
ড. মাহবুব উল্লাহ্
১৯৯১ সালের সংসদীয় নির্বাচনের প্রচারণা চলাকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাউঞ্জে নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে বিতর্ক হচ্ছিল। প্রয়াত অধ্যাপক আর আই চৌধুরী ও আমি বললাম, গণজোয়ার বিএনপির পক্ষে। উপস্থিত অন্য শিক্ষকরা বললেন, দলটি বড়জোর ২০টি আসন পেতে পারে। ভোট গ্রহণের পর দেখা গেল, বিএনপি সর্বাধিক আসনে জয়লাভ করেছে।
ওই সময় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি খুব সংগঠিত ছিল না। তরুণদের ওপর নির্ভর করে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছিলেন। ‘ওদের হাতে গোলামির শৃঙ্খল, আর আমাদের হাতে মুক্তির ঝান্ডা’– তাঁর এই স্লোগান ভোটারদের আকৃষ্ট করেছিল। আরেকটি ঘটনা আওয়ামী লীগের ভোট হ্রাস করেছিল। নির্বাচন উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে শেখ হাসিনা স্বাধীনতার ঘোষক ও মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়ক জিয়াউর রহমানকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, কোনো এক অখ্যাত মেজরের ডাকে জনগণ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। জনগণ জিয়াকে এমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য পছন্দ করেনি। সব মিলিয়ে, আওয়ামী লীগের পরিবর্তে জনগণ বিএনপির পক্ষেই রায় দিয়েছিল।
আজ বিএনপির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে এ কথা বলা যায়, বিএনপির প্রতি জনগণের সমর্থন নির্ভর করে বিএনপির দেশপ্রেম এবং অন্যদের প্রতি তার সহনশীলতার ওপর। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, বিএনপি যতদিন তার জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতি অনুগত থাকবে, এবং যতদিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সততার পথে থাকবে, ততদিন দল হিসেবে বিএনপি থাকবে মর্যাদাশীল।
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্নে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছিল। ওই সময় জনগণ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক চেতনাকে ধারণ করে এমন কোনো রাজনৈতিক দল দেখতে পারছিল না। কারণ, ১৯৭৫-এ একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থা কায়েমের পর সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত হয়ে যায়। সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় মাত্র চারটি সংবাদপত্র চালু রাখা হয়েছিল। জনগণের বাক্স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান পরিণত হয়েছিলেন মহাক্ষমতাধর একজন প্রেসিডেন্টে। জনগণ এই পরিস্থিতির অবসান মনেপ্রাণে কামনা করেছিল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিহত হওয়ার পর ওই বছর ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার পাদপ্রদীপের নিচে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। এই জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ একাত্তরে শত হতাশা ও বিহ্বলতার মধ্যে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যা অন্য কেউ করতে পারেনি।
রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব লাভের পর জিয়াউর রহমানের একমাত্র ধ্যান ও চিন্তা ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন এবং সকল ক্ষমতার উৎস জনগণের কাছে তাদের হৃত ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। একজন সামরিক শাসক জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। জিয়াউর রহমান এ ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় ব্যতিক্রম। রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে তার মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করে জনগণের মাঝে জনগণের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়াই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান।
১৯৭৮ সালে বিএনপি গঠিত হয়েছিল স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের চেতনায় দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তি ও দলকে সমন্বিত করে। বিএনপি গঠনে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মরহুম মশিউর রহমান যাদু মিয়া গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। ১৯৭৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মরহুম যাদু মিয়া জিয়াউর রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে শক্তি জুগিয়েছিলেন। এই নির্বাচনে জিয়াউর রহমান বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনের সময় যাদু মিয়া বিশ্বাস করতেন সামরিক ও বেসামরিক শক্তির সমঝোতার মধ্য দিয়েই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এবং তাই হয়েছিল।
১৯৭৮-এ বিএনপি গঠনের সময় এর মধ্যে নানা স্রোতধারা এসে মিশেছিল। এর ফলে দলটি সংহত হতে সময় নেয়। নানা রাজনৈতিক স্রোতধারার টানাপোড়েনে দলটি সুঠাম হয়ে উঠতে পারেনি।
জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর বিএনপির মধ্যে কেন্দ্রাতিত প্রবণতা প্রবলভাবে দেখা দেয়। ওই পর্যায়ে সমস্যার সমাধানের জন্য খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব বিএনপি বেছে নেয়। অবশ্য কেউ কেউ দলত্যাগ করে। খালেদা জিয়া ছিলেন নিছকই গৃহবধূ। বিএনপির মতো বড় দলের নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি ছিল তাঁর কল্পনারও অতীত। কিন্তু তাঁর আপসহীন বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বিএনপি ঘুরে দাঁড়ায়। দীর্ঘ ৯ বছরের এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তিনি একমুহূর্তের জন্য আপস করেননি। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ওয়াদা ভঙ্গ করে অংশগ্রহণ করে, কিন্তু খালেদা জিয়া আপসের চোরাগলিতে পা দেননি। ১৯৯০ সালে ছাত্র গণঅভ্যুত্থান সফল হয়। এরশাদ ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়ে কারারুদ্ধ হন। এরপর ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।
এই পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় পার্টি সম্মিলিতভাবে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলনে সহিংসতার মাত্রা ছিল ভয়াবহ। ১৭৩ দিন হরতাল পালিত হলে দেশের অর্থনীতি খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। খালেদা জিয়া প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিতে চাননি। অবশেষে তিনি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে পার্লামেন্ট গঠিত হয়, সেই পার্লামেন্টেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে সসম্মানে ক্ষমতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে হস্তান্তরের সুযোগ করে দেন। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের অন্তর্গত হয়ে যায়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হলেও সংসদে স্মরণকালের মধ্যে বৃহত্তম বিরোধী দলে পরিণত হয়।
এ পর্যায়ে দেশের দায়িত্ব অর্পিত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ওপর। শেখ হাসিনার শাসন ব্যবস্থা সেই আমল থেকেই স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। তাই ২০০১ সালের নির্বাচনে জনগণ বিএনপিকে বিপুলভাবে বিজয়ী করে।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিএনপি সেই সময় যথেষ্ট প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারেনি। এর সূচনা হয় বিশাল মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে। এ ছাড়া বিএনপির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রও প্রবল হয়ে ওঠে। টুইন টাওয়ারের ঘটনার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে অনন্ত যুদ্ধের সূচনা করা হয়, সেই যুদ্ধের ছাইভস্মও বিএনপির ওপর পতিত হয়। তবে বিএনপি তার মেয়াদ পূর্ণ করতে সক্ষম হয়। এরপর আসে নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রশ্ন। এই প্রশ্নে একদিকে আওয়ামী লীগ ও তার সমমনা দলগুলো ক্ষতিকর কৌশলের আশ্রয় নেয়। বিএনপিও এর বিরুদ্ধে বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এই পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়। দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় ফখরুদ্দীন-মঈনুদ্দিনের সংবিধানবহির্ভূত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দুই বছর ধরে বিএনপি এই সরকারের হাতে দারুণভাবে পর্যুদস্ত হয়। খালেদা জিয়াও কারারুদ্ধ হন। অবশ্য আওয়ামী লীগের ওপরও কিছু নির্যাতন হয়। তবে তা বিএনপির তুলনায় ছিল অকিঞ্চিৎকর। তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ শেষ হতে থাকলে এই সরকারের বিদায়ের প্রশ্নটি সামনে আসে। শেখ হাসিনা এই সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে একে নিরাপদে বিদায় নেওয়ার সুযোগ করে দেন। কিন্তু খালেদা জিয়া এদের সঙ্গে কোনো রকম আপসরফায় যাননি।
২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। গুম-খুন, কারা নির্যাতন, মিথ্যা মামলা ও আয়নাঘরে আটক করে বিএনপির মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলার আয়োজন করা হয়। তিন তিনটি নির্বাচন হলো, যেসব নির্বাচনে সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পারেনি। দেশটি নরককুণ্ডে পরিণত হয়। অন্যদিকে, শেখ হাসিনা, অলিগার্ক, অনুগত আমলা ও অনুগত বুদ্ধিজীবীদের একটি নেক্সাস দেশে গড়ে ওঠে। স্বৈরশাসনের ভিত পাকা করা হয়। এই শাসন পরিণত হয় ভয়াবহ দানবীয় ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায়। এই ব্যবস্থায় বিএনপির ওপর চরম জুলুম-নির্যাতন চালানো হয়। বহু বিএনপিকর্মী ও সমর্থক নিহত হন। হাজার হাজার বিএনপিকর্মী ও নেতা কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে নিক্ষিপ্ত হন। এত সব নিপীড়ন সত্ত্বেও বিএনপিকে ভাঙা সম্ভব হয়নি। দলটি খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক রহমানের নেতৃত্বে অটল থাকে। অন্যদিকে, খালেদা জিয়া ঢাকার পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে কারারুদ্ধ হন। কারাগারে তাঁর জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল।
সাড়ে ১৫ বছর ধরে বিএনপি প্রায় এককভাবে ফ্যাসিবাদী হাসিনার সরকারের সব প্রকার জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়। বিএনপির ওপর যে জুলুম ও নির্যাতন হয়, তা ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা হয়ে ওঠে। অবশেষে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে তরুণদের নেতৃত্বে যে বিশাল ও গভীর গণঅভ্যুত্থান হয়, তার ফলে শেখ হাসিনা ও তাঁর দল ক্ষমতাচ্যুত হয়। তিনি নিজে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। এই অভ্যুত্থানেও বিএনপির ব্যাপক অংশগ্রহণ দলটিকে ভয়াবহ নির্যাতনের কবলে ফেলে।
সব নির্যাতনের একদিন অবসান হয়। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী নির্যাতনেরও অবসান হয়েছে। বিএনপি এখন মুক্তভাবে রাজনীতি করতে পারছে। এত নির্যাতন সত্ত্বে বিএনপি যে টিকে আছে এবং ভালোভাবে টিকে আছে, তা প্রশংসনীয়। ফ্যাসিবাদের পতনের পর বিএনপির কিছু বিপথগামী কর্মী ও নেতা সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে দলটির সুনামের কপালে কালিমা লেপন করেছে। এদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয়ভাবে দলটি ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও গর্হিত কার্যকলাপ হ্রাস টেনে ধরা সম্ভব হচ্ছে না। জনগণের কাছে এ ব্যাপারে বিএনপির গৃহীত কার্যক্রম আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারলে ক্ষয় হয়ে যাওয়া আস্থা হয়তো ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচন নিয়েও শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। এই শঙ্কা দূরীভূত করতে বিএনপিকে মিত্র খুঁজে নিতে হবে এবং জনগণের কাছে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করে পরিষ্কার করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, বিএনপি যে দেশপ্রেমের রাজনীতি থেকে বিচ্যুতি হয়নি, তাও স্পষ্ট করা প্রয়োজন। আগামী দিনগুলোতে জনগণ দেখতে চায়, বিএনপি শহীদ জিয়া ও খালেদা জিয়ার পথেই অবিচল রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ; সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়