Image description

আলফাজ আনাম

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভূমিধস বিজয়ে অনেকে বিস্মিত। কিন্তু যারা গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী তরুণদের মনোজগতে পরিবর্তনের বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন, তাদের কাছে এই ফল মোটেও অস্বাভাবিক নয়। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই দেশের তরুণদের রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এসেছে, এই ফল তার একটি নমুনা মাত্র।

চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পর ডাকসু ছিল বড় আকারের প্রথম নির্বাচন। যে নির্বাচনে প্রায় ৭৮ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রথমবারের মতো কোনো ভোটে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, যা ছিল এই শিক্ষার্থীদের জীবনে অবিস্মরণীয় ঘটনা। ১৯৯০ সালের পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির প্রকাশ্য কার্যক্রম চালাতে পারেনি। অথচ ১৯৭৭ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে শিবিরের জন্ম হয়েছে। প্রায় ৩৫ বছর পর শিবির প্রকাশ্যে আসার পর ছাত্রদের এই অভূতপূর্ব সমর্থন পেল।

ডাকসু নির্বাচনের ফল নিয়ে দেশের কথিত সুশীল-এলিট ক্লাস শুরু থেকেই ছিল উদ্বিগ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামপন্থি একটি ছাত্রসংগঠনের উত্থানকে তারা দেখছে ভীতির চোখে। কিন্তু এই নির্বাচনের ফলের মধ্য দিয়ে গণঅভ্যুত্থানের মৌলিক একটি দিক ফুটে উঠেছে। সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়ন ও রাজনৈতিক অধিকার হরণের যে ন্যারেটিভ বা বয়ান, তা ব্যর্থ প্রমাণ হয়েছে। হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে জামায়াত-শিবির ও ইসলামপন্থিদের ওপর শুধু এই কৌশল প্রয়োগ করা হয়নি, বিএনপিকে তারা স্বাধীনতাবিরোধী একটি দল হিসেবে চিত্রিত করেছে। এমনকি স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানি চর বলে চরিত্র হননের চেষ্টা করা হয়েছে। হাসিনার এই চেতনার রাজনীতিতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা ক্ষুব্ধ।

ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে ৭১-এর চেতনা দিয়ে কোণঠাসা করার যে প্রচেষ্টা প্রতিপক্ষ সংগঠনগুলো চালিয়েছে, তাতে সাধারণ ছাত্ররা কোনো সাড়াই দেননি। বরং তারা গুরুত্ব দিয়েছেন নিরাপদ ক্যাম্পাস, হলগুলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা, শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলো কী ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এর ওপর। মতাদর্শগত রাজনীতির নামে বিভাজন কিংবা রাজনীতির পুরোনো রেটরিক তারা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী গ্রামের নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের জীবনযাপনের মধ্যে রয়েছে ইসলামের প্রভাব। কিন্তু বছরের পর বছর এই শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে পারিবারিক শিক্ষা ও ইসলামি মূল্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার প্রচেষ্টা মেনে নিতে হয়েছে। টুপি, দাড়ি এমনকি নামাজ পড়ার জন্য অনেককে নির্যাতিত হতে হয়েছে। ৫ আগস্টের পর তারা যে মুক্ত পরিবেশ পেয়েছেন, তাতে শিবিরের নেতাকর্মীদের তারা আপন হিসেবে পেয়েছেন। কিন্তু এ কথাও মনে রাখতে হবে, ইসলামী ছাত্রশিবির যে মতাদর্শের রাজনীতি করে, শিক্ষার্থীরা তা সমর্থন করেছেনÑএমন নয়। তারা মনে করেছেন, শিবিরের নেতাকর্মীদের জয়ী করলে তাদের স্বার্থরক্ষা করতে পারবেন।

শিবির যে ইশতেহার নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে হাজির হয়েছে, সেখানে সমস্যা সমাধানের তাদের চমৎকার কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে, যা সংগঠনটির নেতৃত্বের প্রতি আস্থা স্থাপনে ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবির নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করেছে। এর মধ্যে কিছু ছিল সেবামূলক আর কিছু ছিল ছাত্রদের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রচারণামূলক কর্মসূচি। যেমনÑসায়েন্স ফেস্ট ও জুলাই আগস্টের আন্দোলন নিয়ে নানা ধরনের প্রোগ্রাম। এসব কর্মসূচি সাধারণ শিক্ষার্থীদের শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি, তাদের সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ বহন করে।

শিবিরের প্রতি সাধারণ ছাত্রদের আস্থার আরেকটি কারণ ছিলÑসংগঠনটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতি বার্তা দিতে পেরেছে, তাদের যেভাবে নিখাদ একটি ধর্মীয় ছাত্রসংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তারা তেমনটি নয়। তারা যে প্যানেল দিয়েছে, সেটি অন্য যেকোনো প্যানেলের চেয়ে ছিল বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। হিজাবি এবং নন-হিজাবি নারীর অংশগ্রহণ যেমন ছিল, তেমনি ধর্মীয় সংখ্যালঘু ছাত্রের উপস্থিতি ছিল, যা শিক্ষার্থীদের নজর কেড়েছে।

মনে করা হতো, ইসলামী ছাত্রশিবির নারীদের ভোট কম পাবে। কিন্তু এই প্রচার ভুল প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিটি মেয়ে হলে শিবিরের প্রার্থী বেশি ভোট পেয়েছেন। এমনকি নারীরা সম্ভবত শিবিরকে পূর্ণ প্যানেলে ভোট দিয়েছেন, যা তাদের ভূমিধস বিজয়ে সাহায্য করেছে।

এ কথা স্বীকার করতে হবে, শিবির প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসার পর সংগঠনটি সম্পর্কে সাধারণ ছাত্রদের মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। বছরের পর বছর ধরে এই দেশের গণমাধ্যমে শিবিরকে দানব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিবিরের ওপর যে নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, তার বড় দায় আছে গণমাধ্যমের। কিন্তু শিবির প্রকাশ্যে রাজনীতিতে আসার পর অনেক শিক্ষার্থী চমকে গেছেন। শিবিরের সঙ্গে এমন ছেলেদের দেখেছেন, যারা তার পাশে থেকে লেখাপড়া করেছেন। এমনকি তার ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে ভালো শিক্ষার্থীও হয়তো শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

ডাকসু নির্বাচনের ফলের পর আরেকটি প্রশ্ন সামনে এসেছে, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল কেন ছাত্রদের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হলো? সাধারণভাবে ছাত্রদল যেভাবে প্রার্থী নির্বাচন করে, এবার ব্যতিক্রমী পদ্ধতিতে দলের সমর্থকদের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করা হয়েছিল। ঘোষণার পর এটি ভালো প্যানেল হিসেবে প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু ছাত্রদলের নীতিনির্ধারকরা ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সাধারণ ছাত্রদের যে মনোভাব, তা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। অনেক শিক্ষার্থী মনে করেছেন, ছাত্রদল বিজয়ী হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় দখলদারি কায়েম হতে পারে। আবার গেস্টরুমে রাখা ও জোরপূর্বক মিছিলে নিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। ছাত্রদের এই ভীতি দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে ছাত্রদল। আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল হলে কমিটি দেওয়া। হলগুলোয় কমিটি ঘোষণা না করেও ছাত্রদল নিজেদের প্রার্থী দিতে পারত। এই কমিটি ঘোষণার পর থেকে ছাত্রদলের ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে।

ছাত্রদলের প্রচারে কৌশল ছিল ভুলে ভরা। ইশতেহারে দেওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য নেওয়া ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরার চেয়ে তারা শিবিরের সমালোচনায় ছিল বেশি ব্যস্ত। নেতিবাচক প্রচারের মাধ্যমে ছাত্রদের কাছে শিবিরকে সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরেছে ছাত্রদল। এর ফলে শিবিরের ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আরো বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। শিবিরের ভিপি প্রার্থী সব সময় জুলাই আন্দোলন ও ছাত্রদের সমস্যার দিকে আলোকপাত করেছেন। জুলাই আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার পরও তিনি নিজের ভূমিকার কথা প্রচারে ব্যবহার করেননি। অন্যদিকে ছাত্রদলের প্রার্থীরা ব্যক্তির ভূমিকা বড় করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে আত্মপ্রচারণামূলক বলে মনে হয়েছে এবং শিবির তাদের প্রচারে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমস্যার ওপর। তারা বছর ধরে শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি পালন করেছে। স্বাভাবিকভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছেÑশিবির বিজয়ী হলে শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে কাজ করতে পারবে।

শিবিরকে কোণঠাসা করতে ছাত্রদল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং ৭১-এ জামায়াতের ভূমিকা সামনে আনার চেষ্টা করছে। নিজেদের বাংলাদেশপন্থি দাবি করে শিবিরকে পাকিস্তানপন্থি ট্যাগ দেওয়ার চেষ্টা করে। ছাত্রদলের এই কৌশল বুমেরাং হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতায় স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষের এই বিভাজনের রাজনীতি সাধারণ ছাত্ররা ভালোভাবে নেয়নি। ছাত্রদলের নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত ছিল, গণঅভ্যুত্থান সফল হয়েছে দেশের মানুষ বিভাজনের ঊর্ধ্বে ওঠে রাজপথে নামার কারণে। আবার যখন তারা দেখছেন, স্বাধীনতার বিপক্ষের আওয়ামী ন্যারেটিভ সামনে এসেছে, শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছেন। এছাড়া কিছুদিন থেকে ভারত, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি প্রশ্নে বিএনপির কয়েকজন নেতার বক্তব্য-বিবৃতি দলটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনোভাবে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। রাজনীতিসচেতন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর বাইরে নন। দেশের অনেক মানুষ মনে করেন, বিএনপি একটি ভারতঘেঁষা রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। ডাকসু নির্বাচন কেন্দ্র করে ছাত্রদলের মুখে আওয়ামী প্রচারে এই ধারণাকে আরো বদ্ধমূল করেছে।

এছাড়া ছাত্রদলের প্রচার কৌশল ছিল পুরোপুরি বাম প্রভাবিত। বিএনপির ভেতরে প্রভাব বিস্তার করা গুপ্ত বামপন্থিরা প্রচার মাধ্যমে যে ধরনের বক্তব্য দেন, ছাত্রদলের প্রচার কৌশলে একই ন্যারেটিভ দেখা গেছে। এ ধরনের বামধারার প্রচার কৌশল ছাত্রদলের জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে। দেশ ও বিদেশে থাকা কয়েকজন সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে ছাত্রদলকে বিজয়ী করার যে বয়ান দিয়েছেন, তা ছাত্রদলের সামগ্রিক রাজনীতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের বয়ান যখন ছাত্রদলের প্রচারে দেখেন, তখন স্বাভাবিকভাবে তারা ছাত্রদল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। ডাকসু নির্বাচন শুধু ছাত্রদলের জন্য বিপর্যয় নয়, আগামী নির্বাচন ঘিরে বিএনপির রাজনীতির জন্য একটি সতর্ক বার্তা।

ডাকসু নির্বাচনের ফল জাতীয় রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ডাকসু নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচন মোটেও একধরনের নয়। রাজনৈতিক ইস্যুর চেয়েও বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক সমস্যাগুলো সামনে রেখে শিক্ষার্থীরা এবার ভোট দিয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হতে একজন প্রার্থীর ক্ষেত্রে যেসব ফ্যাক্টর কাজ করে, ডাকসুর ক্ষেত্রে তেমনটা না। একটি নির্দিষ্ট বয়সের এবং কর্তৃপক্ষের কাছে একই ধরনের চাওয়া-পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আছে, এমন মানুষ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভোট দিয়ে থাকেন। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে নানা বয়সের ও নানামুখী আকাঙ্ক্ষা থেকে মানুষ ভোট দিয়ে থাকেন। তবে এই নির্বাচনের ফল থেকে তরুণ ভোটারদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমরা অনুমান করতে পারি। আগামি নির্বাচনে অবশ্যই এর প্রভাব পড়বে।