Image description

সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট মাহবুব কামাল বলেন, ‘আজকের রাজনীতিতে মানুষ তার মানবিকতা হারাচ্ছে। সব কিছুকে চরমভাবে তুলে ধরার প্রবণতার কারণে মানুষ দুই ভিন্ন চেহারা ধারণ করছে—ফেরেশতা বা শয়তান। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও এই দুই চরমের মধ্যেই দাঁড়িয়েছেন। কামাল সতর্ক করে বলেন, এই ‘বিমানবীয়করণ’ শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।

 

 

তিনি বলেন, মানুষ আর মানুষের মতো আচরণ করছে না, তার চরিত্র ও কাজকে একেবারে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তথ্যের অতিরঞ্জন, যাচাইহীন খবর এবং বিভ্রান্তিকর বক্তব্য মানুষের ধারাবাহিক চিন্তাভাবনাকেও প্রভাবিত করছে। এভাবেই রাজনীতিতে মানুষ ধীরে ধীরে মানবিকতার বাইরে চলে যাচ্ছে। তাদের চেহারা আর সাধারণ মানুষ নয়—এরা হয় ফেরেশতা, হয় শয়তান।

 

সম্প্রতি সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামালের ‘অন্যমঞ্চে’ এক সাক্ষাৎকারে মাহবুব কামাল এসব কথা বলেন।

মাহবুব কামাল বলেন, সব কিছুই শতভাগ হতে হবে—ফলে মানুষ মানবিকতা হারাচ্ছে বা ‘বিমানবীয়করণ’ হচ্ছে। মানুষ আর মানুষ থাকতে পারছে না; মানুষ হয়ে যাচ্ছে হয় ফেরেশতা, না হয় শয়তান। উদাহরণস্বরূপ, বঙ্গবন্ধুকে কেউ ফেরেশতা বানাচ্ছে আবার কেউ বানাচ্ছে শয়তান।

 
এই বিমানবীয়করণ রাজনীতিতে নানাভাবে প্রভাব ফেলছে।  

 

তিনি বলেন, সংখ্যাতত্ত্বের ক্ষেত্রে এক ধরনের অতিরঞ্জন লক্ষ করা যাচ্ছে। সব কিছুই সব ক্ষেত্রে বড় বড় আকারে দেখানো হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, জাসদ নিয়ে প্রচলিত একটি কাহিনী হলো—বঙ্গবন্ধুর আমলে তাদের ৪০ হাজার কর্মী নাকি নিহত হয়েছিল। কিন্তু আমি প্রায়ই এটি শুনি এবং প্রকৃত সংখ্যা কত তা স্পষ্ট নয়।

 
একটি টকশোতে শামসুজ্জামানকে বলেছিলাম, যদি আপনি ৩০০ জনের একটি তালিকা দেন, আমি আর কখনো এই ইস্যু নিয়ে কথা বলব না। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই তালিকা পাইনি। তালিকাটি তৈরি করা খুবই সহজ—৪৬০টি উপজেলায় একজন করে প্রতিনিধি পাঠানো, বয়স্ক লোকদের জিজ্ঞাসা করা, ‘জাসদের কতজন কর্মী নিহত হয়েছিল’, সব যোগ করলে সঠিক সংখ্যা পাওয়া যাবে।

 

জুলাই আন্দোলনে শহীদের সংখ্যা প্রসঙ্গে মাহবুব কামাল বলেন, বলা হচ্ছে, ২০০০ জন নিহত হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, ১৫০০ আর অন্তর্বর্তী সরকারের তালিকায় এসেছে ৮০০।  তাহলে কেন ২০০০ জনের কথা বলা হচ্ছে? একজন মানুষকেও হত্যা করলে তার ফাঁসি হবে, তাকে গ্লোরিফাই করার কোনো কারণ নেই। তাই, অতিরিক্ত সংখ্যা উল্লেখ করার দরকার নেই—সঠিক সংখ্যা বলা উচিত, মিথ্যাচারের কোনো জায়গা নেই।

তিনি বলেন, আরেকটি প্রবণতা হলো—কনসিস্টেন্সির অভাব। আগে যেটা বলা হচ্ছিল, পরে তার ধারাবাহিকতা দেখা যায় না। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের সঙ্গে প্রথম দিককার কথাবার্তাগুলো এখনকার বক্তব্যের সঙ্গে একেবারেই মেলে না। সরকার বিভিন্ন বিষয়ে পাল্টা মন্তব্য করছে, যার ফলে ধারাবাহিকতা হারাচ্ছে। এ ছাড়া, বিনিয়োগ সামিটের সময় যে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বক্তব্য রাখা হয়েছিল, তারও বিনিয়োগ সংক্রান্ত কোনো ধারাবাহিকতা দেখা যাচ্ছে না। রাজনীতির ক্ষেত্রেও—আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফেরার বিষয়ে আগে যে সুর ছিল, এখন কিছুটা পরিবর্তিত। অর্থাৎ, একটি বিষয় ধারাবাহিকভাবে একইভাবে বলা হচ্ছে না।

মাহবুব কামাল বলেন, আপনি দেখবেন, যে ন্যারেটিভ তৈরি হচ্ছে—সংখ্যাতত্ত্বের আড়ালে নানা তথ্য চালানো হচ্ছে। কাউন্টার-ন্যারেটিভের ক্ষেত্রে, যেমন বলা হয়, ‘এই সরকার দীর্ঘ সময় থাকবে না’—তারপর এই ন্যারেটিভগুলো আরো বাড়তে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, এখন বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ২৪০ মিলিয়ন ডলার পাচার করছে। পরে অন্য কোনো সরকার এলে বলা হবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ৫০০ মিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। কেউ প্রশ্নও করবে না। এই তথ্য যাচাই না করার প্রবণতা মারাত্মক।

তিনি বলেন, ওয়ান-সাইডেড স্টোরিতে সব সময় কিছু পাতা মিসিং থাকে। এক পক্ষের গল্পের মধ্যে সব তথ্য থাকে না। অন্য পক্ষের কথা শুনলে দেখা যায় মিসিং পেজগুলো কী ছিল। কিন্তু আমরা প্রায়ই এটি বুঝি না এবং একপক্ষের ন্যারেটিভ মেনে নেওয়ার মধ্যে মেতে থাকি, যাচাই করি না। তথ্য যাচাই না করা—এটাই আসল সমস্যা।

তিনি আরো বলেন, এটা খুবই মারাত্মক ব্যাপার—আমরা, সাংবাদিকরা যখন বাস্তবতা বলি, তখন অনেকেই মনে করে আমরা সেটা সমর্থন করছি বা কিছু বুঝাইতে চাইছি। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ বলেন সাবেক শিল্পমন্ত্রীর জানাজায় এত মানুষ উপস্থিত হয়েছিল, তখন বলবে, ‘উনি আওয়ামী লীগের শক্তি দেখাতে চাইছেন’। আবার আওয়ামী লীগের কোনো বড় মিছিল হলে সেটা বললে বলবে, ‘মিছিলটিকে উসকানি দেওয়ার জন্য এসব বলা হচ্ছে’।

মাহবুব কামাল বলেন, যুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। কেউ জন্মগতভাবে যুক্তিশীল, কেউ পড়ে যুক্তিশীল হয়েছে, কিন্তু অনেক ভুল তত্ত্ব বা ফেলাসি আছে—যা আপাতত সত্য মনে হয়, কিন্তু বাস্তবে সত্য নয়। উদাহরণস্বরূপ, আপনি চেয়ারটিতে বসেছেন, চেয়ার মেঝেতে লাগানো আছে—কেউ বলবে, ‘আপনি মেঝেতে বসে আছেন’। এটিই একটি যুক্তিবিদ্যার ফেলাসি।

এনসিপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, আরেকটি প্রবণতা হলো ওভারস্ট্রেস করা। নিজের শক্তি বা ক্ষমতাকে অতিরঞ্জিতভাবে বড় দেখানো। আমরা নিজের শক্তিকে কল্পনার চেয়েও বেশি মনে করি। কেউ খোলাখুলি বলছে, আওয়ামী লীগকে নির্মূল করে দেব—যেন এটা মশা মেরে ফেলার মতো সহজ কাজ। এই ধরনের কথা সমাজের মধ্যে গভীরভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

এমন ভয়ানক কণ্ঠস্বর আরো বাড়ছে—‘ক্যান্টনমেন্ট উড়িয়ে দেওয়ার মতো শক্তি নাকি তাদের আছে’, এনসিপির দাবি না মানলে কিভাবে নির্বাচন হবে সেটাও তারা দেখবে—এ ধরনের জোরালো দাবি ও হুমকি রাজনৈতিক বাস্তবতাকে কঠোর করে তোলে এবং সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে।

 

মাহবুব কামাল