Image description

ফয়সাল আকবর

২০১৩ সালের এক বসন্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক অনুষ্ঠানে আমাদের পরিচয়। সেই থেকে আমি তাকে ওসমান নামেই জানতাম। সে আর বুরহান, দীর্ঘ ২৮ বছরের বন্ধুত্বের সাক্ষী। দুজনেরই প্রখর বুদ্ধিদীপ্ততা আমাকে মুগ্ধ করত। তাই রাজনীতি, অর্থনীতি আর সংস্কৃতি নিয়ে তাদের সাথে আমার অসংখ্য তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই তারা রামপুরায় থাকতো। ফলে তাদের আড্ডাস্থল ছিল হাতিরঝিল। তাদের সেই আড্ডায় অনেকবার দাওয়াত দিলেও যতদূর মনে পড়ে একবারই গিয়েছিলাম।

ওসমান ছিল সাইফুর’স কোচিং সেন্টারের ইংরেজির এক জনপ্রিয় শিক্ষক। একদিন বুরহানকে বলেছিলাম, ‘ওসমানকে বলো, কোচিং ছেড়ে চাকরিতে যোগ দিতে।’ বুরহান জানায়, ওসমান প্রথাগত চাকরিতে আগ্রহী না। তার অনেক বছর পর ২০২৩ সালে যখন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ এবং ‘হিস্টোরি অব দ্যা ইমার্জেন্স অব বাংলাদেশ’ কোর্সের জন্য চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকের প্রয়োজন হলো। বুরহান ওসমানের সিভি দিয়ে বলল, ওসমানের সিভি, দেখেন কি করা যায়।’ আমরা নিয়ম মেনে শর্টলিস্ট করে ওসমানকে পরীক্ষার জন্য ডেকেছিলাম। কিন্তু, সে আর পরীক্ষা দিতে আসেনি। বুরহান জানালো, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকায় সে পরীক্ষা দিতে আসেনি। আহা! সেদিন যদি সে আসত, তবে সহকর্মী হিসেবে তাকে পাওয়ার সৌভাগ্য হতো আমার।

বাংলা সালতানাত, সুবাহ বাংলা, স্বাধীন বাংলা— এইসব নিয়ে ওসমানের বুঝাপড়া ছিল সুস্পষ্ট। সে স্বপ্ন দেখত এক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের, যার মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষের প্রকৃত মুক্তি আসবে। সেই লক্ষ্যে জুলাই বিপ্লবের দুই বছর আগে থেকেই ২০২৩ ও ২০২৪ সালের ঈদুল ফিতরের চাঁদ রাতে ওসমান ‘ঈদ মিছিল’ বের করার উদ্যোগ নিয়েছিল। আমার পরিচিত কয়েকজন পরিবার-পরিজন নিয়ে ওসমানের সেই ঈদ মিছিলে অংশও নিয়েছিল।

ওসমান ভালো কবিতা লিখতো। তার কবিতা ছিল বহুমাত্রিক- প্রেম, বিরহ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, বিপ্লব— সবকিছুর প্রতিচ্ছবি। মাঝে মাঝে সে আমাকে কবিতা পাঠাতো। আমি কবিতার ভাষা কম বুঝি, তাই কখনও তাকে ফিডব্যাক দিতে পারিনি। ২০২৪ সালের বইমেলায় ‘সীমান্ত শরিফ’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হলো তার প্রথম ও একমাত্র কাব্যগ্রন্থ, ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ’। বইটির প্রতি তার কী অদম্য উচ্ছ্বাস! বলেছিল, ‘ভাই, মেলায় এলে অবশ্যই আমাদের স্টলে আসবেন।’ যাব যাব করেও যাওয়া হলো না। ওসমানের সেই মানসজাত সন্তান, ‘লাভায় লালশাক পুবের আকাশ’, আজও কেনা হয়নি আমার। আফসোস!

২০২৪ সালের জুলাই মাস। চারিদিকে কেবল রক্ত আর রক্ত। ফ্যাসিস্ট হাসিনার নিষ্ঠুর গণহত্যায় বাংলাদেশ তখন এক বিশাল বধ্যভূমি। এই ভয়াবহতার মধ্যেই ২৪-২৫ জুলাইয়ের দিকের কথা। বুরহান আর আমি নানা কথা বলছি, এমন সময় এক অপরিচিত নম্বর থেকে ওসমান কল করে বুরহানকে জানালো— রামপুরায় থাকা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশ তাকে খুঁজছে। তাকে কয়েকদিনের জন্য রাতের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, চব্বিশের বিপ্লবে রামপুরা-বনশ্রী ব্যাটলফিল্ডে দাঁড়িয়ে যে ক’জন যুবক সাহসের সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছে, ওসমান হাদি ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম।

অবশেষে জুলাই বিপ্লব সফল হলো। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে গেল ভারতে। দেড় হাজার প্রাণের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেলাম এক নতুন স্বাধীনতা। আর এই নতুন বাংলাদেশে আমাদের প্রিয় ওসমান আবার যাত্রা শুরু করলেন তার পুরোনো সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মন্ত্র নিয়ে। তিনি নেমে পড়লেন রাষ্ট্র সংস্কার, কালচারাল ফ্যাসিজম ও আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে। জন্ম দিলেন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’-এর।

 

ভারতীয় বাঁধের কারণে ফেনী যখন ডুবল, তখন তার নেতৃত্বে পরিচালিত হলো ঐতিহাসিক ডম্বুর বাঁধ অভিমুখী লং মার্চ। যেন আমরা আবার মওলানা ভাসানীর সেই ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের এক মর্মস্পর্শী প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম। লং মার্চ শেষে ঢাকায় ফিরলে আমি ওসমান আর বুরহানকে সতর্ক করে বলি, ১৯৭৬-এ ফারাক্কা লংমার্চের পর মওলানা ভাসানী বেশিদিন বাঁচেননি। ২০১০-১১ সালে টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিবাদ করায় ইলিয়াস আলীকে গুম করা হয়, আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কয়েক দফায় হামলার শিকার হতে হয়। তোমাদের পথও অনেক কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ।

ওসমান জানালেন, সব ঝুঁকিকে মাথা পেতে নিয়ে সে ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী ভূমিকা চালিয়ে যেতে চায়। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! এক বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমাদের প্রত্যয়দীপ্ত ওসমান হাদিকে পৃথিবী থেকে নাই করে দেওয়া হলো। আমরা কেউ কি এই বিষয়টি নিয়ে সরব হতে পেরেছি? এই নীরবতা আমাদের অপরাধ নয় কি?

জুলাই বিপ্লবের পর সেই চেনা ওসমান ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে উঠলো বিপ্লবী হাদি নামে। ভারতীয় আগ্রাসন, কালচারাল ফ্যাসিজম ও মুজিববাদী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সে হয়ে উঠলো প্রতিরোধের এক অনন্য প্রতীকে। গত এক বছরে জুলাই বিপ্লবের মূল স্পিরিট নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাঠে ছিল ওসমান হাদীর ইনকিলাব মঞ্চ। মাঝে মাঝে তাদের অতি-উদ্যম ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে ভেবে আমি হস্তক্ষেপ করেছি। কারো দ্বারা ব্যবহৃত হওয়ার সামান্য শঙ্কা দেখা দিলে, কেবল আমার কথায় বেশ কয়েকবার তারা কর্মসূচি স্থগিত করেছে, কর্মসূচির প্রকৃতি পাল্টিয়েছে, ফেসবুক পোস্টও মুছে দিয়েছে। আমার প্রতি ওসমান ও বুরহানের এইটুকু বিশ্বাস ছিল যে, আমি যা বলেছি তা তাদের ভালোর জন্যেই বলেছি।

ওসমান হাদির সাথে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে। শাহবাগে সন্ধ্যায় দেখা হওয়ার পর সে আমাকে বলল, ‘ভাই, আপনাকে খুঁজছি। এখানে কথা বলা নিরাপদ নয়, চলেন ক্যাম্পাসে যাই।’ তারপর সে যা বলল, তার সারমর্ম ছিল—তাকে নির্ভেরযোগ্য জায়গা থেকে জানানো হয়েছে, তিনজন জুলাই বিপ্লবীকে টার্গেট কিলিং করার জন্য বিদেশে লেনদেন হয়েছে, যার মধ্যে সে (হাদি) একজন। কী করণীয় জানতে চাইলে আমি তাকে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে বলি। একইসঙ্গে জনপরিসরে বিষয়টি নিয়ে আসা, সরকারের সর্বোচ্চ মহলে জানানো, দ্রুত গতির যানবাহন ব্যবহার করা এবং নিজস্ব একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করার পরামর্শ দেই। আফসোস, সব জানার পরেও বিপ্লবী হাদিকে রক্ষা করতে আমরা কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারিনি। এর চেয়ে আফসোস আমার জীবনে আর কি হতে পারে?

নিরাপত্তা সংকট নিয়ে কিছুদিন সতর্ক থাকলেও ঢাকা-৮ আসনে নির্বাচনের ক্যাম্পেইন চালাতে গিয়ে সে যেন সব ভুলে গেল। নভেম্বরের শুরুর দিকে কল দিয়ে বলল, ‘ভাই, জানি অনেক প্রশ্ন করবেন...। তবে আমি, হাসনাত আর ফুয়াদ ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নির্বাচন করব। ৫০০ ভোট পেলেও খুশি, কম পেলে একটু খারাপ লাগতে পারে...। দোয়া করবেন, আর আপনার পরামর্শ চাই।’ এই নির্বাচনী প্রচারণায় আমাদের প্রিয় ওসমান হয়ে উঠলেন যেন আরেকজন মওলানা ভাসানী। মানুষের এত ভালোবাসা আর আবেগ কে কবে দেখেছে, আমি জানি না।

অবশেষে ওসমান হাদীর আশঙ্কা আর আকাঙ্ক্ষা— দুটোই সত্য হলো। ঘাতকের বুলেটে শহীদ হয়ে গেল আমার এক যুগ আগের সেই ওসমান, আমাদের সাচ্চা বিপ্লবী ওসমান হাদি। আমাদের আকাশের সবচয়ে উজ্জ্বলতম নক্ষত্রটির বিদায় হয়ে গেল। তার অসংখ্য বক্তব্যে শহীদ হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, মহান আল্লাহ সেটাই কবুল করলেন। শহীদ হয়ে অমর হয়ে গেলেন প্রিয় বীর বিপ্লবী শহীদ ওসমান হাদি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শহীদ জিয়াউর রহমান এবং শহীদ শরীফ ওসমান হাদির মতো বীরোচিত বিদায় আর কেউ পেয়েছে কি না, ভবিষ্যতে আবার কবে পাবে— তা আমাদের অজানা। কিন্তু শহীদ ওসমান হাদি আমাদের ওপর, বাংলাদেশপন্থীদের ওপর এক মহান দায়িত্ব অর্পণ করে দিয়ে গেছেন। বাঙ্গালী মুসলমানকে চিরঋণী করে গেছেন। ইনসাফের নতুন সূর্য উদিত হতে আমাদের সবার উচিত তার প্রতিষ্ঠিত ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ ও ‘ইনকিলাব কালচারাল সেন্টার’-কে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা। মহান আল্লাহ সহায় হোক।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক।