
শামসু মিয়ার টং দোকান আকারে ছোট হলেও বেশ জমজমাট। মালামাল খুব বেশি নেই। চা-পান-সিগারেট ছাড়া আছে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু সাংসারিক পণ্য। গ্রাহকদের বসার জন্য চেয়ার-বেঞ্চ-টুল আছে। বিভিন্ন পেশার নিম্নবিত্ত মানুষই তার গ্রাহক। ভবঘুরে-বেকার লোকজনও সেখানে সময় কাটায়। সারাক্ষণ টেলিভিশন চলে। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা উত্তপ্ত হলে খবর আর টক শোর দর্শক বাড়ে। নিরুত্তাপ রাজনৈতিক পরিস্থিতি থাকলে বাংলা সিনেমা চলে দেদার। সময় বুঝে চ্যানেল পাল্টায় শামসু। এক কাপ চা আর একটা পান-সিগারেটে ঘণ্টা পার করলেই তাগাদা দেয় শামসুর ছেলে। নতুন কিছু অর্ডার না করলে আসন ছেড়ে দিতে বলে। অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও টিভি দেখে। এসব দর্শক নীরব নয়, রীতিমতো সরব। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অনেক সময় এ পথ সংসদে শামসুকে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ সময় তাকে দার্শনিক মনে হয়। তিনি বলেন, এখন আর মানুষ খুঁজে পান না। সবাই জনতা। সাধারণ মানুষ বলে কিছু নেই। সবাই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত। জুলাই অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগ ও দলটির বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের অতিপরিচিত নেতাকর্মীরা পালিয়েছে। তাদের অনেকের কাছে বাকি আটকে গেছে। তবে এখন নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। দলটির আতিপাতি পর্যায়ের কোনো কোনো নেতাকর্মী এখন নিজেকে বিএনপি বলে দাবি করছে। বিএনপির সুযোগসন্ধানী নেতারা নিজের গ্রুপকে শক্তিশালী করতে এ অনুপ্রবেশের সুবিধা দিচ্ছে। এতে করে দলের ত্যাগী-ভুক্তভোগী নেতাকর্মীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এ সমস্যা শুধু তৃণমূলে নয়। কেন্দ্র পর্যন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে।
পলাতক আওয়ামী লীগ নেতাদের ব্যবসায়ী অংশীদার হয়ে তাদের সম্পদ পাহারা ও ভোগের বন্দোবস্ত করছে কেউ কেউ। বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ হরহামেশাই শোনা যায়। শুধু বিএনপি নয়, জামায়াত-এনসিপির নেতাদের বিরুদ্ধেও এরকম সমালোচনা আছে। তবে বিএনপি বড় দল। লাখ লাখ নেতাকর্মী। তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনাগুলো দ্রুত প্রচার ও জনপ্রিয়তা পায়। এ ছাড়া কোনো কোনো বিএনপি নেতার অতি প্রগল্ভতায় সন্দেহের সত্যতা মেলে। ভাইরাল হওয়ার লোভে নানারকম উল্টাপাল্টা কথা বলে তারা। তারেক রহমান সম্পর্কে বলার আগে ওজু করতে হবে, খালেদা জিয়া নোবেল পাওয়ার দাবিদার, বিএনপি প্রস্রাব করলে অন্যরা ভেসে যাবে—এসব কথায় তাদের অহমিকা প্রকাশ পায়। তখনই প্রতিদ্বন্দ্বীরা প্রচার করে, ‘এখনই এ অবস্থা। ক্ষমতায় গেলে কী করবে?’ ক্ষমতায় এখন নির্দলীয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী দলগুলো তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। ফলে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদ এবং কিছু ইসলামী ও বাম দল সাধ্যমতো সরকারি দলের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। অঞ্চলভেদে দলগুলো ক্ষমতার চর্চা করে। সচিবালয়সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অফিস-আদালতে এনসিপির সিন্ডিকেট নেটওয়ার্ক ব্যাপক সমালোচিত। বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক-বীমা প্রতিষ্ঠানে জামায়াতের প্রভাব প্রায় প্রমাণিত। জলমহাল-বালুমহাল-পাথর কোয়ারি থেকে বাসস্ট্যান্ড-টেম্পোস্ট্যান্ড সবই রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে মিলেমিশে ভোগ করছে পেশাদার চাঁদাবাজরা। হিসাবে গরমিল হলেই কাদা ছোড়াছুড়ি করছে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা বিপ্লবীরা। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিএনপিকে তখন আওয়ামী তকমা দেওয়ায় প্রচারণায় নামে অন্যরা। এসব জেনেবুঝেও বিএনপির কিছু অধৈর্য নেতাকর্মী ফাঁদে পা দেয়। এরই মধ্যে প্রায় সাত হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। দলের হাইকমান্ড প্রতিনিয়ত সতর্ক করছে। উদার ও সহনশীল বক্তব্য এবং জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। কিন্তু দলের বেয়ারা, লোভী নেতাকর্মীরা সেই তিমিরেই রয়ে গেছেন। এতে করে তারেক রহমানের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তার নির্দেশ অমান্যের ধৃষ্টতা দেখিয়ে বিএনপিকে ঝুঁকিতে ফেলছে অর্বাচীনরা।
শুধু দলীয় নেতাকর্মী নয়। সরকারি কর্মচারীরাও লেবাস পাল্টানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সবাই জানে, হাসিনা রেজিমে তাদের ভূমিকা। ফ্যাসিস্টের নির্দেশে রাতকে দিন আর বিরুদ্ধমত দমনে ঐকান্তিক চেষ্টা করে গেছেন শেষ পর্যন্ত। এখন সেসব আমলাও বঞ্চিত তালিকায় নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। পরিচিতিতে উল্লেখ করছেন, কোনো বিএনপি নেতার আত্মীয় তিনি। গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলের সমর্থক ছিলেন। পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছিল হাসিনা সরকারের আদেশ মানতে। এসব বলেকয়ে এরই মধ্যে পদোন্নতি, লোভনীয় পদ বাগিয়ে নিয়েছেন কেউ কেউ। বিএনপির আমলে চাকরি হওয়ায় বা দলটির কোনো নেতার আত্মীয় বলে অনেক কর্মচারী হয়রানির শিকার হয়েছেন হাসিনা যুগে। তাদের অনেকে এখনো সঠিক মূল্যায়ন পাননি। নতুন বিএনপি সমর্থকদের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছেন তারা। কেউ কেউ অভিমানে-অপমানে নিভৃতচারী হয়ে থাকছেন। এ সুযোগে চিহ্নিত ঘুষখোর কর্মকর্তারা টাকা ঢালছেন নিজেকে সুরক্ষা দিতে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সরকারি অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতাদের অতিথি করছে সুযোগসন্ধানী প্রশাসন। দাওয়াতপত্রে নামের সিরিয়াল নিয়ে বিবাদে জড়াচ্ছেন নেতারা। বিষোদগারের রসদ পাচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো। প্রচার করছে, তর সইছে না বিএনপির। অসৎ, ঘুষখোর কর্মচারীরা অবস্থা বুঝে বিএনপি নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রচার করছে। জুলাই আন্দোলনে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর গুলির নির্দেশদাতা অনেক ইউএনও, ওসি এখনো বহাল তবিয়তে আছেন। সামান্য নগদ লাভে তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলগুলো। তবে এ ক্ষেত্রে বরাবরের মতোই সিংহভাগ দায় চাপছে বিএনপির ওপর। অপপ্রচার রোধে প্রচারবিমুখ বিএনপি ব্যস্ত প্রতিদিনের লাভে। প্রতিমুহূর্তের ক্ষতি চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রশাসনের অতি উৎসাহ দেখে জামায়াত-এনসিপি অভিযোগ করছে, নির্বাচনের আগে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।
শিল্প-সাহিত্য-গণমাধ্যম জগতে বিএনপির অবস্থান বরাবরই দুর্বল। হয় তারা বোঝে না অথবা বুঝতে চায় না। তারা ধরেই নিয়েছে, এসব কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগ ও বাম দলের অনুসারীরা এগিয়ে থাকবে। এই প্রচলিত মিথ ভাঙার কোনো উদ্যোগ নেই বিএনপির। সবসময় ভাড়াটে বা ব্যক্তিগত পর্যায়ের শুভাকাঙ্ক্ষী দিয়ে প্রয়োজন মিটিয়েছে। কোনো চর্চাকেন্দ্র বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেনি তারা। তাদের মালিকানার গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ পদেও বসিয়েছেন ভিন্ন আদর্শের ব্যক্তিদের। ফলে বিপদের দিনে দলীয়ভাবে কোনো সুবিধা পায়নি। গত দেড় দশকে তাদের গণমাধ্যমগুলো বেদখলে চলে গিয়েছিল। জুলাই বিপ্লবের পর বেশ কয়েকটি ফিরে পেয়েছে। কিন্তু এতে দখলের বদনাম হয়েছে তাদের। দখলমুক্তর খবর প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
গত ১৫ বছরে বিএনপিপন্থি অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিক বেকার ও চাপে ছিলেন। ফলে পেশাগত দক্ষতা ও সক্ষমতা অর্জন করতে পারেননি অনেকে। এখন কাজের সুযোগ হলেও যোগ্যতার অভাবে সুযোগ পাচ্ছেন না কেউ কেউ। এখনো হতাশা বিরাজ করছে জাতীয়তাবাদী ঘরানার গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে। ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় দেশের গণমাধ্যম সুদৃশ্য শিকলে বন্দি তোতা পাখির মতো শেখানো বুলি আওড়াত। সেখানে বিরোধী দলের বা মতের নিউজ প্রকাশে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারের চেষ্টার অন্ত ছিল না। পেশাগত কারণেই তিনি সেটি করতেন। বিএনপি বিটের রিপোর্টাররা মাঠে নাজেহাল হতেন আর অফিসে হালে পানি পেতেন না। উপহাসের শিকার হতেন। মামলা-হামলায় পর্যুদস্ত শত শত বিএনপি নেতাকর্মীর অনিবার্য সান্ত্বনা ছিল এসব রিপোর্টার। দিন-রাত নেতারা ফোন বা বার্তাবাহক দিয়ে তাদের আপডেট জানাতেন। পরিবারের সদস্যদের চেয়েও আপন মনে করতেন। পটপরিবর্তনের পর সেসব নেতার অনেকে ওইসব সাংবাদিকের ফোন ধরার সময় পাচ্ছেন না। অথচ তাদের লাভজনিত অতিব্যস্ততার খবর সাংবাদিকদের জানা। ওইসব নেতার পাশে সাংবাদিক নামধারী কর্মচারী টাইপের নতুন লোক জুটেছে। বিএনপির খবর সংগ্রহ করতে করতে অনেক সাংবাদিক ফ্যাসিস্টবিরোধী কাফেলায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। অভ্যুত্থানের পর তারাও নিজেদের বিজয়ের অংশীদার মনে করেন। নতুন দিনে পুরোনো সঙ্গীদের ভুলতে দেখে বিএনপির প্রতি হতাশ অনেক সাংবাদিক। হতাশা থেকে তারা দলটির বিভিন্ন কমিটির সমালোচনা করছেন। কেউ কেউ বিশেষ কমিটিতে থেকে ভূমিকা রাখতে চান। যদিও এটা পেশাদারিত্ব নয়। বিএনপির সহায়তায় ভিন্ন মতাদর্শের লোক, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ লোকের পদায়ন দেখে ক্ষোভ জানান জাতীয়তাবাদী আদর্শের সাধারণ সাংবাদিকরা। আরও ভয়ংকর খবর হচ্ছে, জাতীয়তাবাদী ঘরানার সাংবাদিকদের ফোরাম প্রায় জামাতিকরণ হয়ে গেছে। সেখানেও বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে সহায়তার অভিযোগ রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, জামায়াত আদর্শের কোনো সাংবাদিক নিজেকে জামায়াত দাবি করেন না। বিএনপি বলে পরিচয় দেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ আচরণ ও নানা তৎপরতায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
বেশ কয়েক বছর আগে বিএনপি একটি মিডিয়া সেল গঠন করেছে। সমালোচনা আছে, এ সেলের বেশিরভাগ সদস্যই মিডিয়ার বাইরের লোক। তাদের মিডিয়ার কেউ চেনে না। তারাও মিডিয়া কী বোঝে না। তাদের কর্মকাণ্ড নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে আয়োজিত একটি কবিতার আসরে বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আয়োজক ও অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই আগে অন্য স্বরে অন্য কথা বলতেন। প্রশ্ন উঠেছে, তাদের হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিল কে? এরকম হাজারও প্রশ্ন বাড়ছে ফুলেফেঁপে ওঠা বিএনপিকে নিয়ে। সবাই বিএনপি হয়ে গেলে ভিন্নমত পোষণ করবে কে? যার জন্য এত কিছু! সবাইকে আওয়ামী লীগ হতে হবে বলে চাপ ছিল ভেতরে-বাইরে। এখন আওয়ামী লীগ কোথায়? গণতন্ত্রে সংখ্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে কোয়ালিটি ছাড়া অসংখ্য হলে বিপদ ডেকে আনে। গরু-গাধা-খচ্চর দিয়ে ঘোড়ার অভাব পূরণ হয় না।
লেখক: হেড অব নিউজ, আরটিভি