Image description
 

Mirza Galib (মির্জা গালিব)


এক,
প্রথম আলো যতটা না বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করে, তার চাইতে অনেক বেশি করে মতাদর্শিক রাজনীতি। বাংলাদেশ একটা "ব্যর্থ রাষ্ট্র" হয়ে উঠছে, বা "ইসলামী মৌলবাদ" দেশটাকে প্রতিক্রিয়াশীল বানায়ে ফেলতেছে — এই জুজুর ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশে ইসলামোফোবিক সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠার যে রাজনীতি আওয়ামী লীগ করে, প্রথম আলোর রাজনীতি তার চাইতে কম কিছু না। The Dissent এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে যে, জামায়াত বা হেফাজত সংশ্লিষ্ট সহিংসতার নিউজে প্রথম আলো খুব কম্ফোর্টেবলি ‘জামায়াতের সহিংসতা’, ‘জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব’, ‘বর্বরতা’, ‘হেফাজতের তাণ্ডব’, ‘হেফাজতের ধ্বংসযজ্ঞে নিঃস্ব’, ‘হেফাজতের সহিংসতা’, ‘যুদ্ধক্ষেত্র’—এই শব্দগুলো ব্যবহার করে। কিন্তু সারপ্রাইজিংলি আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট সহিংসতার নিউজে তারা ভাববাচ্যে চলে যায়, যেমন—‘হামলা হয়েছে’, ‘ঘুমন্ত ব্যক্তির মৃত্যু’, ‘বাসে আগুন’; বড়জোর বলে যে ‘দুর্বৃত্তদের হামলা’। এই রাজনীতির মধ্য দিয়ে তারা মূলত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনীতির এক ধরনের বৈধতার পাটাতন তৈরি করার চেষ্টা করে। এই কাজ কেন করে তারা? কারণ আওয়ামী লীগ ‘মুক্তিযুদ্ধের’ রাজনীতি করে, সেকুলার রাজনীতি করে। কাজেই আওয়ামী লীগই তাদের শেষ ভরসা। এই রাজনীতি মূলত একটা ফার রাইট রাজনীতি, স্রেফ "us versus them" রাজনীতি।
দুই,
বাংলাদেশে সেকুলাররা নিজেদের লিবারেল বলে দাবি করে কিন্তু রাজনীতি করে মূলত ফার রাইট। এদের এই রাজনীতির আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো সিলেক্টিভ মোরালিটি। প্রথম আলোর অফিস পুড়লে সেটা হয় বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপরে আঘাত; কিন্তু নয়া দিগন্তের অফিস পুড়লে, সংগ্রামের অফিসে ভাঙচুর হলে, কিংবা আমার দেশের সম্পাদকের উপর শারীরিক হামলা হলে দেশের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার খুব বেশি একটা রকমফের হয় না। কারণ এদের কেউ কেউ ‘দলীয় পত্রিকা’, কেউ কেউ ‘চান্স সম্পাদক’! ‘শরীফ’, ‘এলিট’ সাংবাদিকতা করে কেবল প্রথম আলো, আর ‘শরীফ’, ‘এলিট’ রাজনীতি করে শুধু সেকুলাররা!
তিন,
কিন্তু এই রাজনীতির কারণে প্রথম আলোর অফিস ভাঙচুর করা, তাদের অফিসে কর্মরত সাংবাদিকদের জীবনকে প্রশ্নের মুখে ফেলা কি কোনো ভালো রাজনীতি? অবশ্যই না। যে সকল ক্ষুব্ধ তরুণরা "কালচারাল ফ্যাসিস্ট"দের প্রতি ক্ষোভ থেকে এই কাজে ন্যায্যতা খোঁজেন, তাদের কাজও দিনের শেষে "us versus them" রাজনীতিতেই পরিণত হয়। বাজে শত্রুর সাথে ফাইট করার এই একটা ঝামেলা, সে আপনাকে টেনে নিচেই নামিয়ে ফেলে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ যে বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি—সেখানে সবার জন্য ন্যায্যতা থাকতে হবে, আইনের শাসন থাকতে হবে, মানবাধিকার থাকতে হবে। প্রথম আলোকে প্রচণ্ড সমালোচনা করার পরও তার সাংবাদিকতা করার পূর্ণ অধিকার দিতে হবে। তাদেরকে তাদের কথা বলার, তাদের রাজনীতি করার উন্মুক্ত জায়গা দিতে হবে।
চার,
বাংলাদেশে ‘সেকুলার’ আর ‘ধার্মিক’ জনগণের মধ্যে কালচারাল পার্থক্য আছে, দুই ক্যাম্পের রাজনীতির মধ্যে মতাদর্শিক পার্থক্য আছে। কিন্তু দেশটা আমাদের সবার। এই মতপার্থক্য সহই কীভাবে আমরা একসাথে কিছু কমন গ্রাউন্ডে আসতে পারি সেই চেষ্টা আমাদের করতে হবে। এই চেষ্টা করার প্রথম ধাপ হলো—আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া বন্ধ করতে হবে আর পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করতে হবে। জেনারেশনের পর জেনারেশন নিজের দেশের লোকজন একজনের সাথে আরেকজনের শত্রুতা চলতেই থাকবে—এইটার কোনো মানে নাই। আমার দেশের অফিস ভাঙলে এক গ্রুপ চুপ থাকবে, প্রথম আলোর অফিস ভাঙলে আরেক গ্রুপ চুপ থাকবে - এই সিলেক্টিভ মোরালিটি থেকে আমাদের বের হবার এখনই সময়।