Image description

ঢাকার গোপীবাগে ছয় খুন মামলার তদন্ত এক যুগেও সম্পন্ন হয়নি; কবে নাগাদ হবে, তাও নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, ‘অনেক সময়’ লাগবে।

২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর গোপীবাগে নিজ বাসায় কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুকসহ ছয়জন খুন হন।

এ ঘটনায় তার ছেলে আব্দুল্লাহ আল ফারুক সে রাতেই ওয়ারী থানায় মামলা করেন।

থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ, কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের হাত ঘুরে মামলার তদন্ত ভার এখন সিআইডিতে।

এ পর্যন্ত ১৪৭ বার সময় নিয়েও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি সংস্থাটি।

সর্বশেষ গত ৩০ নভেম্বর মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ছিল। কিন্তু ওই দিনও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মেট্রো সিআইডি পুলিশের পূর্ব বিভাগের পরিদর্শক এইচএম রেজওয়ানুল ইসলাম প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেননি।

এজন্য ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জামসেদ আলম আগামী ১৪ জানুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করেছেন বলে জানিয়েছেন প্রসিকিউশন পুলিশের এসআই সোয়ানুজ্জামান।

মামলা সম্পর্কে যোগাযোগ করা হলে তদন্ত কর্মকর্তা রেজওয়ানুল ইসলাম বলেন, "মামলাটি তদন্তাধীন। দীর্ঘদিন আগের ঘটনা। বিষয়টা দেখছি। মামলার বাদীকে ডেকেছি, অন্যদের সাক্ষ্য নিয়েছি। তদন্তে অনেক সময় লাগবে। অনেক দিন আগের ঘটনা।"

মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেন, "১২ বছরেও মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা কয়েক বার ফোন দিয়েছিল, ব্যস্ততায় দেখা করতে পারিনি।

“দেখেন আগে যে কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি বলছিলেন, বিভিন্ন জঙ্গিবাদ কর্মকাণ্ডে জড়িতরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এজন্য কয়েকজনকে তিনি গ্রেপ্তার করছিলেন এবং অনেকে নাকি স্বীকারোক্তি দিয়েছে৷"

তিনি বলেন, "কিন্তু বর্তমান সরকার বলছে, দেশে কোনো জঙ্গিবাদী ছিলই না, আগের সরকারের সাজানো নাটক ছিল। তাহলে এই বিষয় নিয়ে আসলে আমার কী বলার থাকতে পারে? এতদিন কথা ছিল মামলার চার্জশিট দিয়েই দিবে। কিন্তু এখন এসে শুনছি, কোনো জঙ্গি ছিল না। এটা নিয়ে তো কিছুই বলার নেই। ন্যায় বিচার পাওয়ার আশা সবসময় ছিল, সবসময় থাকবে।"

মামলার বিবরণ অনুযায়ী, লুৎফর রহমান ফারুক পীর ছিলেন। তার অনেক মুরিদ বাসায় যাতায়াত করতেন। নিজেকে ইমাম মাহদীর প্রধান সেনাপতি দাবি করতেন তিনি। তার ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে প্রচলিত ধর্মীয় মতাদর্শের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে পার্থক্য ছিল। যার কারণে রাজধানীর বিবিরবাগিচায় লুৎফর রহমানের ওপর হামলা চালানো হয় এবং গেন্ডারিয়া ও গোপীবাগে হামলার চেষ্টা করা হয়।

মামলায় বলা হয়, ২০১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে ১০-১২ জন লোক ধর্মীয় বিষয়ে জানার জন্য এসেছে বলে জানায়। লুৎফর রহমান ফারুক সবাইকে দরবার ঘরে বসতে দিয়ে তাদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য মুরিদ শাহিনকে বাজারে পাঠায়।

এরপর সন্ধ্যা ৬টার দিকে লুৎফর রহমান ফারুক, তার বড় ছেলে সরোয়ার ইসলাম ফারুক, তার মুরিদ শাহিন, মজিবুর, মঞ্জুরুল আলম, রাসেল ভূইয়া-সবাইকে হত্যা করা হয়।

মামলার বর্ণনা অনুযায়ী, আসামিরা লুৎফর রহমান ফারুকের তাওই, আনোয়ার মিস্ত্রি ও অন্য একজন মুরিদকে হাত-পা-মুখ বেঁধে দরবার রুমে ফেলে রাখে।

“ঘটনার সময় আসামিদের একজন বলে, ‘ওনার (লুৎফর রহমান ফারুক) আরেক ছেলে আছে আবদুল্লাহ, আবদুল্লাহ কোথায়?’ এরপর লুৎফর রহমান ফারুকের স্ত্রী ও তার পুত্রবধুর কাছে আসামিরা বলে যায়, ‘এই ছয়জনকে মারার অর্ডার ছিল, ছয়জনকে মারছি। তোরা যদি পুলিশ কিংবা মিডিয়ার কাছে মুখ খুলোস, তাহলে তোদের অবস্থা ওদের মতো হবে’।”

মামলার নথিতে দেখা গেছে, এই মামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- হাদিসুর রহমান সাগর, জাহিদুল ইসলাম, মামুনুর রশীদ রিপন, আব্দুল গাফ্ফার, তরিকুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর হোসেন, রফিকুল ইসলাম, সৈয়দ জিয়াউল ইসলাম ওরফে জিতু ওরফে নিরব ওরফে নিয়ন ওরফে হিমু, আবু রায়হান ওরফে মাহমুদ ওরফে আ. হাদী, আব্দুল্লাহ আল তাসনিম, মো. গোলাম সরোয়ার, মো. আল আমিন ও আজমির অমিত।

মামলার তদন্তের দীর্ঘসূত্রিতায় তারা সবাই জামিনে আছেন।

আজমির ও তরিকুলের আইনজীবী মামুন মিয়া বলেন,"আসামিরা বছরের পর বছর এই মামলায় ঘুরতেছে, অথচ তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। এই মামলায় কতজন তদন্তকারী কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে, এটাও জানা নেই। আমরা তো চাই যে, তদন্ত প্রতিবেদন হয়ে যাক; এতে ভালো-খারাপ যাই হোক না কেন। কারণ সাক্ষ্য গ্রহণে প্রমাণ হবে আসামির সাজা হবে, নাকি খালাস পাবে।"

রায়হান ও রফিকুলের আইনজীবী শরীফুল ইসলাম তানভীর বলেন, "রাষ্ট্র পক্ষ, মামলার বাদীপক্ষ ও আসামিপক্ষ- সবাই তো চায় দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। আসামিরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মাসে মাসে হাজিরা দিতে হচ্ছে। আসামিদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এবং মানসিক চাপ বাড়ছে। রাষ্ট্রেরও সময় ও আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।

“তদন্তকারী সংস্থা এ পর্যন্ত এটার তথ্য উদঘাটন করতে ব্যর্থ হয়েছে, এটা চরম দুর্ভাগ্য। মামলা নিয়ে একটু সিরিয়াসলি তদন্তকারী সংস্থার কাজ করা উচিত। এই সংস্থাকে পরিবর্তন করে আরেক সংস্থাকে দিলে আমার মনে হয়, দ্রুত এগোতে পারবে।"

তিনি বলেন "আসামির কোনোভাবেই এটার মধ্যে বিন্দুমাত্র জড়িত নন। বিচার তো দূরে থাকুক, সুষ্ঠু তদন্ত হলে আমার আসামিরা চার্জশিট থেকেই বাদ যাবে। কারণ এটার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই।"