জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকে (সম্মান) আবেদন ফি ও কোটার ক্ষেত্রে এখনো ফ্যাসিস্ট আচরণ করা হচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির নিজস্ব ফান্ডে হাজার কোটি টাকার বেশি থাকার পরও ভর্তি আবেদনে তারা উচ্চমূল্য নির্ধারণ করেছে। এমনকি আগামী শিক্ষাবর্ষের ভর্তিতেও আগের মতো মুক্তিযোদ্ধা ও পোষ্য কোটা বহাল রাখা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, গত সোমবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টা থেকে আবেদন শুরু হয়েছে, যা ২৮ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত চলবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে আবেদন ফরম পূরণ করতে হবে এবং প্রাথমিক আবেদন ফি বাবদ ৭০০ টাকা জমা দিতে হবে। এমসিকিউ (মাল্টিপল চয়েজ কোয়েশ্চেন) পদ্ধতিতে ১০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষা আগামী ৩ মে অনুষ্ঠিত হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) আবেদন ফি আগের বছর ৭০০ টাকা থাকলেও সরকারের পটপরিবর্তনের পর ৪৭তম বিসিএস থেকে তা কমিয়ে ২০০ টাকা করা হয়েছে। এই আবেদন ফির মধ্যে এমসিকিউ পদ্ধতিতে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, একাধিক বিষয়ের লিখিত পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শুধু এমসিকিউ টাইপের ১০০ নম্বরের পরীক্ষার জন্য আবেদন ফি ৭০০ টাকা নির্ধারণ করেছে।
সূত্র জানায়, গত শিক্ষাবর্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা ছাড়া জিপিএ (গ্রেড এভারেজ পয়েন্ট)-এর ভিত্তিতে ভর্তি করেছিল। এ জন্য আবেদন ফি নিয়েছিল ২৫০ টাকা। এবার থেকে তারা ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত শিক্ষাবর্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বিভিন্ন কলেজে স্নাতকে (সম্মান) আড়াই লাখ আসনের বিপরীতে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ শিক্ষার্থী আবেদন করেন। এবারও যদি একই সংখ্যক শিক্ষার্থী আবেদন করেন, তাহলে আবেদন ফি থেকেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ কোটি টাকা আয় হবে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, শিক্ষার্থী প্রতি ৭০০ টাকা করে আবেদন ফি নেওয়া হলেও এখান থেকে আবেদনকৃত কলেজকে দেওয়া হবে ১৫০ টাকা। আর কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা বা পরীক্ষা গ্রহণের জন্য কেন্দ্রকে ১০০ টাকা করে দেওয়া হবে। তার পরও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে থাকবে শিক্ষার্থীপ্রতি ৪৫০ টাকা করে। সেই হিসাবেও প্রায় ২৯ কোটি টাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে থাকবে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন প্রণয়ন ও মেশিনে ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) শিট দেখাসহ অন্যান্য কাজে ব্যয়ের পরও কোনোভাবেই এক-তৃতীয়াংশের বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়।
জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভর্তি পরীক্ষার কাজটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর আবেদনের পেছনে নানা ধরনের কাজ করতে হয়। আমরা সবার সঙ্গে আলোচনা করে ভর্তি ফি নির্ধারণ করেছি। এখান থেকে কলেজগুলোর জন্য একটা অংশ ও কেন্দ্রের জন্য আরেকটা অংশ রাখতে হয়। এর পরও যদি শিক্ষার্থীদের দাবি থাকে, তাহলে আমরা ভর্তি ফির ব্যাপারটি আবার ভেবে দেখব।’
নাম প্রকাশ না করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে ভর্তিচ্ছু একজন শিক্ষার্থী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তো ব্যবসা করা নয়। ভর্তির আবেদন থেকে কোটি কোটি টাকা তাদের ফান্ডে রাখতে হবে। আবার কলেজগুলোও যাতে কথা না বলে, এ জন্য তাদেরও ভাগ দেবে। কলেজগুলোর ভর্তি আবেদনে কোনো কাজ নেই। তারা তো ভর্তি ফি বাবদই টাকা নেয়। তাহলে তাদের কেন টাকা দিতে হবে? আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে কেন টাকা জমাতে হবে?
ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘বিসিএসের আবেদন ফি যদি ২০০ টাকা হয়, তাহলে ভর্তির আবেদন ফি ১০০ টাকা হওয়া উচিত। আমাদের দাবি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আবেদন ফি কমিয়ে দ্রুত নতুন সার্কুলার জারি করবে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় আবেদন ফি কমানোর দাবি তুলেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুুল্লাহ। গত ১৪ ডিসেম্বর নিজের ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘শিক্ষা সবার অধিকার, বাণিজ্যের পণ্য নয়! হাজার টাকার আবেদন ফি, যাতায়াত ও থাকার খরচ- বর্তমান ভর্তি প্রক্রিয়া শিক্ষার্থীদের জন্য এক ভয়ানক আর্থিক চাপ। প্রতিটি শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ ঝুলছে টাকার অঙ্কে।’
এদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে বহাল থাকছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও পোষ্য কোটা। ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে কোটা নিয়ে বলা হয়, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বা ভিন্নভাবে সক্ষম ও পোষ্য কোটায় ভর্তি হতে ইচ্ছুক আবেদনকারীকে তথ্য ছকের নির্দিষ্ট স্থানে তার জন্য প্রযোজ্য কোটা সিলেক্ট করতে হবে। পোষ্য কোটায় শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তান বা সন্তানাদি আবেদন করতে পারবে। কোটার জন্য সংরক্ষিত আসন বিষয়ভিত্তিক বরাদ্দকৃত আসনের অতিরিক্ত হিসাবে বিবেচিত হবে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পোষ্য কোটা রাখলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই সম্প্রতি তা বাদ দিয়েছে।
এ ব্যাপারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, ‘আদালতের নির্দেশনা অনুসারে আমরা মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেছি। এখানে শুধু সন্তানরাই সুযোগ পাবে, নাতি-নাতনিরা পাবে না। আর পোষ্য কোটা যেটা রাখা হয়েছে, তা মূল আসনের বাইরে। অর্থাৎ নির্ধারিত আসন থেকে কোনো পোষ্য কোটা দেওয়া হবে না।’