ড. আলী রীয়াজ
দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বলতে এমন একটি সিস্টেমকে বোঝানো হয় যেখানে আইনসভা বা সংসদ দুটি পৃথক কক্ষ নিয়ে গঠিত। একটি কক্ষকে ‘উচ্চ কক্ষ’ এবং অন্যটিকে ‘নিম্ন কক্ষ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মূলত, এই ধরনের আইনসভায় ক্ষমতার ভারসাম্য বা ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ নিশ্চিত করা হয়। আইন প্রণয়নে দুইবার পর্যালোচনার সুযোগ থাকে। নিম্নকক্ষে যদি কোনো ভুল বা ক্ষতিকর আইন পাস হয়ে যায়, উচ্চকক্ষ সেটিকে প্রতিরোধ করতে পারে।
সাধারণত এই ধরনের আইনসভায় নিম্ন কক্ষের সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। তাদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকে, তবে সেই আইন কার্যকর করতে উচ্চ কক্ষের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। এইভাবে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা চালু থাকলে জনগণের প্রতিনিধি (নিম্ন কক্ষ) তাদের নিজেদের স্বার্থে বা স্বৈরাচারী উদ্দেশ্যে কোনো ইচ্ছামত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারবে না।
উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের নিয়ম রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের উচ্চকক্ষের সদস্যরা সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। যুক্তরাজ্যে ‘হাউস অব লর্ডস’ নীতির মাধ্যমে উচ্চকক্ষের সদস্য নিযুক্ত করা হয়। আবার প্রতিবেশি দেশ ভারতে সংসদ সদস্যদের দ্বারা উচ্চকক্ষের সদস্য নির্বাচিত হয়।
দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের অভিজ্ঞতা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। প্রাথমিকভাবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের ধারণা আসে পার্লামেন্টে সমাজের যথাসম্ভব বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য। আমরা যখন গণতন্ত্র অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠনের সিস্টেমে যাই তখন এখানে কিছু সমস্যা তৈরি হয়। ধরি একটি দল ৫১ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গঠন করল। অর্থাৎ এখানে সমাজের প্রায় অর্ধেক মানুষই সরকারের বাইরে থেকে গেল। এটা একটি সমস্যা।
এছাড়াও সামগ্রিকভাবে আমরা দেখতে পাই, সমাজের মধ্যে বহু ধরনের মানুষ রয়েছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সরকার গঠন করলে সেখানে কি এই সকল ধরনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায়? সেটা করা যায় না। সেই জায়গা থেকে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের যুক্তিটা তৈরি হয়। দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা থাকলে উচ্চকক্ষে সকল ধরনের মানুষের প্রতিনিধিত্ব যুক্ত করা যায়।
একদিকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রয়োজনীয়তা সামনে আসছে। অন্যদিকে, বিভিন্ন দেশে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট চর্চা করতে গিয়ে দেখা গেছে এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। নেতিবাচক দিকগুলো হলো - ছোট দলের কাছে বড় দল জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। গুটিকয় মানুষ মিলে বৃহৎ মানুষের সিদ্ধান্তকে জিম্মি করে ফেলছে। ফলে সবকিছু মিলে একটি ব্যালেন্সের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে।
অনেক দেশ এই ব্যালেন্সের ক্ষেত্রে কিছু কৌশল অবলম্বন করেছে যেমন- পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একদল সরকার গঠন করছে। সেই দল দেশের মোট ভোটারের যে পারসেন্টেজে ভোট পেয়েছে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে তাদের সেই পার্সেন্টেজে প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এভাবে যখন ২ হাউজের মধ্যে ক্ষমতার বন্টন হবে তখন এক পক্ষ অন্য পক্ষকে জিম্মি করে ফেলতে পারবে না।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার আলাপ আসছে। কারণ মানুষ দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য দেখতে চায়। আমরা দেশের চারটি ভালো নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখব, বাংলাদেশে কোনো দল পঞ্চাশ শতাংশ ভোট পায়নি। সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশের কাছাকাছি পর্যন্ত ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ এই সিস্টেমে সরকার গঠন হলে সেখানে ৬০ শতাংশ মানুষের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকছে না। এই ৬০ শতাংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে।
এছাড়া দেশের জ্ঞানী গুণী মানুষ, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যাদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন কিন্তু তারা নির্বাচনে যাবেন না, এই ধরনের মানুষদেরকেও পার্লামেন্টের সঙ্গে যুক্ত করতে হলে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট প্রয়োজন হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের আইডিয়াটাই আসে ক্ষমতার এক ধরনের চেক এন্ড ব্যালেন্স তৈরি করার জন্য। একই সঙ্গে বৃহৎ কমিউনিটির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য।
ড. আলী রীয়াজ: সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান