Image description
 

শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ পরিচালনায় অন্যায় অবিচার লুটপাট নানা অনিয়ম ৭৪-এর দুর্ভিক্ষ-সবকিছু মিলে দুঃশাসনের অবসান ঘটে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ক্ষমতায় আসেন খন্দকার মোস্তাক আহমদ। খন্দকার মোস্তাকের মন্ত্রিসভা শেখ মুজিবের মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও সহিংসতার অবসান ঘটে ৭ নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে। ৩-৭ নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহকে সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বলে অনেকে অভিহিত করেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সংগঠিত সিপাহী-জনতার বিপ্লব ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ দিনটি বাংলাদেশের ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ৭ নভেম্বরের বিপ্লব মূলত ঘটেছিল জাসদ সমর্থিত ও বামপন্থি কিছু সেনা কর্মকর্তার মাধ্যমে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদলীয় বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে তার সহকর্মী ও মন্ত্রী খন্দকার মোস্তাক আহমদ ও তার অনুসারীরা হত্যা করে পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ওই বছরে অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীতে এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গ্রেফতার করে সেনাপ্রধানের পদ দখল করেছিলেন। মোস্তাক আহমেদকে বঙ্গভবনে বন্দি করেছিলেন। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান বাকশালী শাসনে ফিরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ভারতপন্থি পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিত ছিল। জিয়াউর রহমান ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান এবং ক্ষমতায় আসেন। তৎকালীন সময়ে সেনাবাহিনীতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল সর্বাধিক। ফলে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি জনগণ খালেদ মোশারফের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেছিল। ৬ নভেম্বর রাত থেকে শুরু হয়েছিল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। এ বিপ্লবে খালেদ মোশাররফসহ তার কয়েকজন সঙ্গী নিহত হয়েছিলেন। 
জিয়াউর রহমান মুক্তি পেলেও একটি রাজনৈতিক মহল বাংলাদেশকে তাবেদার রাষ্ট্রের পরিণত করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীর মধ্যে হানাহানি সৃষ্টি করার ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়েছিল। এসব বিষয়ে নির্দেশনা আসছিল একটি বিশেষ মহল থেকে, সেখানে নেতৃত্বে ছিলেন বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের এক তাত্ত্বিক নেতা ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু তাহের। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায় ৭ নভেম্বর সংঘটিত বিপ্লবের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মোশাররফ, কর্নেল তাহের ও অন্যান্য। মহলটি কর্নেল তাহেরকে সামনে রেখে সেনাবাহিনীতে অফিসার হত্যার অভিযান চালাতে চেয়েছিল। একজন সুবেদার মেজর জানিয়েছিলেন, কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে লালমাটিয়ার একটি বাসায় বিদেশের একজন সেনা কর্মকর্তাসহ একটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ষড়যন্ত্রকারীরা ছিল অন্য তাঁবেদার। আধিপত্যবাদী ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিয়ে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব দেশকে স্থিতিশীলতায় এনেছিল। জেনারেল জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান। সেদিন রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের নগরী। পথে পথে সিপাহী-জনতা আলিঙ্গন করেছে একে অপরকে, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ধ্বনিতে মুখরিত হয় রাজধানীসহ সমগ্র দেশ। সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এ দেশের মানুষের মুক্তির সোপান নিয়ে আসে ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর। 
সিপাহী জনতার বিপ্লবের ৫০ বছর পর একই ধরনের আরেকটি বিপ্লব বাংলাদেশে সংঘটিত হয়। এটি ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট যা সংঘটিত হয়। শেখ হাসিনা তার পিতার মতো স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণ করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন। ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকার ১৬ বছরের শাসন আমলে এমন কোন অন্যায় কাজ নাই যে তার সরকার করেনি। গুম-খুন-হত্যা-সন্ত্রাস-দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি লুটপাট টাকা পাচার ভোটবিহীন নির্বাচন- সকল ধরনের অপকর্ম করে দেশকে অন্য দেশের হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিলেন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গণতন্ত্র হরণ করেছিলেন। বাংলাদেশের স্পর্শকাতর সংস্থাগুলোর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছিলেন শেখ হাসিনার দোসর। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তাকে আয়নাঘরে বন্দি ও হত্যা করে লাশ গুম করা হতো।
শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসন আমল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। তার শাসন আমলে জনজীবনে এক বিভীষিকাময় অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল। বাংলাদেশ লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি সর্বস্তরে দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতির দুর্বৃত্তায়নের করাল গ্রাসের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ হয়ে একটি কঠিন ফ্যাসিজম সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা রক্তের বিনিময়ে নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আন্দোলনে নেমে পড়ে। শেখ হাসিনা পুলিশ বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। আন্দোলন দমাতে শেখ হাসিনা নিজেই গুলির আদেশ দিয়েছিলেন। ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্তৃক আন্দোলনরত ছাত্রদের মারধর করে অমানবিক নির্যাতন করেছিল। পুলিশ বাহিনী ও ছাত্রলীগ-যুবলীগ এর নির্মম অত্যাচার এ দেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। এতে দেশের সাধারণ মানুষসহ ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক-রিক্সাওয়ালা খেটে খাওয়া মানুষ সর্বস্তরের জনতা আন্দোলনে শরিক হতে লাগলো। এতে শেখ হাসিনার মসনদ কেঁপে উঠল। এরপর পুলিশ বাহিনী বিডিআর সেনাবাহিনী বিমান বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে। এতে আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ প্রায় ২৪০০ ছাত্র-জনতা শহীদ হন। বাংলাদেশের মানুষ আরও বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলন শাণিত করে তোলে। আন্দোলন দমাতে কারফিউ ঘোষণা করে সরকার। আন্দোলনকারীরা গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে ৫ আগস্টে কারফিউ অমান্য করে ছাত্র জনতা গণভবন অভিমুখী হতে জড়ো হতে লাগলো। শাহবাগসহ রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে। মানুষের ঢল যেন রাস্তায় নেমে আসতে শুরু করল, যা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমগুলোতে টিভিতে ফলাও করে দেখানো শুরু করল। তা দেখে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনাকে বললেন, কোনো অবস্থাতেই আন্দোলন রোধ করা যাচ্ছে না। যে কোনো মুহূর্তে আন্দোলনকারীরা গণভবনে ঢুকে পড়তে পারে। অবশেষে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দুই বোন হেলিকপ্টার যোগে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ভারতে পালিয়ে যান। 
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মতো ৫ আগস্ট আরেকটি বিপ্লব ঘটেছিল ফ্যাসিজম সরকারের বিরুদ্ধে। ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদী কখনো চিরস্থায়ী হতে পারে না। ৭ নভেম্বর ও ৫ আগস্ট থেকে শিক্ষা নিতে হবে আমাদের আগামী প্রজন্মকে। জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। রাষ্ট্রীয় সকল কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি শুদ্ধাচার দেশ প্রেম ন্যায় নীতি মানবিক মূল্যবোধ সততা থাকতে হবে। শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর পর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ছাত্র-জনতা বুদ্ধিজীবী সকলে এক হয়ে বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব বিশ্বনন্দিত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে। ৭ নভেম্বর ও ৫ আগস্টের বিপ্লবের ঘটনার পটভূমিতে অনেকাংশে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাই বলা যায়, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লব আর ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ছাত্র জনতার অভ্যুত্থান যেন একই সূত্রে গাঁথা।

 

মোহাম্মদ শফিউল্লাহ মিয়া ভাই

লেখক : কবি, সভাপতি, জাতীয়তাবাদী সাহিত্য পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি