|
মুহাম্মদ রুহুল আমীন
|
|
ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে ধর্মকার্ড
18 Apr, 2014
গত ৭ এপ্রিল ভারতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক নির্বাচন শুরু হয়েছে। পুরো ছয় সপ্তাহ পর ১৬ মে ফল ঘোষণার মাধ্যমে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন এর মাধ্যমে। নির্বাচনে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস জোট (ইউপিএ) এবং বিজেপি জোট (এনডিএ) পরস্পর মুখোমুখি হয়েছে। কংগ্রেস ও বিজেপির নির্বাচনী প্রচারকাজে তারা উভয়েই ধর্মের অপব্যবহার করছে উলঙ্গভাবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাই ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে ধর্মকার্ড নিয়ে বিতর্কে জড়াচ্ছেন।
কংগ্রেসের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী এবং কংগ্রেসের অন্যতম শীর্ষ নেতা রাহুল গান্ধী তাঁর নির্বাচনী প্রচারকালে বিজেপিকে ধর্মীয় কোন্দল সৃষ্টির মূল হোতা হিসেবে উপস্থাপন করছেন। তাঁর মতে, বিজেপি ক্ষমতায় আসা মানেই ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরি হওয়া। তারা হিন্দু-মুসলমানকে একে অন্যের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংঘর্ষে নিক্ষেপ করছে। তিনি দাবি করেন, কংগ্রেসই কেবল হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান- সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে সক্ষম। কংগ্রেসকে তিনি সর্বভারতীয় দল হিসেবে ভারতের আনাচকানাচে সর্বত্র কংগ্রেসের চেতনা সঞ্চারিত বলে দাবি করেন। ক্রোধ, ঘৃণা ও বিভেদের রাজনীতি নয়, বরং কংগ্রেসের রাজনীতি হলো ভালোবাসা, বন্ধন ও মৈত্রীর রাজনীতি। গুজরাটের দাঙ্গা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং ভারতের অসংখ্য ধর্মীয় সংঘাতে মুসলমানদের হাজার হাজার মৃত্যুর কারণ ইতিহাস তুলে ধরে রাহুল গান্ধী সে জন্য বিজেপিকে দায়ী করেন।
ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে ধর্মকার্ড
অন্যদিকে বিজেপিও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদি অভিযোগ উত্থাপন করেছেন যে কংগ্রেস কখনো মুসলমানদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। তিনি কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধীকে লক্ষ্য করে বলেন, ভারতের জনসংখ্যার শতকরা ১৩ ভাগ মুসলমানের জীবনমান উন্নয়নে কংগ্রেস কেবল উদাসীনতা দেখিয়ে আসছে। তিনি জনগণকে প্রতিশ্রুতি দেন যে ৬০ বছরের কংগ্রেসের শাসনামলে ভারত যা যায়নি, মাত্র ৬০ মাসে তিনি তা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবেন। তিনি সোনিয়া গান্ধীর প্রতি সাম্প্রদায়িকতার শর নিক্ষেপ করে বলেন, ম্যাডাম সোনিয়ার নাকের ডগায় গত এক বছরে প্রায় ৭০০টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে উত্তর প্রদেশেই অন্তত ২৫০টি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেধেছে।
বিজেপি ও কংগ্রেস ভারতের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে সব সময়ই ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু মুসলমানদের ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে ধর্মকার্ড ব্যবহার করে থাকে। এর আগে বিজেপি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় উসকানিমূলক স্লোগান এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রচার করে ভারতের নাগরিকদের বেশ প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু এবারকার নির্বাচনে কৌশলগত পরিবর্তনের সূচনা করে হিন্দুত্ববাদ প্রচার না করে উন্নয়ন এবং হিন্দুস্বার্থ রক্ষা করার নীতির ওপর বিজেপি তার নির্বাচনী ইশতেহার রচনা করেছে। সরাসরি হিন্দুত্ববাদের কথা না বললেও হিন্দুস্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়েই বিজেপির উগ্র ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় মৌলবাদ ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ প্রকাশিত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে কংগ্রেসও গুজরাটের দাঙ্গা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং অন্যান্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সুবিচার প্রতিষ্ঠিত না করলেও নির্বাচনের আগে মুসলমানদের ভোট পাওয়ার লক্ষ্যে মুসলমানদের প্রতি বিজেপির রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাপক প্রচারে নেমেছে। এ পর্যন্ত জনমত জরিপে দেখা গেছে, বিজেপির ধর্মকার্ড বেশ গুরুত্ব পেয়েছে এবং বিজেপি নির্বাচনে জয়লাভ করতে যাচ্ছে।
ভারতের মতো বিশ্বের বৃহত্তম নির্বাচনের জটিল প্রক্রিয়ায় জনমত জরিপ খুবই ভ্রমপ্রবণ হয়ে থাকে এবং ২০০৪ সালের নির্বাচনে জনমত জরিপ ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু এবারকার নির্বাচনের প্রাক-মূল্যায়ন যে মোদিকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত করেই ফেলেছে।
কে এই মোদি? রেললাইনের প্ল্যাটফর্মে চা বিক্রি করে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে শীর্ষস্থান অর্জন করার যোগ্যতা সৃষ্টি করলেও তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ রচিত হয়েছে উগ্র হিন্দুত্ববাদের মূলনীতির স্রোতোধারায়। ৭ এপ্রিল নির্বাচন শুরু হওয়ার মুহূর্তে বিজেপি প্রচারিত রাজনৈতিক ইশতেহারে বিজেপির দুটি মূলনীতি ঘোষিত হয়েছে : (ক) উন্নয়ন, (খ) হিন্দুস্বার্থ রক্ষা। ৫২ পৃষ্ঠাসংবলিত বিরাট রাজনৈতিক ইশতেহারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতা উদ্গীর্ণ হয়েছে। এবারকার ইশতেহারে বিজেপি অযোধ্যায় ধ্বংসকৃত বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির নির্মাণের দাবি পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার পর অযোধ্যার সেই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় প্রায় দুই হাজার মুসলমানের নিহত হওয়ার বিস্মৃতিকে মূর্তভাবে জাগিয়ে তোলা হয়েছে বিজেপির ইশতেহারে। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রতি চরম নির্যাতনমূলক নীতি ঘোষিত হয়েছে কোরবানির ঈদে গরু জবাই নিষিদ্ধ করার ইশতেহারের মাধ্যমে। বিজেপি জোটের তৃতীয় ইসলামবিরোধী নীতি হলো, ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের খণ্ডননীতির স্পর্ধা। বিজেপির ইশতেহারে সবচেয়ে আপত্তিকর মুসলিমবিদ্বেষী ঘোষণা হলো, এক ও অভিন্ন নাগরিক নীতি (uniform civil code), যার মাধ্যমে বহু সংস্কৃতির ভারতে একক-অভিন্ন সংস্কৃতির অপ্রযোজ্যতা সত্ত্বেও তা চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা থাকবে ভারত রাষ্ট্রের।
বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা মুরালি মনোহর যোশী নির্বাচনী ইশতেহারে রামমন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টিকে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ (culturally important) হিসেবে বর্ণনা করলেও এ ইশতেহারে যে নিষ্ঠুর মুসলিমবিদ্বেষী ও মুসলিমবিধ্বংসী নীতি ঘোষিত হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর আগে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে সেখানে অন্যূন এ হাজার মুসলমান হত্যার পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থন করে নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ কর্তৃক প্রায় এক দশককাল পর্যন্ত বয়কটপ্রাপ্ত ছিলেন। নরেন্দ্র মোদি তাঁর নির্বাচনী প্রচারকালে নিজেই স্বীকার করেন যে সোনিয়া গান্ধীর সামনে এক বছরে প্রায় ৭০০ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে এবং উত্তর প্রদেশে প্রায় ২৫০টি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার রেকর্ড করা হয়েছে। স্পষ্টত, ভারতের নজিরবিহীন এসব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অসংখ্য মুসলমানের রক্ত ঝরেছে।
বিজেপির মুসলিমবিদ্বেষ এত প্রবল যে এবারকার নির্বাচনী প্রচারকালে মোদির ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা অমিত শাহ উগ্র সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি হিন্দু নেতাদের ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের ক্রোধ ছড়াতে তৎপর আছেন। তিনি এক মন্তব্যে বলেন, এই নির্বাচন ওই সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের নির্বাচন, যে সরকার হিন্দুদের হত্যাকারীদের রক্ষা করেছে এবং তাদের পুরস্কৃত করেছে।
ধর্মীয় ক্রোধ, বিদ্বেষ ও বিভক্তি ছড়িয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে মাত্র ১৩ শতাংশ মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে বিজেপি জোট নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। আর ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা হয়তো বিজেপির প্রচারণায় আশ্বস্ত হয়ে হিন্দুস্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতিকে পছন্দ করছে। শেষ পর্যন্ত হয়তো হিন্দু জনগণের বিপুল ভোটে বিজেপির নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসতে সক্ষম হবেন।
অন্যদিকে কংগ্রেসও বিজেপির বিরুদ্ধে ধর্মকার্ড ব্যবহার করে সুবিধা নিতে চাইবে বলে আগেই উল্লেখ করেছি। মুসলমানদের ভোট নিশ্চিতভাবে ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। বেদনার বিষয় হলো, ক্ষমতায় থাকাকালে কংগ্রেস মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় ভারতের অহিংস নীতির প্রয়োগ ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। সর্ব ধর্ম-বর্ণ-সৌহার্দ্য নীতির প্রতিফলন ঘটালে হয়তো মুসলমানদের ভোট সর্বাংশেই কংগ্রেসের পক্ষে পড়ত। মুসলমানদের ভোট আকর্ষণ করতে বিজেপির প্রচারণায় কৌশলে হিন্দুত্ববাদ এড়ানো হয়েছে। আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোট আকর্ষণ করতে হিন্দুস্বার্থ রক্ষার ভিত্তিতে বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহার প্রণীত হয়েছে।
ভারতের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এখন এত বেশি প্রবল যে ধর্মকার্ডের সুচতুর ক্রীড়া-কৌশলই ভারতের নির্বাচনে জয়-পরাজয় নিশ্চিত করে। ধর্মের গুরুত্ব অনুধাবনের প্রয়োজন সব সময়ে, কেবল প্রাক-নির্বাচনী মুহূর্তে নয়- এই সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়ে কংগ্রেস আজ হারতে বসেছে। আর ধর্মকার্ডের স্মার্ট ব্যবহারের কারণে মুসলিমবিদ্বেষী বিজেপি বিজয়ের দোরগড়ায়। নাগরিককে ধর্ম দিয়ে বিবেচনা না করে ভারতীয় হিসেবে বিবেচনা করে ধর্মকার্ডের ব্যবহার সীমিত করা জরুরি।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন