
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মনে করছেন ভিপি প্রার্থী ইয়াসিন আরাফাত। ক্যাম্পাসে আধিপত্য ও স্বৈরাচারী রাজনীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অঙ্গীকার করে ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ সমর্থিত ‘সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেলের এই প্রার্থী বলেন, নির্বাচিত হলে আবাসন সংকট, শিক্ষক রাজনীতি, নিরাপত্তা, খাদ্য সংকটসহ বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান করা হবে। একই সঙ্গে একাডেমিকভাবে শক্তিশালী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) গড়ে তোলাই আমার প্রধান লক্ষ্য। আমার দেশ’র বিশেষ সাক্ষাৎকারে ডাকসু ঘিরে নিজের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি আমার দেশ-এর সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ‘আমার প্রধান প্রতিশ্রুতি হলো— ক্যাম্পাসে আর কখনো আধিপত্যের রাজনীতি ফিরতে দেওয়া হবে না।’
ইয়াসিন আরাফাত ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের শিক্ষার্থী। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে। তার কাছে ঢাবির বিদ্যমান প্রধান সংকট কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাবির প্রধান সংকট আবাসনের অপ্রতুলতা। এটিকে পুঁজি করে ক্ষমতাসীনরা গণরুম-গেস্টরুম সংস্কৃতি চালায়। ক্যাম্পাসে ভীতির পরিবেশ তৈরি করে। আগে একটি সিটের জন্য শিক্ষার্থীদের অপব্যবহার করা হতো।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বড় সংকট হলো— শিক্ষক রাজনীতি। শিক্ষকরা সাদা দল, নীল দল ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে রাজনীতির দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে। একাডেমির দিকে মনোযোগ দেন না। এখানে শিক্ষক রাজনীতি ছাত্র রাজনীতির চেয়ে বড় ফ্যাক্টর। কেননা, শিক্ষকরা রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে প্রশাসনিক বড় বড় পদ বাগিয়ে নেন। হলের প্রভোস্ট থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় প্রশাসনিক পদে দলীয় লোক বসানো হয়। আর এই দলীয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন লাঠিয়াল বাহিনীকে অপরাজনীতি করার সুযোগ দেয়। তাদের প্রশ্রয় দেয়। এছাড়া নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যের সমস্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সংকট।
কেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চান— এমন প্রশ্নের উত্তরে ইয়াসিন আরাফাত বলেন, একাডেমিকলি সাউন্ড একটি বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে চাই। একাডেমিক অর্জন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে ঢাবির শীর্ষ স্থান অর্জন করুক- এটি আমার চাওয়া। আমি নির্বাচিত হলে শিক্ষার সঠিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য যা যা করা দরকার তা করব।
তিনি আরো বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বৈরাচারী রাজনীতি, আধিপত্যের রাজনীতিকে আর ফিরে আসতে দেব না। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থানের রাজনীতি চাই। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতিকে আরো বেশি ত্বরান্বিত করতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিকভাবে অনেক বেশি এগিয়ে যাক— এটাই প্রত্যাশা।
নির্বাচিত কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবর্তন আনবেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে এই ভিপি প্রার্থী বলেন, প্রথমত একাডেমিক যেসব চাহিদা রয়েছে যেমন আবাসন, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন ক্লাসরুম, গবেষণা ফ্যাসিলিটিস, নিরাপদ খাবার, স্বাস্থ্য সুরক্ষা— এগুলো নিয়ে কাজ করব। দ্বিতীয়ত, আমি ক্যাম্পাসে সহাবস্থানের রাজনীতি নিশ্চিত করব। ক্যাম্পাসে আধিপত্যের রাজনীতি, স্বৈরাচারের রাজনীতি— এগুলোর ওপর জিরো টলারেন্স থাকবে। এজন্য আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ, আহতদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
বিগত ডাকসু নির্বচনের তুলনায় এবারের ডাকসু নির্বাচন কেন বেশি গুরুত্বপূর্ণ—এমন প্রশ্নের উত্তরে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের এই নেতা বলেন, ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন হয়েছিল স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে। সেটা কোনো নির্বাচন ছিল না— ধোঁকা ছিল। ওই নির্বাচনে কৃত্রিম লাইন সংকট তৈরি করে আমাদের ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছিল। আমরা কেউ ভোট দিতে পারিনি।
তিনি বলেন, অন্যদিকে আসন্ন ডাকসু নির্বাচন জুলাইয়ের শহীদদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের নির্বাচন। এই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া অনেক বেশি জরুরি। কেননা, এই নির্বাচনের প্রভাব আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে পড়বে। জুলাই-পরবর্তী একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে আসন্ন ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হোক— এটিই সবার প্রত্যাশা।
আপনাদের প্যানেল নিয়ে কতটুকু আশাবাদী—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগেও আমরা পূর্ণাঙ্গ প্যানেলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি। যে সময় নামাজ পড়লে শিক্ষার্থীদের জঙ্গি-শিবির তকমা দেওয়া হতো, তখনো আমরা পূর্ণাঙ্গ প্যানেলে নির্বাচন করেছি। আমরা সেই হিম্মত দেখিয়েছি। সুতরাং, শিক্ষার্থীরা আমাদের পাশে থাকবে, আমাদের মূল্যায়ন করবে বলে মনে করি।
তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা ছিল। ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের বিরোধিতা করে আমরা গুটিকয়েক শিক্ষার্থী লালকার্ড দেখিয়েছিলাম। টানা সাতদিন রাজু ভাস্কর্যের সামনে অবস্থান নিয়েছিলাম। জুলাই অভ্যুত্থানে আমরা সরকারের কারফিউ ভেঙে আন্দোলন করেছি। মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সংগঠিত করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। সুতরাং, শিক্ষার্থীরা আমাদের নিরাশ করবে না।
প্যানেলের কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমরা ১৯৭১, ১৯৫২, ১৯৪৭, ২০২৪-সহ সব সংগ্রামের চেতনাকে ধারণ করি। তবে কখনো চেতনা ব্যবসা করি না। আমাদের ফ্রেশ ইমেজ, স্বচ্ছতা রয়েছে। আমরা সুদ, ঘুষ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিতে জড়িত ছিলাম না। কোনো সদস্যের খারাপ ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। সুতরাং শিক্ষার্থীরা ভোট দেওয়ার আগে আমাদের এই অবস্থানকে মূল্যায়ন করবে।’
নির্বাচন ঘিরে নিরাপত্তা ও সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইয়াসিন আরাফাত বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি— নির্বাচন কমিশন নির্দিষ্ট কিছু সংগঠনকে বেশি সুবিধা দিচ্ছে। যেমন ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম পাঠকক্ষে ঢুকে প্রচার চালাচ্ছেন। তাছাড়া শিবিরসহ অন্য প্রার্থীরাও প্রতিনিয়ত আচরণবিধি ভাঙলেও নির্বাচন কমিশনের কোনো শক্ত হস্তক্ষেপ নেই। শিবিরের ব্যানারে প্রার্থীদের ছবি বিকৃতি করা হলেও ব্যবস্থা নেয়নি কমিশন। এমন অবস্থায় তারা কতটা স্বচ্ছ নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবেন, তা নিয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে।
ভিপি হিসেবে যদি নির্বাচিত নাও হোন, শিক্ষার্থীদের কল্যাণে আপনার ভূমিকা কেমন হবে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো কিছু পাওয়ার উদ্দেশ্যে রাজনীতি করি না। আমরা আগে থেকে যে কোনো অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি, ভবিষ্যতেও নেব। আমরা শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের যে কোনো দাবির সঙ্গে একাত্ম থাকব।’