Image description

বইমেলার ঠিক পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেট্রো স্টেশন। একেকটি ট্রেন থামে, আর হুড়মুড় করে স্টেশনে নামে মানুষ। বড় অংশের গন্তব্য বইমেলা। আরেক অংশের গতিমুখ ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল। রাজধানীতে সরস্বতীপূজার অন্যতম আয়োজনটা হয় এখানে। গতকাল সোমবার ছিল সরস্বতীপূজা।

পূজা দেখতে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের অনেকে বইমেলায়ও ঢুঁ মেরেছেন। মেলার কেউ কেউ আবার পা বাড়িয়েছেন পূজার আয়োজনের দিকে। কাছাকাছি বড় দুই উৎসব। মেলা প্রাঙ্গণ ও টিএসসি-সংলগ্ন এলাকায় গতকাল তাই জনসমাগম ছিল বেশ।

মেলা থেকে বই কিনে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন শিল্পী সাহা। মেট্রো স্টেশনে টিকিটের জন্য অপেক্ষায় তিনি। পরিবারের আরেক সদস্য টিকিট কিনতে দাঁড়িয়েছেন সারিতে। শিল্পী সাহা বললেন, ‘পূজা ও মেলা—দুটি উৎসব একসঙ্গে। তাই একটা আনন্দমুখর পরিবেশ। বন্ধু, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঘুরতে এসেছি। বইও কিছু কিনলাম।’

মেট্রোরেলের কারণে রাজধানীর অনেক এলাকা থেকে বইমেলায় আসা-যাওয়া সহজ হয়েছে। মিরপুরের শেওড়াপাড়া থেকে গতকাল মেলায় এসেছিলেন কৃষ্ণা সরকার। জানালেন, মেট্রোরেলে এসেছেন, ফিরবেনও মেট্রোতে।

কৃষ্ণা বললেন, ‘আগে বাসে করে মেলায় আসতে অনেক বিড়ম্বনায় পড়তে হতো। সিএনজিচালিত অটোরিকশায়ও সবাই একসঙ্গে আসাটা কঠিন। মেট্রোরেলে এখন চাইলেই পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে চলে আসা যায়। সময়ও কম লাগে।’

মিরপুরের মনিপুর স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী পারিজাত পাল পিউ। বাবা আর বড় বোনের সঙ্গে গতকাল মেলায় এসেছিল সে। কিনেছে ভূত আর বিড়াল নিয়ে বই। বাবা পুলিশ ইন্সপেক্টর বিপ্লব কিশোর শীল বললেন, আগে আসতে অনেক কষ্ট হতো; বিশেষ করে রাস্তায় অনেক সময় চলে যেত। এখন আসতে সময় কম লাগে। মেলায় বেশি সময় ঘোরার সুযোগ থাকে।

মেলার তৃতীয় দিনে মানুষের অনেক ভিড়, তবে হাতে বই কম। স্টুডেন্ট ওয়েজের এক বিক্রয়কর্মী বললেন, এখন সেলফির পাঠক বেশি। কিছুদিন গেলে আসল পাঠক আসবে।

নতুন বইয়ের খোঁজ

মেলার তৃতীয় দিনে বেশ কিছু নতুন বই এসেছে। কথাপ্রকাশ বের করেছে ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘নানা চোখে জীবনানন্দ’। কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার এবং সর্বোপরি মানুষ জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে কয়েকটি রচনা এই বইয়ে সংকলিত হয়েছে। যাঁরা লিখেছেন, সবাই দেশে-বিদেশে জীবনানন্দ বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত।

ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্য নিয়ে এসেছে উপন্যাস। মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিরা তাদের ভূখণ্ডে বোমারু বিমান, জাহাজ আর ট্যাংকের বিপরীতে শুধু গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে, তবু মাতৃভূমিকে কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে রাজি নয়। দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের এই আত্মত্যাগের সংগ্রাম নিয়েই কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাইয়ের নতুন উপন্যাস ‘চারণভূমি’। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ।

আগামী প্রকাশনী নিয়ে এসেছে মুস্তাফা মজিদের সম্পাদনায় বই ‘গারো জাতিসত্তা’।

বইটির ফ্ল্যাপে লেখা হয়েছে, বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশের গারো জাতির আবহমান মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা তাদেরকে যূথবদ্ধ রেখেছে। এই মাতৃতান্ত্রিকতা তাদের ভূমি ব্যবস্থার মধ্যে নারীর যে অধিকার, তা নিশ্চিত করেছে। সমৃদ্ধ ও বর্ণাঢ্য ঐতিহ্যের গারো সংস্কৃতি সংরক্ষণে সরকার ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য।

প্রথমা নিয়ে এসেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও জন মুক্তির প্রশ্ন’। বইটির ফ্ল্যাপে বলা হয়েছে, নিঃসন্দেহে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের আগে এ দেশের ইতিহাসে উনসত্তরের আন্দোলনই ছিল সেই ঘটনা, যা শহর-গ্রামনির্বিশেষে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষকে কম-বেশি আলোড়িত করেছিল। জনসম্পৃক্তি ও ব্যাপক মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বিচারে এই আন্দোলনের সঙ্গে তুলনীয় ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি।

এ ছাড়া বিভাস প্রকাশনী বের করেছে যতীন সরকারের প্রবন্ধ সংকলন ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’, জাবের প্রকাশনী বের করেছে কবি গোলাম মোস্তফার জীবনীগ্রন্থ ‘মরু দুলাল’, জ্ঞানকোষ এনেছে নোবেলজয়ী লেখক হান কাং-এর ‘দ্য হোয়াইট বুক’; অনুবাদে মোস্তাক শরীফ। বাংলা একাডেমি জানিয়েছে, গতকাল মেলায় নতুন বই এসেছে ৩২টি।

আয়োজন

গতকাল বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘হায়দার আকবর খান রনো: আজীবন বিপ্লব-প্রয়াসী’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সোহরাব হাসান। আলোচনায় অংশ নেন আবদুল্লাহ আল ক্বাফী রতন, জলি তালুকদার এবং অনন্যা লাবণী পুতুল। সভাপতিত্ব করেন দীপা দত্ত।

সোহরাব হাসান বলেন, বাংলাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো। তিনি ছিলেন এ দেশের বাম রাজনীতির একই সঙ্গে ছাত্র ও শিক্ষক। অগ্রজদের কাছ থেকে যে শিক্ষা নিয়েছেন, সেটাই তিনি পৌঁছে দিয়েছেন অনুজ কমরেডদের কাছে। হায়দার আকবর খান রনো কখনো কট্টর পন্থার অনুসারী ছিলেন না। তিনি ভিন্ন মেরুর বামপন্থী নেতাদের একসঙ্গে বসিয়ে আলোচনার পথ খুলে দিতে সচেষ্ট ছিলেন।

লেখক বলছি মঞ্চে গতকাল নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি চঞ্চল আশরাফ এবং শিশুসাহিত্যিক আতিক হেলাল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি মোহন রায়হান ও রেজাউদ্দিন স্টালিন। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী মাহমুদা সিদ্দিকা সুমি এবং হ্যাপি হাবিবা।

ড. ইঞ্জিনিয়ার খালেকুজ্জামানের পরিচালনায় ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাঁশরী’র পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী এ কে এম শহীদ কবির, রেজাউল করিম, মিরাজুল জান্নাত সোনিয়া, রত্না দাস, দেবাশীষ শর্মা ও মাহমুদুল হাসান।

আজ মঙ্গলবার বিকেল চারটায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘কুমুদিনী হাজং’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন পাভেল পার্থ। আলোচনায় অংশ নেবেন মতিলাল হাজং এবং পরাগ রিছিল। সভাপতিত্ব করবেন আবু সাঈদ খান।