Image description

মাহমুদুর রহমান

বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক পথপরিক্রমার একটি অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন শুরু করছি।

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের ব্যর্থ ও অত্যাচারী একদলীয় বাকশাল শাসনব্যবস্থার রক্তাক্ত পতনের পর জেনারেল জিয়া প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক কাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশে নবগঠিত বিএনপি এবং পুনর্জন্মপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সমন্বয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অনুরূপ একটি দ্বিদলীয় রাজনৈতিক সিস্টেম গড়ে উঠেছিল। আশির দশকে জেনারেল এরশাদ তার জাতীয় পার্টিকে তিন নম্বর দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেও সফল হননি।

সেনাবাহিনী থেকে এলেই যে জিয়ার মতো জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক হওয়া যায় না সেটা সম্ভবত এরশাদ বুঝতে পারেননি। রাজনীতিতে তাকে অনেক পেছনে ফেলে আশি ও নব্বই দশকে বেগম জিয়া একজন গৃহবধূ থেকে প্রয়াত স্বামীর মতোই অনন্যসাধারণ ‘ক্যারিশম্যাটিক’ নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। অন্যদিকে দানব প্রকৃতির শেখ হাসিনা ভারতের প্রেসক্রিপশনে টানা পনেরো বছর ফ্যাসিস্ট শাসন চালানোর পরিণামে শেখ পরিবারসহ ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পাশাপাশি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেও ধ্বংস করে গেছেন।

জুলাই বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপির অনায়াসে রাজনৈতিক একাধিপত্য কায়েম হওয়ার কথা ছিল। দলটির নেতাদের আচরণেও সেই দম্ভ প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল। কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যে সব রাজনৈতিক পণ্ডিতকে অবাক করে দিয়ে ধর্মভিত্তিক জামায়াতে ইসলামীর অবিশ্বাস্য দ্রুততায় উত্থান ঘটেছে। চারটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের একচেটিয়া ভূমিধস বিজয় প্রমাণ করেছে যে, দেশের শিক্ষিত তরুণরা রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাইছে।

এরই মধ্যে সর্বজনশ্রদ্ধেয় খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা এবং বিএনপির কার্যত প্রধান নেতা তারেক রহমানের দেশে অনুপস্থিতি দলটির নেতাকর্মীদের অনেকটাই হতোদ্যম করে ফেলেছে। জুলাই বিপ্লবী তরুণদের দল এনসিপি বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও নানা কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। এদিকে প্রত্যাশিত জাতীয় নির্বাচনের দিন দ্রুত এগিয়ে আসছে। আর মাত্র দুই মাসের মধ্যে ভোটাররা তাদের এলাকার সংসদ সদস্যদের বেছে নেওয়ার সুযোগ পেতে যাচ্ছেন। বেশ কিছুদিনের জল্পনা-কল্পনা শেষে জুলাইযোদ্ধারা বলতে গেলে একেবারে চূড়ান্ত সময়ে একটা মোর্চার ঘোষণা দিতে পেরেছেন। কেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন একটি মোর্চার প্রয়োজন ছিল, তার ব্যাখ্যা দিতেই আমার আজকের এই লেখা।

শুরুতেই বলেছি, আওয়ামী লীগের অবর্তমানে বিএনপির প্রশ্নাতীত একক নেতৃত্ব গ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ইতিহাসের অনুরাগী পাঠক হিসেবে আমি মনে করি চারটি প্রধান কারণে বিএনপি সেই সুযোগ হারিয়েছে :

১. খালেদা জিয়ার মতো অসাধারণ জনপ্রিয়তায় ধন্য এক প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতার শূন্যতা পূরণ করা বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের পক্ষে সম্ভব হয়নি। দেশের এই ক্রান্তিকালে বেগম জিয়ার নেতৃত্বের বড় বেশি প্রয়োজন ছিল। তিনি কর্মক্ষম থাকলে দল এবং রাষ্ট্রের অনেক জটিলতাই এড়ানো যেত।

২. তারেক রহমান দেশে অবস্থান করে সরাসরি নেতৃত্ব দিতে না পারায় বিএনপির মধ্যে যে শৃঙ্খলার ঘাটতি হয়েছে, তার পরিণামে শুরু থেকেই দলটিকে ঘিরে নানা অভিযোগ ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তিনি দেশে থাকলে হয়তো তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে দলকে সংগঠিত করতে পারতেন।

৩. আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ, ইয়ামিন, নাফিজ ও আনাসের মতো বাংলাদেশের শত শত তরুণ এবং কিশোর যে আবেগ, আত্মপরিচয় এবং দর্শন নিয়ে মহান জুলাই বিপ্লবে অকাতরে শহীদ হয়েছেন, সেটিকে সম্ভবত বিএনপির নীতিনির্ধারকরা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। দলটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে মনে হয়েছে, হয় তারা এদের অবদানকে অস্বীকার ও অবজ্ঞা করছেন অথবা সংকীর্ণ দলীয় দৃষ্টিতে দেখছেন। এই রাজনৈতিক নেতারা হয়তো বিস্মৃত হয়েছেন যে, এখনো অনেক অজানা শহীদের লাশ রায়েরবাজার কবরস্থানের গণকবরে রয়েছে। কত মা সেই গণকবরের পাশে বসে আহাজারি করছেন।

৪. যে ভারতের কারণে বাংলাদেশের মানুষকে দেড় দশক ধরে ফ্যাসিস্ট শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে, সেই আঞ্চলিক হেজেমনিক দেশ সম্পর্কে ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই বিএনপির নেতাদের নমনীয় ও সুবিধাবাদী বক্তব্য জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তদুপরি জামায়াতে ইসলামীর হঠাৎ উত্থানে দৃশ্যত ‘নার্ভাস’ বিএনপি নেতাদের মুক্তিযুদ্ধ, ইসলাম এবং বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি বিষয়ে আওয়ামী লীগের বহুল চর্চিত রাজনৈতিক বয়ানের অনুরূপ বক্তব্য প্রদান জনচৈতন্যে বিএনপিকে পতিত আওয়ামী লীগের সমার্থক দলে পরিণত করেছে।

বিএনপির উপরোক্ত হতবুদ্ধিকর কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী প্রায় একমাত্র ও প্রবল প্রতিপক্ষ রূপে উঠে আসায় ভারতের পক্ষে বাংলাদেশকে একটি উদীয়মান ইসলামিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে পশ্চিমা বিশ্বে নেতিবাচক প্রচারণা চালানোর মোক্ষম সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। পাকিস্তানকে মোকাবিলা করার ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে একদা বৈরী কট্টর ইসলামিস্ট আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারত এখন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালালেও দেশটির ক্ষমতাসীন বিজেপি সমর্থক প্রচারমাধ্যম নির্লজ্জভাবে জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশকে আরেক আফগানিস্তান হিসেবে বর্ণনা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে যাচ্ছে।

পবিত্রজ্ঞানে গোমূত্র সেবনকারীর মতো ধর্মান্ধরা শহীদ আনাসদের মহান বিপ্লবকে হেয় করার অপচেষ্টায় আমাদের বিরুদ্ধেই ধর্মান্ধতার অভিযোগ তুলছে। প্রফেসর ইউনূসকে পর্যন্ত তারা তালেবানের তকমা দিচ্ছে! দুর্ভাগ্যবশত বাংলাদেশের পুরোনো বাম ঘরানার নব্য বিএনপিপন্থি ‘সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার’ গোষ্ঠীর বয়ানেও দিল্লির বাংলাদেশবিরোধী বয়ানের হুবহু প্রতিধ্বনি প্রায় প্রতিদিন আমরা শুনতে পাচ্ছি।

ফ্যাসিস্ট আমলে সব আওয়ামী মিডিয়াতেও একই প্রক্রিয়ায় ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা চালানো হতো। শেখ হাসিনা নিজেও প্রায়ই বেগম জিয়াকে জামায়াতে ইসলামীর আমির বলে কটাক্ষ করতেন। সম্প্রতি প্রকাশিত বিডিআর কমিশনের প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দেশপ্রেমিক সামরিক অফিসারদের সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞে ভারত এবং আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য কীভাবে ভারতপন্থি, সুশীল মিডিয়ায় ভুয়া জঙ্গি তত্ত্ব আবিষ্কার করা হয়েছিল। প্রতিবেদনের একটি ক্ষুদ্র, সংশ্লিষ্ট অংশ নিচে উদ্ধৃত করলাম :

“১২ মার্চ ২০০৯ তারিখে দি ডেইলি স্টার পত্রিকায় ‘Terror struck back at its buster’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে কোনো নির্দিষ্ট সূত্র উল্লেখ না করে বলা হয় যে, বিডিআর হত্যাকাণ্ডে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার সুস্পষ্ট চিহ্ন আছে। প্রতিবেদনে সূত্র উল্লেখ না করে আরো বলা হয়, জঙ্গিরা (Terror elements) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিডিআরে অনুপ্রবেশ করেছে।”

অর্থাৎ রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে আওয়ামী লীগ আপাতত বিদায় নিলেও দলটির অনুসৃত ‘সেক্যুলার বনাম ইসলামিস্ট’ বাইনারির কৌশল এ দেশের ভারতপন্থিদের বয়ানে এখনো চলমান। পার্থক্য হলো, সেই সময় আওয়ামী লীগকে সেক্যুলার আদর্শের ধারক এবং বিএনপি ও জামায়াতকে ব্র্যাকেটবন্দি করে ইসলামিস্ট হিসেবে প্রচার করলেও, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন তারা বিএনপিকে জামায়াতের ব্র্যাকেট থেকে মুক্ত করে সেক্যুলার এবং জামায়াতকে ইসলামিস্ট বলে পুরোনো কায়দার প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। ভারতে একটি কট্টর চরমপন্থি হিন্দুত্ববাদী দল দীর্ঘদিন একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতায় থাকলেও তারাই উল্টো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নির্লজ্জভাবে ধর্মীয় চরমপন্থার অভিযোগ করছে।

এ দেশের দিল্লির এজেন্টরা মিডিয়ায় এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে প্রবেশ করে প্রগতিশীলতার আবরণে ভারতের পঞ্চম বাহিনীর ভূমিকায় বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী প্রচার চালাচ্ছে। সম্ভবত এই গোষ্ঠীর দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে বিএনপি সাম্প্রতিক সময়ে যে বয়ান হাজির করছে, সেটা আমার ধারণা জনআকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করছে না। ভোটের মাঠে জামায়াতে ইসলামীকে মোকাবিলা করার জন্য কেন বিএনপির নেতাদের প্রতিপক্ষের জন্য আওয়ামী লীগের মুগুরই ভালো ছিল-জাতীয় আত্মবিধ্বংসী বক্তব্য দিতে হচ্ছে সেটা তারাই ভালো জানেন। এসব বক্তব্যে দলের ভোট বাড়ছে কি না সেটা সময়ই বলে দেবে।

যা-ই হোক, এমন এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে দেশের রাজনীতিতে আদর্শিক, রাজনৈতিক এবং মেধাগতভাবে ভারতের আধিপত্যবাদ ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম সাহসী ও আধুনিক তরুণদের সমন্বয়ে একটি তৃতীয় শক্তির প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল। আশা করতে চাই যে, তরুণ জুলাইযোদ্ধাদের মোর্চা সেই তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘সেক্যুলার বনাম ইসলামিস্ট’ বাইনারিকে ভেঙে দিয়ে ভারতের অর্ধশতাব্দীব্যাপী বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণাকে অসার করে দেবে।

আসন্ন নির্বাচনে এই মোর্চার কৌশল আমাদের অজানা। তাদের রাজনীতি এখনো বিকাশমান। তাদের সংগঠিত হওয়ার জন্য সময়ও অতি সংকীর্ণ। আমাদের প্রথাগত রাজনীতিতে বিপুল অর্থের প্রয়োজনও অনস্বীকার্য। সেই বিবেচনাতেও নতুন মোর্চা ভীষণভাবে দুর্বল। এসব দুর্বলতা সত্ত্বেও তিন দলের এই উদ্যম অন্তত নতুন সম্ভাবনার আশা জাগাচ্ছে। তবে এখনো জুলাইযোদ্ধাদের অনেকগুলো ধারা বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে।

দ্রুত মুনাফার লোভ না করে এবং আত্মাভিমান পরিত্যাগ করে তাদের সবার একত্রিত হওয়া প্রয়োজন। এই তরুণদের আমি নদীর উদাহরণ দিতে চাই। গঙ্গা কিংবা ব্রহ্মপুত্রের মতো যেসব নদীকে আমরা বিশাল বলে জানি সেগুলোর প্রত্যেকটি, হিমালয়ের মতো পর্বতমালায় ছোট খরস্রোতার আকারে জন্ম নিয়ে হাজার হাজার মাইলের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আরো অনেক ছোট ছোট নদীর স্রোতোধারা বুকে ধারণ করে তবেই বিশালত্ব লাভ করেছে। অতএব, তরুণ জুলাইযোদ্ধারাও যদি ছোট ছোট দল বা গোষ্ঠীতে বিচ্ছিন্ন থাকার পরিবর্তে দেশপ্রেম ও আত্মপরিচয়ের অভিন্ন আদর্শে একীভূত হতে পারে তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সুবাতাস বইবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।