Image description
 

বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি রাজনীতি চর্চা একটি দীর্ঘদিনের অসুস্থ প্রবণতা, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আরো ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করতে চাইলেও প্রবাসে চলা দলীয় রাজনীতি বারবার সেই প্রচেষ্টাকে ভন্ডুল করছে। রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিদেশের শহরে হাতাহাতি, সংঘর্ষ, কূটনৈতিক মিশনে হামলা, দূতাবাস কর্মীদের হয়রানি—এসব ঘটনা কেবল বাংলাদেশি সমাজকে বিভক্ত করছে না, বরং সংশ্লিষ্ট দেশের গণমাধ্যমে নেতিবাচকভাবে প্রচারিত হয়ে আমাদের ভাবমূর্তি চূর্ণবিচূর্ণ করছে। এমন পরিস্থিতিতে নাগরিকরা যখন দেশের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চার ঘাটতি নিয়ে হতাশ, তখন প্রবাসে এ ধরনের সহিংসতা বাংলাদেশের সুনামকে আরো প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে।

 

বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মীদের কার্যক্রমের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইতালি, গ্রিস ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে বাংলাদেশি প্রবাসীরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যানারে সংগঠিত হয়ে আসছে। তাদের মূল কাজ হওয়া উচিত দেশের উন্নয়ন, প্রবাসীদের অধিকার রক্ষা এবং বিদেশি সমাজে বাংলাদেশের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বাস্তবে তারা পরিণত হয়েছে দলীয় ক্যাডারে। বিদেশ সফরে যাওয়া মন্ত্রী, সংসদ সদস্য কিংবা বিরোধী নেতাদের প্রবাসীরা অনেক সময় হেনস্তা করেছে; কেউ পানির বোতল ও ডিম ছুড়ে মেরেছে, কেউ হোটেলে প্রবেশ ঠেকিয়েছে, আবার কেউ কনস্যুলেট ঘেরাও করে স্লোগান দিয়েছে। এই দৃশ্য যখন সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, তখন বিদেশিরা মনে করে বাংলাদেশ একটি অশান্তিপূর্ণ, বিশৃঙ্খল ও অনিরাপদ দেশ।

 

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দূতাবাস ও কনস্যুলেটে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা কনস্যুলেট ভবনের সামনে মিছিল করে ভাঙচুর চালিয়েছে, কাচ ভেঙেছে, ব্যানার টানিয়েছে এবং কর্মকর্তাদের গালাগাল করেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড একদিকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, অন্যদিকে রাষ্ট্রের মর্যাদার অবমাননা। রাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশন আসলে দেশের মুখপাত্র, যার ওপর দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশের ইমেজ তৈরি হয়। সেই মিশন যখন নিজ দেশের নাগরিকদের আক্রমণের শিকার হয়, তখন সেই রাষ্ট্রের মর্যাদা ভয়াবহভাবে নষ্ট হয়।

 

এই নেতিবাচক চর্চা কেবল আকস্মিক আবেগের ফল নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক সুবিধা। বিদেশে রাজনৈতিক কমিটি গঠনের মাধ্যমে দলগুলো বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে। প্রবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা, অনুদান, সদস্যপদ ফি—এসবই দলীয় তহবিলের বড় অংশ জোগান দেয়। একই সঙ্গে বিদেশ সফরে রাজনৈতিক নেতারা প্রবাসী সমর্থকদের কাছ থেকে যাতায়াত ও আবাসনের মতো নানা সুবিধা ও উপহারসামগ্রী পান। তাই রাজনৈতিক নেতৃত্ব সচেতনভাবে বিদেশে রাজনীতি বন্ধ করতে চায় না। যদিও আগে একাধিকবার এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে যে, বিদেশের মাটিতে রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করা উচিত; তবে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি, কারণ দলীয় নেতারা তাদের স্বার্থকে দেশের স্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখেছেন।

এখন প্রশ্ন আসে—এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব কোথায়? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উভয়ই এ বিষয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। দূতাবাস ও কনস্যুলেটে হামলার ঘটনা নতুন নয়। বারবার এসব ঘটনা ঘটলেও কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনেক সময় দেখা যায়, দূতাবাসের কর্মকর্তারা রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতিত্ব করছেন। তারা পূর্ববর্তী সরকারের অনুগত থেকে দায়িত্বে অবহেলা করছেন, কিংবা প্রবাসীদের হয়রানি করছেন। ফলে প্রবাসীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বা অপসারণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো উদাসীন থেকেছে। এতে স্পষ্ট যে প্রশাসনিক শিথিলতা ও রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করছে।

 

অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও দায় এড়াতে পারে না। প্রবাসে অবস্থানরত রাজনৈতিক কর্মীরা যখন সহিংসতা চালায় বা দূতাবাসে আক্রমণ করে, তখন দেশে তাদের রাজনৈতিক দল বা পরিবারকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এ ধরনের কর্মীরা দেশে ফিরে আরো বড় দায়িত্ব পেয়েছে। এতে একধরনের উৎসাহ সৃষ্টি হয় যে, বিদেশে দলীয় সহিংসতা চালানো অপরাধ নয়, বরং দলের প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ। এই দৃষ্টান্ত ভেঙে দিতে হবে।

 

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে অভ্যন্তরীণ জাতীয় রাজনীতি বিদেশে চর্চা করার অনুমতি দেওয়া হয় না। প্রবাসীরা চাইলে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন ডাকযোগে, অনলাইনে বা নিজ দেশের কনস্যুলেটের মাধ্যমে। কিন্তু দলীয় সমাবেশ, মিছিল বা সংঘর্ষ করার অনুমতি তারা পান না। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়ে পড়েছে। ফলাফল হলো প্রবাসী সমাজে বিভক্তি, দ্বন্দ্ব, সহিংসতা এবং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নষ্ট।

 

তাহলে করণীয় কী? প্রথমত, বিদেশে থাকা সব রাজনৈতিক দলের কমিটিগুলো অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে যে, প্রবাসভূমিতে আর কোনো শাখা সংগঠন থাকবে না। দ্বিতীয়ত, সরকারকে আইন করে বিদেশে দলীয় মিছিল, সমাবেশ বা দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। তৃতীয়ত, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে ডাকযোগে বা অনলাইনে ভোট গ্রহণের মাধ্যমে। এতে প্রবাসীরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবেন, কিন্তু সহিংসতা সৃষ্টি করার সুযোগ থাকবে না। চতুর্থত, কূটনৈতিক মিশনে যারা দায়িত্বে অবহেলা করছেন বা রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব করছেন, তাদের অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না করলে সমস্যার সমাধান হবে না।

 

সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। এ মন্ত্রণালয়কে দূতাবাস ও কনস্যুলেটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে এবং প্রবাসীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেশে থেকে নজরদারি রাখতে হবে, যাতে প্রবাসে সহিংসতা চালানো ব্যক্তিরা দেশে ফিরে পুরস্কৃত না হয়, বরং শাস্তি পায়। কেবল আইন প্রয়োগ নয়, রাজনৈতিক সদিচ্ছাও প্রয়োজন।

 

বাংলাদেশ আজ বিশ্বে একটি উদীয়মান অর্থনীতি। রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। প্রবাসী বাংলাদেশিরা শ্রম ও মেধার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন। তারা দেশের দূত ও দেশের প্রতিনিধি। কিন্তু যখন তারা বিদেশে দলীয় রাজনীতির নামে সংঘর্ষে জড়ান, তখন পুরো জাতি কলঙ্কিত হয়। বিদেশিরা তখন আর আলাদা করে কোনো দলকে দোষ দেন না; তারা পুরো বাংলাদেশকেই অসভ্য, অসংযত এবং সহিংসতার জাতি মনে করেন।

 

এখনই সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকারের একযোগে উদ্যোগ নেওয়ার। বিদেশে রাজনীতি বন্ধ করা কোনো দল বা ব্যক্তির ক্ষতি নয়, বরং গোটা জাতির লাভ। এতে প্রবাসী সমাজ ঐক্যবদ্ধ হবে, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা পাবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের অবস্থান দৃঢ় হবে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে—দূতাবাসে হামলা, কর্মকর্তাদের হয়রানি, প্রবাসী নেতাদের আক্রমণ—এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর হতে দেওয়া যাবে না। সরকারকে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে কার্যকরভাবে ভূমিকা রাখতে হবে।

 

বিদেশে জাতীয় রাজনীতি চর্চা বন্ধ করতে না পারলে বাংলাদেশের মর্যাদা বারবার ক্ষুণ্ণ হবে। প্রবাসীরা দেশের সম্পদ, তাদের বিভক্ত করা নয়, ঐক্যবদ্ধ করাই এখন জাতীয় স্বার্থ। রাজনৈতিক দল, সরকার ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো যদি একসঙ্গে উদ্যোগ নেয়, তবে বাংলাদেশ একটি ইতিবাচক বার্তা দিতে পারবে বিশ্বকে যে, বাংলাদেশিরা শৃঙ্খলাবদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ ও সুনামের অধিকারী একটি জাতি। এটাই সময় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার, নইলে আমাদের ভাবমূর্তি বারবার কলঙ্কিত হতে থাকবে।

 

সবচেয়ে বড় কথা, প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশের একেকজন অ্যাম্বাসেডর। তাদের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। যদি তারা বিভক্ত হয়, একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়, রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের হয়রানি করে বা দূতাবাসে হামলা চালায়, তাহলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সমাজে অবজ্ঞার পাত্র হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশি রাজনীতি বিদেশের মাটিতে চর্চা করা শুধু প্রবাসী সমাজের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং দেশের ভাবমূর্তিকেও নষ্ট করে। রাজনীতির চর্চা করতে হলে তা হতে হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, জনগণের কল্যাণের জন্য। বিদেশে প্রবাসীদের ভূমিকা হওয়া উচিত দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করা, ঐক্যবদ্ধভাবে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করা এবং উন্নয়নে অবদান রাখা।

ব্রি. জে. (অব.) রোকন উদ্দিন

লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষক ও লেখক