরনের একটি অবিশ্বাস্য ছবি প্রকাশ পেয়েছে। ছবিতে একদল লোককে ইসরাইলের এসডেরট এলাকার একটি পাহাড়ে দল বেঁধে সন্ধ্যা যাপন করতে দেখা যায়। গরমের সন্ধ্যায় পাহাড়ের ওপর দল বেঁধে বসে থাকা মানুষ হাওয়া খাচ্ছে বলে মনে হবে। প্রকৃতপক্ষে এরা গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর বোমা হামলার দৃশ্য উপভোগ করছে। নিক্ষিপ্ত বোমায় নারী-শিশুর আর্তনাদ সেখানে পৌঁছার কথা নয়; তবে বোমা বিস্ফোরণের ভয়াল গর্জন তারা শুনেছে। নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে উল্লাস করার বিকৃত আচরণ সুস্থ বিবেককে আহত করবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন