
এলাহী নেওয়াজ খান
ইতিহাসের পাতায় ফ্যাসিবাদী শাসনের উত্থান ও পতনের যে কাহিনি বিধৃত আছে, তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সামরিক বাহিনীর অকুণ্ঠ সমর্থন ছাড়া ফ্যাসিবাদী শাসন টিকতে পারে না। উত্থান পর্বে সাধারণ মানুষের পক্ষে এটা বুঝে ওঠা সম্ভব হয় না; কিন্তু যখন কোনো গণঅভ্যুত্থানে সেনা সংযুক্ততার মাধ্যমে সরকারের পতন সংগঠিত হয়, কিংবা অন্য কোনো উপায়ে পতন ঘটে, তখন সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবার কখনো তা ঘটে যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে। আবার কোনো কোনো দেশে সরাসরি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের পতন ঘটতে দেখা গেছে, যার নজির বাংলাদেশে আছে।
এই প্রেক্ষাপটে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, সেনাবাহিনী যতক্ষণ না ফ্যাসিস্ট সরকারের পক্ষ ত্যাগ না করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই ধরনের সরকারের পতন ঘটে না, কিংবা পতন ঘটানো সম্ভবও হয় না। বিশ্বের সব ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, সেনা-সমর্থন ছাড়া ফ্যাসিস্টরা টিকে থাকতে পারে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই দেখা গেল। গত বছর ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবের সময় লক্ষণীয়ভাবে তা স্পষ্ট হয়েছে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী শেখ হাসিনার পক্ষ ত্যাগ করার ফলে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তার লৌহকঠিন শাসনের অবসান ঘটে যায়। তখন সেনাবাহিনীর এই ভূমিকা সাধারণ মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল গভীর ভালোবাসা নিয়ে।
তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, সব ফ্যাসিস্ট শাসকের পতনের পর তাদের অনুগত ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের বিচারের ঘটনাও ঘটেছে অনেক দেশে। যেমন সেটা ঘটেছে ফরাসি বিপ্লবের পর এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত ইতালি ও জার্মানিতে। ঘটেছে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর। এসব ছাড়াও অনেক দেশে এ ধরনের বিচারের নজির রয়েছে।
ফরাসি বিপ্লবের কথাই ধরা যাক। এই বিপ্লব সফল হওয়ার পর খোদ ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আরো অনেক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। অনেককে করা হয়েছিল কারারুদ্ধ। আবার অনেকে বিদেশে পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করেছিল।
ঠিক দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর একই ঘটনা ঘটেছিল জার্মানি ও ইতালিতে। ফ্যাসিস্ট হিটলার ও মুসোলিনির পতনের পর ওই দুই দেশের সেনাবাহিনী ভেঙে পড়েছিল। ইতালির সেনাবাহিনীর সাড়ে ছয় লাখ সদস্যকে নিরস্ত্র করে জার্মানিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জোরপূর্বক শ্রম কাজে নিয়োজিত করার জন্য। শুধু জার্মানি নয়, মিত্রবাহিনীর দখলকৃত অন্যান্য অঞ্চলেও তাদের পাঠানো হয়েছিল। অনেককে করা হয়েছিল কারারুদ্ধ। পরবর্তী সময়ে নতুন করে ইতালির সেনাবাহিনী গঠন করা হয় এবং ন্যাটোর সদস্য হিসেবে সংযুক্ত হয়।
অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জার্মান সেনাবাহিনীর অনেক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা নুরেমবার্গ ট্রায়ালের সম্মুখীন হন। বিচারে মৃত্যুদণ্ড সহ নানা মেয়াদে এসব অফিসারের সাজা হয়েছিল। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে ফিল্ড মার্শাল, ফোর স্টার জেনারেল ও অ্যাডমিরালের মতো অফিসার ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকে আবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগেই আত্মহত্যা করেছিলেন। অনেক অফিসার আর্জেন্টিনাসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গিয়েছিলেন। নিম্নপদের অনেক অফিসার জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে পেরেছিলেন, আবার অনেকে অন্য দেশে গিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-উত্তর জার্মানি ও ইতালির ফ্যাসিস্টদের করুণ ইতিহাসের পর ইরানের ফ্যাসিস্ট শাসক মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভির কথাই ধরুন। তার ভয়ংকর গোয়েন্দা সংস্থা সাভাকের কথা কে না জানে। পশ্চিমা সহায়তায় গড়ে ওঠা এই গোয়েন্দা সংস্থা তথাকথিত কমিউনিস্ট ও ইসলামপন্থিদের ওপর সীমাহীন নিপীড়ন চালিয়েছিল। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গুম, খুন ও কারাবন্দি করা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেনাবাহিনী ছিল তার অধীনস্থ একটি লাঠিয়াল বাহিনীর মতো। মানবতাবিরোধী অপরাধে তারা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। জনগণ এই মুষ্টিবদ্ধ কঠিন শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছিল, যার বিস্ফোরণ ঘটেছিল ১৯৭৯ সালে।
তখন লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং তাদের অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদের মুখে বহু বছর ধরে গড়ে ওঠা শাহের কল্পিত স্বর্গরাজ্য ধসে পড়তে শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে যখন শাহের অনুগত সেনাবাহিনী থেকে সিপাহিরা পক্ষ ত্যাগ করে মিছিলকারীদের সঙ্গে যোগ দেওয়া শুরু করল তখনই বোঝা গেল, রেজা শাহ পাহলভির দিন শেষ। কারণ আগেই উল্লেখ করেছি, জাতীয় সেনাবাহিনী পক্ষ ত্যাগ না করলে কোনো বিপ্লব সফল হয় না। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের সময় তাই ঘটেছিল। সেনাবাহিনীর বিরাট অংশ পক্ষ ত্যাগ করেছিল। ফলে রেজা শাহ পাহলভী দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। আর একটি প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। অনেক জেনারেল বিদেশে পালিয়ে যান এবং অনেকে বিচারের মুখোমুখি হন। নতুনভাবে নিয়মিত বাহিনী গড়ে তোলা হয় এবং সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠা করা হয় ইসলামিক রেভোল্যুশনারি গার্ড কোর (আইআরজিসি) নামে আরেকটি বাহিনী।
একটি বিষয় খুব লক্ষণীয়, প্রতিটি ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্যাতন ও নিপীড়নের পদ্ধতি প্রায় একই রকমের। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গুম-খুনের পাশাপাশি নানা পদ্ধতিতে নির্যাতন চালানো। যেমন ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুইয়ের ছিল বাস্তিল দুর্গ, হিটলারের ছিল গেস্টাপো বাহিনী ও গ্যাস চেম্বার, ইরানের ছিল ‘এভিন কারাগার’। এটা পরিচালনা করতো রেজা শাহ পাহলভির কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা ‘সাভাক’। এই গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিত ফ্রান্সের গোয়েন্দারা এবং পাশাপাশি ছিল মার্কিন সিআইএ’র কর্মকর্তারাও। বিশেষ করে ফরাসি গোয়েন্দারা আলজেরিয়ার যুদ্ধের সময় যেসব নির্যাতনের পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিল, সেগুলোই সাভাক সদস্যদের শেখাত। তাহলে সহজে বোঝা যায়, বিরোধী দলকে দমন করতে সাভাকের ভূমিকা কতটা ভয়ংকর ছিল।
আর হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী ও গ্যাস চেম্বারের কাহিনি তো পৃথিবীর মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে স্মরণ করে যাবে। এটা ছিল অ্যাডলফ হিটলারের একটি গোপন পুলিশ বাহিনী, যাদের কাজ ছিল বিরোধী মতকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া। নৃশংসতায় এই বাহিনী পৃথিবীর সব দেশের সব বাহিনীকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল গ্যাস চেম্বার, যার মাধ্যমে একসময় যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো। পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান নিষিদ্ধ করা হলেও হিটলার গণহত্যার জন্য এই গ্যাস চেম্বার ব্যবহার করেন, যা ছিল মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। জার্মানিতে এই গ্যাস চেম্বারের মধ্যে মানুষ ঢুকিয়ে ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস ছেড়ে দেওয়া হতো এবং মানুষ শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করত। এভাবে হিটলার ৯০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষকে হত্যা করেছিলেন।
এই গ্যাস চেম্বারে নিহতদের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা বেশি হলেও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের লোক কম ছিল না। ইহুদি ছাড়াও নিহতদের মধ্যে ছিল সোভিয়েত যুদ্ধবন্দি, রোমানি ভাষাভাষী যাযাবর জনগণ, স্লাভ ভাষাভাষী মানুষ, প্রতিবন্ধী, সমকামী পুরুষ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ।
বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবের পর যখন ‘আয়না ঘরের’ মতো একটা বন্দিশালার নির্যাতনের কথা প্রকাশিত হলো, তখন ফ্যাসিবাদী শাসনের নির্মমতা সম্পর্কে জেনে এ দেশের মানুষ আঁতকে উঠেছিল। সম্প্রতি গুম-খুন-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন যে প্রামাণ্য চিত্র প্রকাশ করেছে, তাতে অন্যান্য নির্যাতন পদ্ধতির পাশাপাশি ‘আয়না ঘরের’ নির্যাতনের যে বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে, তা হিটলারের গ্যাস চেম্বার থেকে কম নয়। হয়তো আয়না ঘরের ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস ঢোকানো হয়নি, কিন্তু যেভাবে কক্ষগুলো নির্মিত হয়েছে, তাতে একজন সুস্থ মানুষেরই শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এই প্রামাণ্য চিত্র সম্প্রচারিত হওয়ার পর এদেশের সাধারণ মানুষ আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারল, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ কত রকমে, কতভাবে, কত কায়দায় এবং কত নিষ্ঠুরভাবে সংঘটিত হয়েছে।
পরিশেষে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন-উত্তর পরিস্থিতিতে এ সত্যটি স্বীকার করতে হবে যে, কিছু কর্মকর্তার মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গোটা একটা প্রতিষ্ঠান কখনোই দায়ী হতে পারে না। বরং জুলাই বিপ্লব সুদূরপরাহত হয়ে যেত, যদি কিনা সেনাবাহিনী যথাসময়ে এগিয়ে না আসত।