Image description

এম আবদুল্লাহ

ঘাতকের পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক বুলেট জুলাই বিপ্লবী ও ভারতীয় আধিপত্যবাদবিরোধী বজ্রকণ্ঠ শরীফ ওসমান বিন হাদিকে যে বাঁচতে দেবে না, তা আগেই অনুমান করা গিয়েছিল। কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ৯টায় ওসমান হাদির হৃৎস্পন্দ থেমে যায়। তরুণ বিপ্লবীর শাহাদতে শোকে স্তব্ধ পুরো বাংলাদেশ। পতিত খুনি ফ্যাসিস্ট শক্তি ছাড়া সবাই শোকে মুহ্যমান ও বেদনাহত। গতকাল শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়েছে। দেশজুড়ে ক্ষোভ আর শোকাবহ পরিবেশে লাখো মানুষের জানাজা শেষে গতকাল চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন তিনি। মাত্র ৩২ বছর বয়সে যে সম্মান হাদি পেলেন, শতবর্ষী হয়েও এমন সম্মান জোটে কজনের কপালে? বলতে গেলে, একটি লাশের পাশে দাঁড়িয়ে গেছে পুরো বাংলাদেশ।

প্রিয় মাতৃভূমির বিজয়ের মাসে অনেকটা জুড়ে রাষ্ট্র, সরকার, সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দোর্দণ্ড প্রতাপে দখলে রেখেন ওসমান হাদি। এক জনমে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! শুক্রবার জুমার দিনে নরপিশাচ ঘাতকের বুলেটে মাথার খুলি-মগজ ছিন্নভিন্ন হয়ে জ্ঞান হারিয়েছেন, আরেক জুমাবারের রাতে মহান প্রভুর দরবারে হাজিরা দিয়েছেন। এমন সৌভাগ্য কজনের হয়? বৃহস্পতিবার রাতে (চন্দ্র মাসের রাত আগে, দিন পরে, সে হিসেবে শুক্রবার রাত) ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকাসহ সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বুলন্দ আওয়াজ তোলেÑ‘তুমি কে আমি কে, হাদি হাদি’, ‘আমরা সবাই হাদি হব, গুলির মুখে কথা কব’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ ‘লীগ ধর, জেলে ভর’ ইত্যাদি।

অদম্য সাহসী শরীফ ওসমান হাদির শাহাদতবরণে তার প্রতি অনুরাগ ও অপরিমেয় ভালোবাসার কারণে ক্ষোভ-বিক্ষোভ হওয়া স্বাভাবিক ছিল। আগে থেকেই অনুমান করা হচ্ছিল, ওসমান হাদির শাহাদতের খবর এলে ব্যাপক বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসতে পারে। একদল মানুষের বিক্ষোভ যে সহিংসতায় রূপ নেবে, তা-ও হয়তো সরকারের শঙ্কায় ছিল। যে কারণে প্রধান উপদেষ্টা মৃত্যুসংবাদ আসার অল্প সময়ের মধ্যে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সবাইকে সংযম ও ধৈর্যধারণের আহ্বান জানান। এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ও পরিবারের দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করার ঘোষণা দেয়। খুনিদের যেকোনো মূল্যে বিচারের আওতায় আনার বিষয়ে আশ্বস্ত করেন।

তার পরও সন্দেহভাজনদের বিচ্ছিন্ন একটি দল সংবাদমাধ্যমসহ কয়েকটি স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। এমন সহিংস আচরণ কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। তারা ভুলে গেছেন, হাদি তো শত্রুর জন্যও ইনসাফের বাণী শুনিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজে অনুসরণ করে গেছেন। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে হাদি ‘জান দেবÑজুলাই দেব না’ অঙ্গীকার ও প্রতিজ্ঞায় মাঠে সরব থাকলেও কোনো সহিংস কর্মকাণ্ডে নিজে জড়াননি, সঙ্গীদের জড়াতে দেননি। হাদির শাহাদতবরণের পর যে ঘটনা ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে, তা জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাপরিপন্থী। নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে হেনস্তা করা হয়েছে, যা ন্যক্কারজনক। প্রশ্ন উঠেছে, কারা এ কাজ করল? ইনকিলাব মঞ্চ তাদের ফেসবুক পেজে বারবার সতর্ক করেছে, কেউ যাতে ধ্বংসাত্মক ও সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে হাদির শাহাদতকে কলঙ্কিত না করেন। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলও সহিংস কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে তাৎক্ষণিক বিবৃতি-বক্তব্য দিয়েছে। ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো কার্যালয়ের একাংশ আক্রান্ত হওয়ার পর পরই আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান পত্রিকার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তবু কারা বিক্ষোভের নামে সহিংস ঘটনা ঘটাল? দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি হাদির দিক থেকে ভিন্নদিকে ফেরানোর কূটকৌশল কাদের? হাদির প্রতি সহানুভূতিশীল বা দরদি, কেউ এটা সজ্ঞানে করার কথা নয়।

হাদির প্রতি আপামর জনগণের ভালোবাসা ও আবেগকে পুঁজি করে সুযোগসন্ধানী চক্র এই অপকর্ম করে থাকতে পারে। অথবা আবেগপ্রবণ ক্ষুদ্রগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে গিয়ে পতিত শক্তি তাদের পুরোনো আক্রোশ চরিতার্থ করতে চেয়েছে। বিশেষ করে, প্রবাসী কয়েকজন সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার দায়িত্ব ও কাণ্ডজ্ঞানহীন ভূমিকা রেখেছেন। তারা কে, কখন কার এজেন্ডা নিয়ে নামেন, তা এক ধরনের ধুলায় অন্ধকার। দেশের সীমানার বাইরে থেকে তারা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। জাতি সেটুকু সম্মান তাদের দিয়েছে এবং দেবে। কিন্তু সেই প্রভাব কাজে লাগিয়ে এখন কার হয়ে দেশকে অস্থিতিশীল এবং যখন-তখন ট্যাগিং, ফ্রেমিং করে কাউকে নায়ক, কাউকে ভিলেন বানাচ্ছেন। এতে বিচার-বিবেচনা না করে অনেক সাধারণ নাগরিক বিভ্রান্ত ও উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছেন।

গভীর উদ্বেগের দিক হলোÑএকাধিক সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার প্রভাবশালী মহলের ফাঁদে পা দিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তির মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। বিএনপির দুঃসময়ে তাদের টিকিটি দেখা না গেলেও এখন অনেকে দলটির জন্য উথলানো দরদ দেখাচ্ছেন। একটি সময় বিএনপি কোথাও পা রাখতে পারছিল না। আমাদের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন নেতারা। আমরা জাতীয় প্রেস ক্লাবে, রিপোর্টার্স ইউনিটিতে কর্মসূচি পালন করতে দিয়ে হামলার শিকার হয়েছি, বিএনপি মহাসচিবকে নিরাপদ রাখতে রাত জেগে তাঁর পাশে বসে ছিলাম, কেউ যখন বিএনপি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, শহীদ জিয়ার জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতে লেখে না, তখন কলাম লিখে রোষানলে পড়েছি, সুবিধাবাদী জাতীয়তাবাদীরা তখন কোথায় ছিলেন, সেই প্রশ্ন এখন অপ্রাসঙ্গিক। গোয়েন্দাদের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে প্রেস ক্লাবের সামনে বিএনপির কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে দিতে গিয়ে জীবন বিপন্ন হয়েছে বারবার। জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে খালেদা জিয়ার প্রোগ্রাম ভন্ডুলে রাতভর যখন প্যান্ডেল ভাঙা হচ্ছিল, তখন কাউকে পাশে পাইনি। সেসব লাড়ই দলটির কাছে বিস্মৃত অতীত। নতুন নতুন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী, কলামজীবী ও ধান্দাজীবীর আবির্ভাবে প্রকৃত জাতীয়তাবাদী লেখক, কলামিস্ট এবং সাংবাদিকরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। বিএনপি নেতৃত্বও নব্যদের প্রেমে গদগদ।

জার্মানপ্রবাসী এক নব্য জাতীয়তাবাদী তার ফেসবুকে এক ভিত্তিহীন রচনা লিখেছেন। তিনি আমার দেশ-এর একটি কপির ছবি দিয়ে দীর্ঘ বয়ানে বলার চেষ্টা করেন, শুক্রবার প্রথম আলো প্রকাশিত না হওয়ায় পত্রিকাটির গ্রাহকদের আমার দেশ দেওয়া হয়েছে। তার আবিষ্কারÑআমার দেশ জানত যে প্রথম আলো আক্রমণ হবে, প্রকাশিত হবে না, সেখানে আমার দেশ দিতে হবে। তার প্রশ্নÑপ্রায় ‘তিন লক্ষাধিক প্রথম আলোর গ্রাহকের জন্য কীভাবে এতগুলো আমার দেশ ছাপা ও সরবরাহ হলো’। অতএব বিষয়টি পূর্বপরিকল্পিত ছিল এবং মাহমুদুর রহমান হামলা পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন। মারাত্মক আবিষ্কার বটে! সনাতন ধর্মাবলম্বী হঠাৎ মুসলমান হলে নাকি গরুর গোশতের প্রতি আসক্তি এতটাই উদগ্র হয় যে হুঁশজ্ঞান থাকে না। হালে প্রথম আলোর ওই কলামিস্ট ও বিএনপির থিংকট্যাংক জার্মানপ্রবাসীর সংবাদপত্র প্রকাশনা সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকলে এমন গাঁজা প্রসব করতেন না।

প্রথম আলো কখন আক্রান্ত হয়েছে আর বাংলাদেশে সংবাদপত্র কখন ছাপা ও বিলিবণ্টন হয়, তা সম্পর্কে ইউরোপে বসে সময়জ্ঞান না থাকারই কথা। আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে প্রথম আলো গতকাল শনিবারের পত্রিকায় যে বিবরণ দিয়েছে, তাতে সময় বিস্তারিত উল্লেখ আছে। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছেÑ‘রাত পৌনে ১২টার দিকে আগে থেকে অবস্থান নেওয়া এবং নতুন আসা হামলাকারীরা একসঙ্গে প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলা শুরু করে।’ দেশের প্রায় সব সংবাদপত্র ঢাকা মহানগর ছাড়া সারা দেশের পত্রিকা ছাপে রাত ৯টার পরপর। ১১টার মধ্যে ঢাকার বাইরের সব পত্রিকা নির্ধারিত পরিবহনযোগে চলে যায়। অতএব ঢাকার বাইরে প্রথম আলোর স্থলে আমার দেশ সরবরাহের তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। টেকনিক্যাল কারণেই এটা অসম্ভব। শুক্রবার ঢাকার বাইরের জন্য আমার দেশ-এর ছাপা ও প্রচারসংখ্যা অন্যান্য দিনের মতোই ছিল। বৃহস্পতিবার রাতে যথারীতি আগের চাহিদা অনুযায়ী প্রথম আলো আক্রান্ত হওয়ার অনেক আগেই চলে গেছে। সেখানে প্রথম আলোর গ্রাহককে আমার দেশ দেওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। কেউ চেয়ে নিলে বা হকার তার কোনো গ্রাহককে নিজে থেকে দিয়ে থাকলে তা একেবারেই ব্যতিক্রম। খোঁজ নিয়ে জানা গেছেÑপ্রথম আলোর ঢাকার বাইরের যেসব পত্রিকা ঢাকায় মুদ্রিত হয় (কিছু এলাকার পত্রিকা ঢাকার বাইরেও মুদ্রিত হয়), সেসব পত্রিকা ছাপা হয়ে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে গাড়ি ছেড়ে যায়। কিন্তু আক্রান্ত হওয়ার পর তারা সিদ্ধান্ত নেয়, যেহেতু ঢাকায় সরবরাহ করা যাবে না, সে কারণে ঢাকার বাইরের পত্রিকা বিতরণও বন্ধ রাখার। পথে থেকে পত্রিকাবাহী গাড়ি ফিরিয়ে আনার তথ্যও পাওয়া গেছে।

এবার আসা যাক নগর সংস্করণের ব্যাপারে। প্রথমেই জানিয়ে রাখি, ঢাকায় কোনো সংবাদপত্রের প্রকৃত সার্কুলেশন বর্তমানে ৬৫ হাজার কপির ওপরে নয়। দুটি হকার সমিতির লগবই যাচাই করলেই নিশ্চিত হতে পারবেন যে কেউ। এই নগর সংস্করণ ছাপা হয় রাত ২টার পর। প্রয়োজনে আরো পরে। এ ক্ষেত্রে হকার সমিতি চাইলে বিশেষ পরিস্থিতিতে তাদের চাহিদা পরিবর্তন করে সরবরাহ নিতে পারে। যতটা জানা গেছে, প্রথম আলো প্রকাশিত হচ্ছে না জেনে ঢাকার হকার সমিতি শুধু আমার দেশ নয়, আরো একাধিক প্রথম সারির পত্রিকায় সরবরাহ আদেশ বাড়িয়েছে রাত ২টার পর। এটা একান্তই হকারদের ব্যবসায়িক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। মাহমুদুর রহমান প্রথম আলোর গ্রাহককে আমার দেশ খাওয়াবেন বা খাওয়াতে পারবেনÑএমন নির্বোধ নন। দুটি পত্রিকার গ্রাহকশ্রেণি সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শ ও রুচির। তাছাড়া পত্রিকা যত বেশি ছাপা হয়, তত বেশি লোকসান। পত্রিকা বিক্রি করে কোনো পত্রিকারই ছাপা খরচ ওঠে না। আসলে ফ্যাসিবাদী শাসনে সবচেয়ে মজলুম একজন সম্পাদককে সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মনগড়া অপবাদ দিয়ে তারা সামনের ক্ষমতার হালুয়া-লুটির ভাগ নিশ্চিত করতে চান।

আরেক প্রবাসী ইনফ্লুয়েন্সার মাহমুদুর রহমান কীভাবে বিমানবন্দরে হাদির লাশ গ্রহণ করতে গিয়েছেন, সেই প্রশ্ন তুলে জাবর কেটেছেন। বিশেষ মহলের ছোতা প্রকাশের দাসত্ব কবুল করলে মগজ গোবরে পর্যবসিত হয়। পুরোনো চাকরির কারণে লোকে বলে বুদ্ধিও নাকি হাঁটুর নিচে নেমে গেছে। আল্লাহ মালুম। হাদিকে নিয়ে নিজের লেখায় মাহমুদুর রহমান জানান দিয়েছেন তরুণ তুর্কির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে গভীরতা। হাদির পরিবারের চাওয়া অনুযায়ী গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে অনেক দায়িত্বই পালন করছেন এই নির্ভীক সম্পাদক। এ নিয়ে চুলকানির চিকিৎসা বিদেশে না থাকলে দেশে এসে বিখ্যাত মলম ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।

সর্বশেষ এক হতাশাজনক ঘটনা উল্লেখ প্রাসঙ্গিক মনে করছি। শুক্রবার রাতে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রেস ব্রিফিং করে সাংবাদিকদের হাতে একটি বিবৃতি ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাতে ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর পরবর্তী ১১টি সহিংস ঘটনার উল্লেখ করা হয়। হতাশা ও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষর করে যে ১১টি ঘটনার কথা উল্লেখ করে উদ্বেগ, নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তার অনেকগুলো ঘটনা ভিত্তিহীন। তেমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি দেশে। এর মধ্যে খুলনায় ভারতীয় হাইকমিশনের কার্যালয় ও বাসভবনে হামলার কোনো ঘটনাই ঘটেনি, যেটি তাঁর তালিকায় এক নম্বরে স্থান পেয়েছে। ৮ নম্বরে ময়মনসিংহে এক হিন্দু যুবককে ঝুলিয়ে, পিটিয়ে হত্যার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যার সঙ্গে হাদির মৃত্যুসংবাদ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। সেখানে হিন্দু যুবকের ধর্ম অবমাননার প্রতিক্রিয়ায় ঘটনাটি ঘটে রাত ৯টার আগে। আর ওসমান হাদির মৃত্যুসংবাদ আসে রাত ১০টার দিকে।

বিএনপি মহাসচিবের বিবৃতিতে রাজশাহীতে প্রথম আলো কার্যালয়ে হামলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ৭ নম্বর পয়েন্টে। অথচ অন্য কয়েকটি স্থানে প্রথম আলোর কার্যালয় আক্রান্ত হলেও, রাজশাহীতে তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলোÑ১১টি সহিংস ঘটনার তালিকা প্রথম ফেসবুকে পোস্ট করেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এসএম জাকির হোসেন। সেটা কপি করে পোস্ট দেন আলোচিত সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার জুলকারনাইন সায়ের। যাচাই না করে হুবহু কপি করে বিবৃতি দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বিএনপির মিডিয়া সেলের ফেসবুক পেজ ও দলের পেজবুক পেজেও সেটি হুবহু পোস্ট করা হয়। কপি করার ক্ষেত্রে এতটাই তাড়াহুড়ো ও নির্ভর করেছেন, যে বানান ভুল পর্যন্ত দেখতে পারেননি। ৫ নম্বরে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের স্থলে ‘কালচালার’ এবং ১১ নম্বরে ‘নিউএজ’র পরিবর্তে ‘নিউজ এজ’ রয়েছে। এ দুটো ভুল ছাত্রলীগ নেতা ও জুলকারনাইন সায়েরের পোস্টেও ছিল।

শহীদ ওসমান হাদি বিশেষ কোনো দল বা প্রচলিত কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের ধারক ছিলেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার ভিডিও ক্লিপগুলো প্রমাণ করে সরকার থেকে শুরু করে প্রায় সব দলের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন তিনি। হাদি জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে যতটা উজ্জ্বল ছিলেন, তার চেয়েও সমুজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন জুলাইয়ের লক্ষ্য অর্জনে। অভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে যখন পতিত শক্তি প্রতিবিপ্লবের স্বপ্নে মরিয়া, তখন বুকচিতিয়ে অভ্যুত্থানের পক্ষে লড়েছেন। সংস্কার, বিচার, ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী লড়াই, কোনো প্রশ্নেই আপস করেননি এই তরুণ বিপ্লবী। সেই আপসহীনতার মূল্য চুকাতে হলো জীবন দিয়ে।

অবিস্মরণীয় গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া আওয়ামী নেতৃত্বের পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ভন্ডুল করা। একই সঙ্গে তাদের প্রায়োরিটিতে রয়েছে, অভ্যুত্থানে সংগঠকসহ ফ্রন্টলাইনারদের জীবন বিপন্ন করে ভীতি ছড়ানো ও গণহত্যার চলমান বিচারকে বাধাগ্রস্ত করা। গুম, খুনের বিচার প্রক্রিয়ায় এরই মধ্যে যেসব প্রভাবশালী জড়িয়ে পড়েছেন, তারাও ঘোলাটে পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বিচার ও গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বাধাগ্রস্ত করতে চায়। অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলো নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যকে সংহত করে অভিন্ন পথরেখায় হাঁটলেই শুধু বহুল কাঙ্ক্ষিত সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। তা না হলে বিবদমান কোনো শক্তিই রক্ষা পাবে না। এই অনুধাবনে যত বিলম্ব হবে, ক্ষতি ও ঝুঁকি ততই বাড়বে। নিজেরা পানি ঘোলা করে দিয়ে পরাজিত শক্তির টার্গেট শিকার করার সুযোগ করে দেব কি নাÑসেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনই।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষ