ড. হাসানুজ্জামান চৌধুরী
জুলাই গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় পতিত মাফিয়া শাসক শেখ হাসিনা এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। জুলাই গণহত্যার হুকুমদাতা হিসেবে তাদের বিরুদ্ধে অনা অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। কয়েকটি বিষয় এখানে লক্ষণীয়। প্রথমত, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই রায় হয়েছে তার আমলে প্রতিষ্ঠিত আদালতে। বিচারও হয়েছে তারই সময় করা আইনের ভিত্তিতে। দ্বিতীয়ত, সেই অনুযায়ী তিনি ক্ষমতায় থাকতে অনেকের ফাঁসির আয়োজনও করেছেন। সেই সময় ট্রাইব্যুনালে মামলার বিচার ও রায় নিয়ে শাহবাগি অসভ্য উন্মাদনাও দেখেছে পুরো জাতি। তৃতীয়ত, এখন নয়, তখনই ঘটেছে ক্যাঙারু কোর্ট এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চরম অসভ্য ও কৃত্রিম মববাজি। চতুর্থত, শেখ হাসিনাসহ সরকারের নির্দেশে তখনকার সেই সাজানো বিচারের অসংখ্য নজির আজও জাতির স্মৃতিতে উজ্জ্বল। সাজানো অভিযোগ ও সরকার পক্ষের শেখানো-পরানো সাক্ষীদের সাক্ষ্য, আসামি পক্ষের সাক্ষীদের ভয়ভীতি এবং হুমকি ও সুখরঞ্জন বালিকে অপহরণ করে ভারতের জেলে আটকে রাখা, স্কাইপ কেলেঙ্কারির কথা ভুলে যায়নি জাতি। ভুলে যায়নি কীভাবে সরকারের হুকুমে বেলজিয়ামে বসে জিয়াউদ্দিনসহ অন্যদের লেখা রায় ও চার্জ পড়ে শোনানো হতো আদালতে। আরো মনে পড়ে, সেই ‘আমি দাঁড়াইয়া যামু, আপনি আমারে বসাইয়া দিবেন, মানুষ দেখবে আমাদের মধ্যে কোনো খাতির নাই’, ‘সরকার গেছে পাগল হইয়া, তারা একটা রায় চায়’ প্রভৃতি ডায়ালগের কথা।
সাঈদীর কোনো দোষ-প্রমাণ না হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে শাস্তি দেওয়ার বাধ্যবাধকতার খবর উন্মুক্ত হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে তখনকার আইসিটিতে বিচারাধীন মামলা চূড়ান্তভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। এতৎসত্ত্বেও কয়েকজনের ফাঁসির রায় রাতারাতি কার্যকর করা হয়েছিল। সারা দেশে অমানিশার মধ্যেও অনেক মানুষ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে এবং নির্বিচারে হত্যা করে দমন করা হয় সেই প্রতিবাদ। লাশ কবর দিতেও বাধা দেওয়া হয়েছে শোকার্ত পরিবারগুলোকে। শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘিরে এমন কিছু ঘটেনি।
১৭ নভেম্বর হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার যে রায় প্রকাশ হলো, তা নিয়ে পতিত ফ্যাসিবাদের দলান্ধ সমর্থক, সহযোগী, সুবিধাভোগী ও তথাকথিত সুশীলরা আনাচে-কানাচে থেকে বানোয়াট বিবৃতিতে যা কিছুই বলুক না কেন এবং সীমান্তের ওপার থেকে যত অপপ্রচার চালানো হোক না কেন, এসবের কিছুই নিছক মিথ্যাচারের বাইরে যায়নি। এবারের আইসিটি আদালত ও তার বিচার যেকোনো মানদণ্ডে আন্তর্জাতিক উচ্চতায় পৌঁছেছে। হাসিনার আইনকে ভিত্তি হিসেবে রেখেই আদালত পুনর্গঠন করা হয়েছে আন্তুর্জাতিক মান অনুযায়ী। হাসিনার আইনেই ছিল, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধও একই আইনে বিচার্য হবে। অতএব এখানে হাসিনার জন্য প্রযুক্ত বিধান তারই কর্তৃক সৃষ্ট। আন্তর্জাতিক আইন আদালতের সব স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস এখানে প্রযুক্ত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছায়। রোম স্ট্যাটিউটের সংশ্লিষ্ট সবকিছু এই আইন ও বিচারে সম্পর্কিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পর্যবেক্ষকের সুযোগ রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও অন্যান্য ইনস্ট্রুমেন্টের স্বীকৃতি দিয়ে এখানে কোনো ক্যাঙারু কোর্ট বা ক্যামেরা ট্রায়াল হয়নি। পুরো বিচার প্রক্রিয়া উন্মুক্ত আদালতে, টেলিভিশনসহ সব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে লাইভ প্রচার করা হয়েছে বিচারের রায়সহ। বিচারের স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে এটি একটি নজির বাংলাদেশের ইতিহাসে। বিশ্বের জন্যও এ বিচার একটি উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় রায় প্রকাশের দিন গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় বড়পর্দায় বিচারের সমগ্র রায়ের পাঠ এবং রায় দেখানো হয়েছে। পুরো বিচারকালে সাংবাদিকদের কাছে প্রসিকিউশন ও ডিফেন্স উন্মুক্ত থেকেছেন।
হাসিনা, কামাল ও মামুনের কাছে সব নোটিস পাঠানো হয়েছে। হাসিনাকে আদালতে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। তার সম্পত্তিতে সব ক্ষেত্রে আদালতের নোটিস সেঁটে দেওয়া হয়েছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। দশতম, হত্যাকাণ্ডের শিকারদের পরিবার ও অন্য প্রত্যক্ষদর্শীদের সব সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ করা হয়েছে অতি বিস্তারিতভাবে। যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। প্রসিকিউশন ও ডিফেন্স পুরো বিষয়টি অবগত থেকে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করেছে। আদালতে কখন কী হচ্ছে, সবকিছু জানিয়েছে। সংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ডের সব অডিও-ভিডিও রেকর্ড উপস্থাপন করা হয়েছে। এগুলোর সত্যতা এবং এআই-সংশ্লিষ্টতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ল্যাব, বিষয়-বিশেষজ্ঞ, সিআইডি টিম, পুলিশ, বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী দ্বারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে এবং যথার্থ নিরূপণ করা হয়েছে। হাসিনার কণ্ঠ, বক্তব্য, নির্দেশ, অবগতকরণসহ সব হুকুমের, হত্যাকাণ্ড পরিচালনার নির্দেশনাসহ যাবতীয় বিষয়, টেলিফোন আলাপের বিস্তারিত প্রামাণ্য রেকর্ডগুলো এআই কি না—তা ব্যাপক ও গভীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সত্যতা মিলেছে। দ্বাদশত, সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষভাবে হত্যার নির্দেশ, সব বাহিনীর প্রধানদের দেওয়া নির্দেশ; কাদের, কামাল, ইনু, তাপসের সঙ্গে সব আলোচনার রেকর্ড এনটিএমসি ও বিটিআরসির রেকর্ডপত্র সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে মামলায়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পালিয়ে থাকা হাসিনার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যাবতীয় কল রেকর্ড ও ক্রোধ। প্রসিকিউশন পূর্ণাঙ্গভাবে যা কিছুই উপস্থাপন করেছেন, তা সম্পূর্ণভাবে ডিফেন্স কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। যেহেতু হাসিনা, কামাল সাঙ্গপাঙ্গসহ ভারতে পালিয়ে গেছেন এবং আদালতে নোটিস দেওয়া সত্ত্বেও হাজিরা দেননি, সেহেতু রাষ্ট্রের তরফ থেকে ডিফেন্ড করার জন্য সিনিয়র আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে। পুরো বিচার প্রক্রিয়ায় যুক্তি ও যুক্তিখণ্ডন উন্মুক্তভাবে করা হয়েছে এবং গণমাধ্যমে সব জানানো হয়েছে। হাসিনার উসকানি, হুকুম, নির্দেশনা, হত্যার প্রত্যক্ষ নির্দেশ, আন্দোলন ও অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতাকে গুলি করে শেষ করে দেওয়ার বক্তব্যও প্রমাণিত হয়েছে সন্দেহাতীতভাবে। হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যা করা, ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নিশ্চিতকরণ ও আক্রমণ, লেথাল ওয়েপন বা মারণাস্ত্র ব্যবহার করার প্রত্যক্ষ নির্দেশ, টার্গেট কিলিংয়ের বিষয়সহ সবকিছুর সঙ্গে হাসিনা, কামাল ও মামুনের প্রত্যক্ষ সংশ্লেষ প্রমাণিত হয়েছে। রাজসাক্ষী হয়ে যাওয়া তৎকালীন পুলিশের আইজি মামুনের স্বীকারোক্তিতে একেবারেই নিশ্চিত হওয়া গেছে, হত্যার সঙ্গে হাসিনা ও কামালের প্রত্যক্ষ সংশ্লেষ ছিল, তারা উভয়ে জুলাই গণহত্যার হুকুমদাতা। লক্ষণীয় যে, প্রসিকিউশন কর্তৃক উত্থাপিত যাবতীয় প্রামাণ্য বিষয় মামুনের প্রামাণ্য স্বীকারোক্তি দ্বারা ডাবল প্রমাণ হিসেবে এসেছে।
অন্তর্বর্তী সরকার আদালতের কর্মকাণ্ডে এত দীর্ঘ সময়ে কোনোভাবেই সামান্য হস্তক্ষেপ করেনি। প্রসিকিউশনকে পতিত ফ্যাসিবাদ অসংখ্যবার হুমকি দিয়েছে নানাভাবে। কিন্তু ডিফেন্সকে তার যুক্তি উপস্থাপনে কেউ সামান্যতম শাসায়নি। দেশ-বিদেশে এই মামলা সব মহল স্পষ্ট দেখেছে ও জেনেছে। মিনাক্ষী গাঙ্গুলী, আওয়ামী ষণ্ডা ও নজিরবিহীন লুটপাট করে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট মাফিয়া রানি ও হিন্দুস্তানি আধিপত্যবাদীরা ছাড়া আর কেউ সামান্যতম আপত্তি তোলেনি। দেশবাসীর চোখের সামনে শেখ হাসিনা প্রমাণ রেখে সব হত্যাকাণ্ডে নিজের সংশ্লেষ উন্মোচিত করেছেন। সমগ্র দেশবাসী সব ঘটনা নিজেরা দেখেছে। সে জন্যই তারা খুনি হাসিনাকে উৎখাত করেছে। বিচার চলাকালে শাহবাগি কায়দায় হাসিনাবিরোধীরা কোনো মববাজি করেনি। অত্যন্ত শান্ত থেকেছে পুরো বিচারকালে এবং রায় ঘোষণার দিন। তারা তাদের চোখের সামনে দেখা হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ দ্বিতীয়বার পেয়েছে আদালতের সিদ্ধান্তের পর। অতএব, আবু সাঈদ হত্যা, চানখাঁরপুল হত্যা, আশুলিয়া হত্যা ও লাশ পোড়ানো, হেলিকপ্টার থেকে গুলি, ড্রোন দিয়ে অবস্থান নিশ্চিতকরণ ও হত্যা, লেথাল ওয়েপন ব্যবহার করার নির্দেশ প্রদানসহ সর্ব অর্থেই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে হাসিনার সংশ্লেষ শতভাগ প্রমাণিত।
কাজেই জুলাই হত্যাকাণ্ডে হাসিনার সংশ্লেষ নিয়ে প্রশ্ন তোলার সামান্যতম অবকাশ নেই। এখন অতিদ্রুত সব প্রচেষ্টা চালিয়ে হাসিনা ও কামালকে হাসিনারই দ্বারা সম্পাদিত ভারতের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তি অনুযায়ী ফেরত এনে রায় কার্যকর করের ব্যবস্থা করতে হবে। ভারতের সঙ্গে বন্দিবিনিময় চুক্তি করে হাসিনা অনুপ চেটিয়া, পরশ বড়ুয়াসহ উলফা গেরিলা নেতাদের গ্রেপ্তার করে হিন্দুস্তানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার রায় নিঃসন্দেহে জুলাই গণহত্যার বিচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জুলাই গণহত্যাসহ সাড়ে ১৫ বছরে সমস্ত গুম, খুন ও অপহরণ নির্যাতনে বিচার সম্পন্ন করতে হবে এবং বিচারে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ বিষয়ে কোনো আপস মানবে না জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের কোনো মানুষ।
লেখক : অধ্যাপক (অব.), রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়