
নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম আরও জোরদার করার লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন সংশোধনের পথে এগোচ্ছে সরকার। এ উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’–এর খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। খসড়ায় ‘নতুন সার্ভিস’ চালু করে কমিশনের প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের প্রস্তাব এসেছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয় (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’–এর খসড়া উপস্থাপন করা হয়। জনপ্রশাসন ও আইন মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সভায় উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইয়াসমিন বেগম সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভায় নতুন অধ্যাদেশের খসড়াটির প্রেক্ষাপট ও যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়।
সভার শুরুতে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বলেন, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই সাংবিধানিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে কমিশনের প্রশাসনিক কাঠামোর স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এ লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে কমিশন থেকে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন, ২০০৯-এর প্রয়োজনীয় সংশোধন করা আবশ্যক। সে লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় একটি অধ্যাদেশের খসড়া এ বিভাগে পাঠিয়েছে। তাই প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয় (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ শীর্ষক অধ্যাদেশের খসড়া এবং তুলনামূলক বিবরণী প্রস্তুত করা হয়েছে। এ অবস্থায়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইনের খসড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক মতামত সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি বরাবর উপস্থাপন করা হলো।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এ সভায় প্রস্তাবিত অধ্যাদেশের খসড়ার ওপর কমিটির সদস্যরা আলোচনা করে কয়েকটি সুপারিশ করেন। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে– রুলস অব বিজনেস ১৯৯৬ অনুযায়ী কোনো মন্ত্রণালয়ে নতুন পদ সৃষ্টি, দপ্তর পুনর্গঠন বা নতুন সার্ভিস গঠনের উদ্যোগ নিতে চাইলে তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া করা যাবে না, বিশেষ করে— কোনো মন্ত্রণালয় বা অধিভুক্ত দপ্তরের কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হলে বা নতুন কোনো ইউনিট বা দপ্তর গঠন করতে হলে অথবা কোনো দপ্তর পুনর্গঠন করতে হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগবে। সুতরাং এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার কেবল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের থাকবে। কমিটি আরও সুপারিশ করেছে— অধ্যাদেশে ‘নির্বাচন কমিশন সার্ভিস’ গঠনে সংশ্লিষ্ট বিধান অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা আরও যাচাই করা সমীচীন হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে কমিশনের প্রশাসনিক ক্ষমতা সীমিত। সচিবালয়ের বাজেট অনুমোদন, কর্মী নিয়োগ ও নীতিগত সিদ্ধান্তে এখনো সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। নতুন অধ্যাদেশের খসড়ায় কমিশন সচিবালয়কে নিজস্ব বাজেট ব্যবস্থাপনা, স্বাধীন জনবল নিয়োগ এবং প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্য দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এতে কমিশনের কার্যক্রম দ্রুততর হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক চাপ কমতে পারে।
তারা আরও বলছেন, নির্বাচন কমিশন যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায়, তবে প্রশাসনিক স্বাতন্ত্র্য অপরিহার্য। প্রশ্ন হচ্ছে এই আইনের প্রয়োগ কতটা আন্তরিকভাবে হবে। সেই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আবারো জোরালো হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার আমলে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন প্রধান বিরোধী দল ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৮ সালে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে ফেলার অভিযোগ ওঠে। বিদেশি গণমাধ্যম লিখেছিল, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন ‘সরকারের ছায়াতলে পরিচালিত হচ্ছে।’ স্থানীয় সংস্থা সুজন, টিআইবিও নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেছিল। ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে কমিশন ভোটার উপস্থিতি ৪১ শতাংশ দেখালেও অনেক পর্যবেক্ষক সংস্থা বলেছিল প্রকৃত হার আরও কম ছিল। এই প্রেক্ষাপটে কমিশনের স্বাধীনতা বাড়ানোর উদ্যোগকে অনেকে সময়োপযোগী মনে করছেন।
বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে উপস্থিতি ছিল ৮৭ শতাংশ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তা নেমে আসে ৩৯ শতাংশে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় ৮০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে সরকারিভাবে দেখানো হয় ৪১ শতাংশ, তবে স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন তা আরও কম
‘নির্বাচন কমিশন সার্ভিস’ নিয়ে মতপার্থক্য
খসড়ায় সবচেয়ে আলোচিত প্রস্তাব হলো ‘নির্বাচন কমিশন সার্ভিস’। কমিশনের কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে আলাদা ক্যাডার সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব করা হলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে নতুন সার্ভিস অন্য ক্যাডারের সঙ্গে সংঘাত তৈরি করতে পারে।
এনআইডি কার কাছে থাকবে?
সূত্র বলছে, ২০০৭ সাল থেকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১২ কোটি ভোটার নিবন্ধিত আছেন। তাদের তথ্যভাণ্ডার শুধু নির্বাচনে নয়, ব্যাংক, মোবাইল ফাইন্যান্স, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সরকারি সেবায় ব্যবহৃত হয়। খসড়ায় কমিশনকে এনআইডির দায়িত্বে রাখা হলেও আলোচনায় এসেছে ভিন্ন প্রস্তাব।
নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, এনআইডি ডাটাবেজ একটি স্বাধীন সংবিধিবদ্ধ সংস্থার অধীনে দেওয়া যেতে পারে। এনআইডি শুধু নির্বাচনের বিষয় নয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত। এটি একটি স্বাধীন সংস্থার অধীনে থাকলে তথ্য ও নিরাপত্তা আরও ভালোভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে নির্বাচন কমিশনের কেউ কেউ মনে করছেন, এনআইডি চলে গেলে তাদের প্রভাব কমে যাবে। কারণ ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র দুটোই একই কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত।
বড় চ্যালেঞ্জ আস্থা ফেরানো
বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে উপস্থিতি ছিল ৮৭ শতাংশ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তা নেমে আসে ৩৯ শতাংশে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় ৮০ শতাংশের নিচে ভোট পড়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে সরকারিভাবে দেখানো হয় ৪১ শতাংশ, তবে স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা বলেছিলেন তা আরও কম।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই হার আসলে জনগণের আস্থাহীনতার প্রতিফলন। কমিশনের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতা বাড়লে সেই আস্থা ফিরতে পারে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে আইন পাস হলেই হবে না, বাস্তব প্রয়োগে আন্তরিকতা না থাকলে কমিশনের ওপর আস্থা ফেরানো যাবে না।
এদিকে, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন সংক্রান্ত আইন সংশোধন নিয়ে আলোচনায় আন্তর্জাতিক উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ভারতে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। বাজেট সরাসরি সংসদে অনুমোদিত হয় এবং সরকারি হস্তক্ষেপ সীমিত। নেপালে কমিশনের আলাদা সচিবালয় রয়েছে, যার প্রশাসনিক কার্যক্রম সরকারের নির্বাহী শাখা থেকে স্বতন্ত্র। পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোতে (যেমন- কানাডা, অস্ট্রেলিয়া) নির্বাচন কমিশন বা ইলেকশন অথরিটিজ আলাদা অর্থনৈতিক কাঠামো ও কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালনা করে। ফলে তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কম।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। অতীতের কয়েকটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় এখনই প্রশাসনিক ও আর্থিক স্বাতন্ত্র্য নিশ্চিত করার উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রস্তাবিত আইন সংশোধনের মাধ্যমে যদি নির্বাচন কমিশন নিজস্ব বাজেট ব্যবস্থাপনা, জনবল নিয়োগ ও নীতিগত সিদ্ধান্তে স্বাধীনতা পায়, তবে এটি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে পারে।
তিনি বলেন, শুধু আইন পাস করলেই হবে না এর কার্যকর প্রয়োগে সরকারের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন অপরিহার্য। যদি রাজনৈতিক চাপ ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব আগের মতো বজায় থাকে, তবে সংশোধিত আইনের সুফল জনগণ পাবে না। আবার এনআইডি ব্যবস্থাপনা স্বাধীন সংস্থার হাতে গেলে তথ্যের নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতা বাড়তে পারে, কিন্তু কমিশনের ভেতরকার ক্ষমতাকাঠামোতে ধাক্কা লাগার আশঙ্কাও অস্বীকার করা যায় না। আমার মতে, এ আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে কমিশনকে প্রকৃত স্বাধীনতা দেওয়া গেলে জনগণের আস্থা ফিরবে এবং দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে। অন্যথায় এটি কেবল আরেকটি কাগুজে সংস্কার হিসেবে ইতিহাসে থেকে যাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাফিজুর রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বলছে, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা শুধু সাংবিধানিক ঘোষণায় হয় না, প্রশাসনিক কাঠামো ও আর্থিক স্বাতন্ত্র্য দিয়েই তা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ যদি সেটি করতে পারে, তবে জনগণের আস্থা ফেরানো সম্ভব।
জনপ্রশাসন বিশ্লেষক ও সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একটি স্বাধীন ও কার্যকর নির্বাচন কমিশনের ওপর। অতীতের বিতর্কিত নির্বাচন ও কমিশনের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনার প্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত আইন সংশোধন তাই একটি বড় পরীক্ষা। আইন কার্যকর হলে কমিশনের স্বাধীনতা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়বে বলে প্রত্যাশা সবার। তবে বাস্তব প্রয়োগ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছাই শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ করবে এই উদ্যোগ গণতন্ত্রের জন্য নতুন অধ্যায় খুলবে নাকি পুরোনো বিতর্কের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, নতুন সার্ভিস মানে আলাদা কাঠামো ও সুবিধা। এতে বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোয় জটিলতা তৈরি হতে পারে। তাই এটি শুধু রাজনৈতিক নয়, প্রশাসনিকভাবেও সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত। কমিশনের ভেতরকার অনেকে অবশ্য বলছেন, আলাদা সার্ভিস গড়ে উঠলে কমিশন নিজস্ব জনবল তৈরি করতে পারবে। তখন মাঠপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণও কার্যকর হবে।