Image description
 

আধুনিক রাজনীতি শুধু ক্ষমতার কৌশল নয়, এটি আসলে এক গভীর দর্শনগত ও নৈতিক সংগ্রাম—যেখানে প্রশ্ন ওঠে, কে কথা বলবে, কে নীরব থাকবে আর কাকে কথা বলতেই দেওয়া হবে না। নিউ ইয়র্কে মামদানি বা বাংলাদেশের প্রান্তিক রাজনীতিকদের উত্থান এই মৌল প্রশ্নটিকেই নতুন করে সামনে এনেছে। ইতিহাস সাক্ষী, ক্ষমতার বয়ান সবসময় ‘অন্য’কে তৈরি করে আর সেই ‘অন্য’-এর মধ্য দিয়েই সমাজে পরিবর্তনের সুর জাগে। এই প্রেক্ষাপটে মামদানির বিজয়, কিংবা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রান্তে থাকা আন্দোলনের উত্থান, শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি দর্শনগতও বটে। সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ (Subaltern Studies)-এর অন্যতম প্রবক্তা গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তার বিখ্যাত প্রবন্ধ ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক? (Can the Subaltern Speak?) (১৯৮৪)-এ প্রশ্ন তুলেছিলেন—যারা ইতিহাসের প্রান্তে, তারা কি সত্যিই কথা বলতে পারে, নাকি তাদের কণ্ঠ সবসময় ‘উপস্থাপিত’ হয় কোনো ক্ষমতাবান কাঠামোর মাধ্যমে? মামদানি বা প্রান্তিক রাজনৈতিক শক্তিগুলোর উত্থান এই প্রশ্নের জবাব দেয়—হ্যাঁ, তারা কথা বলতে পারে, যদি সেই কণ্ঠ আসে সংগঠিত আত্মপরিচয়ের শক্তি থেকে, যদি তা আসে প্রতিরোধের নৈতিক সুরে।

 
 

বাংলাদেশেও রাজনীতির প্রান্তে থাকা বহু গোষ্ঠী, ধর্মীয় বা সামাজিক সংখ্যালঘু, শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত মানুষ সেই সাবঅল্টার্ন স্পেসের (subaltern space) প্রতিনিধিত্ব করে। তারা যখন ভোটের মাঠে, সামাজিক ন্যায়ের লড়াইয়ে বা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্নে দাঁড়ায়, তখন তারা শুধু রাজনৈতিক সত্তা নয়, বরং ‘অস্তিত্বের সাক্ষী’ হয়ে ওঠে। তাদের এই উত্থান আসলে ইতিহাসের প্রান্তিক মানুষের নীরব চিৎকারের প্রতিধ্বনি।

 

আসলে, মামদানির জয় শুধুই এক ব্যক্তিগত সাফল্য নয়; এটি এক সামাজিক হিসাবনিকাশের প্রতিফলন। এটি প্রমাণ করেছে, নিউ ইয়র্কের তথাকথিত ‘প্রগতিশীলতা’র নিচে বহু উপেক্ষিত, উপহাসিত মানুষের কণ্ঠ আজও জেগে আছে। প্রায়ই দেখা যায়, যাদের ছোট করে দেখা হয়, তারাই একদিন খেলার নিয়ম বদলে দেয়। আমেরিকার এই নির্বাচনি দৃশ্যপট আসলে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। যেখানে রাজনীতি সীমিত কয়েকটি পরিবারের দখলে। ধর্ম ও জাতিগত পরিচয়কে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার বানানো হয়, গণতন্ত্রের মঞ্চে জনতার কণ্ঠ শোনা যায় না। অথচ জনগণ বারবার প্রমাণ করেছে—তারা রাজনীতিবিদদের কল্পনাশক্তির চেয়ে অনেক বেশি সচেতন, মানবিক ও সাহসী।

 

যাই হোক, দার্শনিক হেগেলের ডায়ালেকটিকস অব হিস্টোরি (Dialectics of History) আমাদের শেখায়, ইতিহাস কখনো স্থির নয়, এটি থিসিস, অ্যান্টিথিসিস ও সিন্থেসিসের চিরন্তন গতি। ক্ষমতা এক থিসিস হলে, প্রতিরোধ তার অ্যান্টিথিসিস আর গণতন্ত্রের নতুন চেতনা সেই দুইয়ের সিন্থেসিস। মামদানির উত্থান, কিংবা বাংলাদেশের প্রান্তিক রাজনীতির নবজাগরণ, এই হেগেলীয় দ্বন্দ্বেরই প্রকাশ। প্রথমে অভিজাত রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়, তারপর প্রান্তিকতা তার বিরোধিতা করে এবং শেষ পর্যন্ত সমাজ নতুন ভারসাম্যে পৌঁছায়। এটি শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়, বরং নৈতিক বিবর্তনও। এরিস্টটল বলেছিলেন, রাজনীতি হলো ‘নৈতিক গুণের সম্প্রসারণ’—যেখানে রাষ্ট্র ন্যায়ের, সৌন্দর্যের ও সত্যের প্রতিষ্ঠা করে। মামদানির জয় সেই নৈতিক গুণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতীক, যেখানে ক্ষমতা নয়, মূল্যবোধই মুখ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ভবিষ্যৎ রাজনীতির মুক্তি এই নৈতিক সাহসের মধ্যেই নিহিত—যেখানে জনতা শুধু দল নয়, ন্যায়ের পাশে দাঁড়াবে।

 

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্পষ্টতই দেখায়—জনগণ অভিজাত রাজনীতির প্রতি ক্রমেই বিমুখ হচ্ছে। রাজনীতি পরিণত হয়েছে ব্যবসায়িক পণ্যে, গণমাধ্যম ও করপোরেট স্বার্থে জড়িত এক প্রচারণার যন্ত্রে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জনগণের নীরবতা আসলে প্রতিবাদ। তরুণ প্রজন্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে ছাত্রদলসহ ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনগুলোকে প্রত্যাখ্যান করছে। তারা নতুন বিকল্প হিসেবে ছাত্রশিবিরকে খুঁজে নিয়েছে, যারা আদর্শিকভাবে স্থিতিশীল, নৈতিকভাবে সৎ এবং জনগণের বাস্তব সমস্যার সঙ্গে যুক্ত। এটি ইথিক্যাল রেবেলিয়ন (ethical rebellion)—যেখানে তরুণরা বলছে, তারা আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতির রাজনীতি চায় না। এই পরিবর্তন হেগেলীয় দ্বন্দ্বের মতোই এক রূপান্তর—যেখানে ইতিহাসের চাকা অভিজাত থেকে জনগণের দিকে ঘুরছে।

 

নিউ ইয়র্কের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দৃশ্যে জোহরান মামদানির উত্থান শুধু একটি নির্বাচনি সাফল্য নয়, বরং এটি এক বৃহত্তর সামাজিক চেতনার প্রতিফলন, যেখানে অভিবাসী পরিচয়, ধর্মীয় বৈষম্য ও নাগরিক অংশগ্রহণের ধারণা নতুন করে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। ৯/১১-পরবর্তী আমেরিকায় ইসলামোফোবিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবৈষম্যের ছায়া যেমন গভীর হয়েছে, তেমনি ‘অন্যতা’ বা আদারনেস (otherness)-এর দর্শনীয় ধারণাটি আবার রাজনৈতিক বাস্তবতায় ফিরে এসেছে। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো যেমন বলেছিলেন, ক্ষমতা কখনো একমুখী নয়; এটি সম্পর্কের জটিল জাল, যেখানে প্রতিরোধই ক্ষমতার অপর পিঠ। মামদানির জয় সেই প্রতিরোধেরই উদাহরণ—একজন মুসলিম, অভিবাসী বংশোদ্ভূত তরুণ, প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির একপক্ষীয় বৃত্ত ভেঙে তুলে ধরেছেন ভিন্ন কণ্ঠ, ভিন্ন বর্ণনাকে।

 

এই জয় শুধু মুসলিম পরিচয়ের পুনরুত্থান নয়; বরং এটি ইনক্লুসিভিটি (inclusivity)-এর ধারণাকে রাজনৈতিক বাস্তবতায় রূপ দেওয়া। সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বোর্দিয়ুর ভাষায়, প্রতিটি রাজনৈতিক ক্ষেত্র এক ধরনের প্রতীকী পুঁজি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যেখানে বৈধতা হলো ক্ষমতার মূল চালিকা শক্তি। মামদানি এই ক্ষেত্রের অভ্যন্তরীণ নিয়ম ভেঙে সেই প্রতীকী পুঁজির পুনর্বিন্যাস করেছেন, তিনি প্রমাণ করেছেন যে প্রান্তিক পরিচয়ও কেন্দ্রস্থলে স্থান নিতে পারে, যদি তা সাংগঠনিক শক্তি, আদর্শিক স্পষ্টতা ও জনগণের বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত হয়।

 

তবে এ ঘটনাটির প্রভাব শুধু আমেরিকার সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি প্রতিধ্বনি তুলেছে বাংলাদেশের মতো দেশেও, যেখানে রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে বংশানুক্রমিক ক্ষমতা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অনাস্থার ছায়ায় বন্দি। বাংলাদেশের নাগরিকরা বছরের পর বছর ধরে প্রত্যক্ষ করেছে রাজনৈতিক শ্রেণির লোভ, দখলদারিত্ব আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির দানবীয় রূপ। গণতন্ত্র এখানে প্রায়ই রূপ নিয়েছে পেরফোরমেটিভ ডেমোক্রেসিতে (performative democracy), যেখানে নির্বাচন শুধু আনুষ্ঠানিকতা আর জনগণের ইচ্ছা পরিণত হয় পরিসংখ্যানের খেলায়। জার্মান দার্শনিক হাবারমাসের পাবলিক স্ফিয়ারের (public sphere) ধারণা এখানে কার্যত বিপরীতভাবে ব্যবহৃত—যেখানে মুক্তচিন্তা ও মতবিনিময়ের বদলে প্রচারযন্ত্র ও পৃষ্ঠপোষক মিডিয়া নাগরিক চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই প্রেক্ষাপটে জোহরান মামদানির জয় এক ধরনের দর্শনীয় প্রতিফলন ঘটায়, জনগণ যখন রাজনীতিতে আস্থা হারায়, তখন নতুন প্রজন্ম বিকল্প রাজনৈতিক নৈতিকতা খোঁজে। সেই বিকল্প নৈতিকতা বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে—তারা আর আগের মতো অন্ধ আনুগত্যে বিশ্বাস করে না, বরং চায় স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ ও মূল্যবোধনির্ভর রাজনীতি, যা তারা ইতোমধ্যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নির্বাচনে দেখিয়ে দিয়েছে, আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী, আকলমান্দক লিয়ে ইশারা কাফি হ্যায়।

 

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি—যেখানে দলে দলে যোগদান, দুর্নীতির বৈধতা, দমননীতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য একসঙ্গে চলছে, সেখানে তরুণরা ধীরে ধীরে পোস্ট-আইডিওলজিক্যাল ডিসিলুশনমেন্টের (post-ideological disillusionment) মধ্যে পড়ছে। অর্থাৎ, তারা জানে পুরোনো মতাদর্শে মুক্তি নেই, তাই তারা নতুন বিকল্পও খুঁজে নিয়েছে এবং নিচ্ছে।

 

আদতে, মামদানির সাফল্যের মধ্যে রয়েছে এক নৈতিক জাগরণের বার্তা। তার রাজনৈতিক দর্শন, যাকে বলা যায় গ্রাসরুটস কসমোপলিটানিজম (grassroots cosmopolitanism) দেখিয়ে দিয়েছে যে বৈশ্বিক নাগরিকত্ব ও স্থানীয় বাস্তবতার মধ্যে সেতুবন্ধ সম্ভব। রাজনৈতিক সমাজবিজ্ঞানীরা একে বলছেন ইথিক্যাল পপুলিজম (ethical populism)—যেখানে জনগণের অনুভূতি শুধু আবেগ নয়, বরং নৈতিক অবস্থানও বটে। এই নৈতিক অবস্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য অপরিহার্য, কারণ এখানে দীর্ঘদিন ধরে আদর্শের চেয়ে স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে গণমানুষ রাজনীতিকে শত্রুরূপে দেখে, আশ্রয়রূপে নয়। এই অবস্থার সমালোচনায় বলা যায়, বাংলাদেশে পলিটিক্যাল ইকোনমি অব কোররাকশন (political economy of corruption) এখন এক সাংস্কৃতিক রূপ নিয়েছে। দুর্নীতি শুধু প্রশাসনিক নয়; এটি সামাজিক মর্যাদার অংশ। একদিকে যেমন ক্ষমতাসীনদের লোভ-লালসা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পচিয়ে তুলেছে, অন্যদিকে বিরোধী শক্তিগুলোও সেই একই ব্যবস্থার ভাষা ব্যবহার করে নিজেদের বৈধতা প্রমাণ করতে চায়। ফলে জনগণ বিকল্প পায় না, বরং প্রত্যক্ষ করে এক ধারাবাহিক নৈতিক পতন। দর্শনের ভাষায়, একে বলা যায় নিহিলিস্টিক ডেমোক্রেসি (nihilistic democracy)—যেখানে ভোট, দল ও প্রতিশ্রুতি সবই অর্থহীন রীতিতে পরিণত হয়।

 

এরই পরিপ্রেক্ষিতে মামদানির জয় এক ধরনের কাউন্টার-নেরেটিভ (counter-narrative) তৈরি করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রান্তিক পরিচয়, আদর্শ ও নৈতিক রাজনীতি একত্রে মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই শিক্ষা গভীর তাৎপর্যপূর্ণ—বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছে। কারণ, বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থায় যখন মানুষ আশা হারিয়ে ফেলছে, তখন মোর‍্যাল সোর্সেস অব স‍্যালফ (moral sources of self) পুনরুদ্ধার করা অপরিহার্য। অর্থাৎ, রাজনীতির মূল উৎস হতে হবে নৈতিক মূল্যবোধ, ক্ষমতার নয়। তবে বাস্তবতা কঠিন। বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের দমননীতি, বিচারহীনতা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য এমন এক সমাজ তৈরি করেছে, যেখানে নাগরিকরা নিজেদের সম্ভাবনায় আস্থা হারাচ্ছে।

 

পাঠক, এখন মামদানির প্রধান প্রতিযোগী কুওমোর জায়গায় যদি বাংলাদেশি রাজনীতির কোনো অভিজাত দলকে বসানো হয়, আর নিউ ইয়র্কের জায়গায় ঢাকাকে কল্পনা করা যায়, তাহলে দেখবেন দৃশ্যপট অভিন্ন। ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, মিডিয়া ও বিদেশি প্রভাবের সমর্থনে আগেভাগেই নির্ধারিত হয় কে ‘নিশ্চিত প্রার্থী’, কে ‘যোগ্য নেতা’। জনগণের মাঠে সেই বাস্তবতা থাকে না, থাকে শুধু কাগজে-কলমে তৈরি প্রচারণা। আমি বোধ করি, বাংলাদেশের একাংশের মিডিয়া, করপোরেট গোষ্ঠী ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের এই জোট অনেকটা আমেরিকার প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়া ও অর্থশক্তির প্রতিরূপ। ওপর থেকে গল্প বানানো হয়, নিচের কণ্ঠগুলো চেপে দেওয়া হয়। আর যাদের প্রশ্ন করার সাহস আছে, তাদের বলা হয়—‘তুমি এই রাজনীতির অংশ নও’।

 

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেসব দল বা সংগঠন মূলধারার বাইরে থেকেও সমাজে কাজ করছে, তাদের ওপর আরোপিত ‘অগ্রহণযোগ্যতা’র ছাপ আসলে প্রান্তিকতারই অন্য নাম। নিউ ইয়র্কে মামদানির বিরুদ্ধে ৯/১১ ব্যবহার করা হয়েছে, এখানে ১৯৭১। ওখানে বলা হয়, ‘ইসরায়েলের সমালোচনা করা যাবে না’, এখানে বলা হয়, ‘ভারতের সমালোচনা করা যাবে না’। যুক্তির কাঠামো এবং স্টেরিওটাইপ কিন্তু একই।

 

অতএব, নিউ ইয়র্কের অভিবাসী তরুণ রাজনীতিকের এই জয় আসলে এক বিশ্বজনীন বার্তা বহন করে, গণতন্ত্রের শক্তি শুধু সংখ্যায় নয়, বিশ্বাসে। বাংলাদেশের মতো দেশে এই শিক্ষা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক—কারণ, এখানে গণতন্ত্র টিকে থাকবে শুধু তখনই, যখন জনগণ আবার বিশ্বাস করবে যে তাদের ভোট, তাদের কণ্ঠ, তাদের প্রতিবাদ সত্যিই কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। মামদানির জয় তাই শুধু রাজনীতির নয়, এটি মানবতার, পরিচয়ের, নৈতিক সাহসের বিজয়। মামদানি বা বাংলাদেশের প্রান্তিক রাজনীতির গল্প মূলত একই, একটি নতুন নৈতিক রাজনীতির জন্মকথা। এই রাজনীতি পরিচয়ের মধ্যে মানবতা খোঁজে, ধর্মের মধ্যে ন্যায় খোঁজে আর ক্ষমতার মধ্যে নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে চায়। কোরআনের সেই বাণী—‘অনেক সময় ছোট একটি দল, আল্লাহর ইচ্ছায় বড় বাহিনীকে পরাস্ত করে’ এই দর্শনেই নিহিত। কারণ ইতিহাসের প্রতিটি বড় পরিবর্তন শুরু হয় প্রান্ত থেকে, নীরব থেকে, অপ্রচলিত থেকে। এই বাণী শুধু নিউ ইয়র্কের ভোটারদের নয়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জন্যও প্রযোজ্য—তাদের জন্য, যাদের বলা হয়েছে, ‘তুমি নেতৃত্বের উপযুক্ত নও, তুমি ভিন্ন, তুমি অগ্রহণযোগ্য।’ এই ‘ভিন্নতা’ই আসলে শক্তি। ইতিহাসের প্রতিটি পরিবর্তনই শুরু হয়েছে সেই মানুষদের হাত ধরে, যাদের অবজ্ঞা করা হয়েছিল।

 

আজ পৃথিবীর রাজনীতি এক সংকটে—মিডিয়া ও পুঁজির দখলে থাকা গণতন্ত্র মানুষের কণ্ঠকে অবদমিত করছে। কিন্তু মামদানির জয় কিংবা বাংলাদেশের তরুণদের বিপ্লব, প্রতিবাদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, গণতন্ত্র এখনো জীবিত—যতদিন পর্যন্ত একজন মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সত্যের পক্ষে কথা বলে, ততদিন পর্যন্ত এই পৃথিবী তার মানবতা হারাবে না। রাজনীতি যতদিন কিছু গোষ্ঠীর হাতে বন্দি থাকবে, ততদিন জনগণের আসল কণ্ঠ চাপা পড়ে থাকবে। কিন্তু ইতিহাস শেখায়, কোনো কণ্ঠই চিরকাল দমিয়ে রাখা যায় না।

 

লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক, ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি

[email protected]