Image description

বিভুরঞ্জন সরকার

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বামপন্থি আন্দোলন একসময় ছিল বড় শক্তি। ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম পর্যন্ত শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক-খেতমজুর, তরুণ ছাত্রসমাজ—সবাই কোনো না কোনোভাবে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই ধারার মূল শক্তি ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান, শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন এবং সর্বোপরি জনগণের পক্ষে স্পষ্ট কণ্ঠস্বর। অথচ আজকের বাংলাদেশে বাম রাজনীতি যেন অতীতের স্মৃতি হয়ে উঠেছে। তাদের শক্তি, প্রভাব, এমনকি জনসম্পৃক্ততাও অনেকাংশে ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। কেন এমন হলো? ইতিহাসের প্রেক্ষাপট থেকে বর্তমান পর্যন্ত যাত্রা বিশ্লেষণ করলে এর উত্তর পাওয়া সম্ভব।

বাংলাদেশে বাম রাজনীতির শিকড় পাওয়া যায় ঔপনিবেশিক যুগেই। কৃষক বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, নকশাল প্রভাব—এসবই মূলত শোষিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নিয়েছিল। বিশেষ করে ১৯৪৬ সালের তেভাগা আন্দোলন পূর্ববাংলার গ্রামীণ সমাজে শ্রেণিসংগ্রামের চেতনা ছড়িয়ে দেয়। সেই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে ছাত্র কৃষক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং ছাত্র ইউনিয়ন, যা পরবর্তীসময়ে পাকিস্তানি শাসনবিরোধী সংগ্রামে বড় ভূমিকা রাখে। ভাষা আন্দোলনের সময়ও বামপন্থি ছাত্র-যুবকেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এই শক্তির বড় অংশ মুক্তিকামী পক্ষের সঙ্গে ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে স্লোগান জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যান্য বাম সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

কিন্তু স্বাধীনতার পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে আসার পর বাম রাজনীতির একাংশ রাষ্ট্রের সমর্থক হয়ে ওঠে, আরেক অংশ তীব্র বিরোধিতায় যায়। মস্কোপন্থি, পিকিংপন্থি, ট্রটস্কিবাদী—এমন নানান বিভাজন সংগঠনগুলোকে দুর্বল করে তোলে। আদর্শগত পার্থক্য এতটাই প্রকট হয়ে দাঁড়ায় যে একত্রে কোনো জনভিত্তি গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। সত্তরের দশকের শেষদিকে সামরিক শাসনের উত্থান এবং একের পর এক রাজনৈতিক দমনপীড়ন বাম রাজনীতিকে আরও দুর্বল করে ফেলে। তখনকার সময়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত, বিএনপি জন্ম নিচ্ছে, জামায়াত আবারও ঘাপটি মেরে উঠছে—সেই সময় বাম রাজনীতি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। বরং তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক, বিভাজন ও নেতৃত্বের সংকট বাড়তে থাকে।

সামনের পথটা তাই কঠিন হলেও সম্ভাবনাময়। হয়তো দেরি হয়ে গেছে, হয়তো অনেক ভুল হয়েছে, কিন্তু তবুও বলা যায়—বেটার লেট দ্যান নেভার। যদি তারা সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারে, যদি তারা জনগণের পাশে দাঁড়ায়, যদি তারা সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তোলে এবং ডিজিটাল যুগে নিজেদের কণ্ঠ পৌঁছে দিতে পারে, তবে একদিন হয়তো আবারও রাজপথে উচ্চারিত হবে মুক্তির ডাক। তখন হয়তো মানুষ আর প্রশ্ন করবে না—‘সখী তুমি কার?’ বরং মানুষ বলবে— ‘তোমরা আমাদেরই লোক।’

১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান বাম রাজনীতির জন্য ছিল শেষ বড় সুযোগ। ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বামপন্থি ছাত্র সংগঠন রাস্তায় নেমে আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে বাম ছাত্ররা, বিশেষত ৮০-এর দশকের ছাত্র ইউনিয়ন, ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায় রচনা করে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর যখন ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, তখন থেকে বামদের অবস্থান দাবি চাপা পড়তে থাকে । আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আন্দোলনের ফসল ভাগ করে নেয়, বামরা রয়ে যায় প্রান্তে। আন্দোলনের সামনের কাতারে থাকলেও রাষ্ট্রক্ষমতার কাঠামোয় প্রবেশের কৌশল তাদের ছিল না। জনভিত্তি থাকা সত্ত্বেও তা রাজনীতির মূলস্রোতে রূপান্তর করতে তারা ব্যর্থ হয়।

 

এরপরের দশকগুলোতে বাম রাজনীতি ক্রমশ কোণঠাসা হতে থাকে। একদিকে আওয়ামী লীগ, অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত—এই দুই মেরুতে দেশ বিভক্ত হয়ে পড়ে। বামরা কখনো স্পষ্টভাবে আওয়ামী লীগবিরোধিতা করে, কখনো আবার বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে নীরব সখ্য রাখে। এতে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে—তাহলে তোমরা আসলে কার পক্ষে? এভাবেই জন্ম নেয় বিখ্যাত উক্তি: ‘সখী তুমি কার?’ এই দ্ব্যর্থক অবস্থান বাম রাজনীতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেছে। মানুষ ভাবতে শুরু করে, তাদের আদর্শ আসলে কতটা দৃঢ়, আর কতটা কৌশলগত আপসের। বিশেষ করে জামায়াত-শিবিরের প্রশ্নে দ্ব্যর্থকতা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে নষ্ট করে দেয়।

বাম রাজনীতির পতনের আরেকটি বড় কারণ হলো জনগণের ভাষা হারিয়ে ফেলা। একসময় তারা ছিল শ্রমজীবী মানুষের মুখপাত্র। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের ভাষা হয়ে ওঠে কঠিন তাত্ত্বিক, একাডেমিক এবং সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। মাঠের মানুষের সমস্যা—চাষাবাদ, মজুরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান—এসবের বদলে আলোচনায় চলে আসে মতাদর্শিক পুথিগত তর্ক। ফলে শ্রমিক-কৃষকেরা ধীরে ধীরে দূরে সরে যায়।

সংগঠনের দুর্বলতা ও তহবিল সংকটও তাদের পতনের একটি বড় কারণ। বাম দলগুলো সবসময় আর্থিকভাবে দুর্বল ছিল। কোনো বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী বা প্রবাসী অর্থায়ন তাদের সঙ্গে ছিল না। নিজেদের সদস্যচাঁদা, ছোটোখাটো দান—এসব দিয়েই সংগঠন চালাতে হতো। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে বিপুল অর্থনৈতিক শক্তি সঞ্চয় করেছে। জামায়াতও ইসলামি ব্যাংকসহ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিপুল তহবিল গড়ে তোলে। এই বৈষম্যমূলক পরিস্থিতিতে বাম দলগুলো ক্রমশ কার্যকর আন্দোলন সংগঠিত করার মতো সক্ষমতা হারায়।

 

একসময় বাম রাজনীতির বড় শক্তি ছিল সংস্কৃতি। গণসংগীত, নাটক, কবিতা—এসবের মাধ্যমে তারা মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু নব্বইয়ের পর এই সাংস্কৃতিক শক্তিও ম্লান হয়ে যায়। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে তারা ব্যর্থ হয়। ডিজিটাল যুগে যখন তরুণদের রাজনীতিতে টানার নতুন পদ্ধতি প্রয়োজন ছিল, তখনও তারা পুরোনো ছকে পড়ে থাকে।

ফলে সামগ্রিক চিত্র দাঁড়ায় এভাবে—বাম রাজনীতি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও স্বাধীনতার পর থেকে ধীরে ধীরে প্রান্তিক হয়ে গেছে। বিভাজন, দ্বিধা, আর্থিক দুর্বলতা, সাংস্কৃতিক স্থবিরতা, জনগণের ভাষা হারানো—সব মিলিয়ে তাদের আজকের এই দুরবস্থা। অথচ ইতিহাস প্রমাণ করে, এই ভূখণ্ডে বড় পরিবর্তন সবসময় এসেছে সাধারণ মানুষের হাত ধরে, আর সেই হাত একসময় দৃঢ়ভাবে ছিল বাম রাজনীতির সঙ্গে।

দুই.
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগ আন্দোলন বাংলাদেশ রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়ের সূচনা করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং বিশেষ করে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল, তা মুহূর্তেই সারাদেশকে আন্দোলিত করে। সেই সময় রাজপথে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এক স্লোগান—'তুই রাজাকার’—যা হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধপন্থি শক্তির প্রতীক। এই আন্দোলনে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো, বিশেষত ছাত্র ইউনিয়ন, আবারও নিজেদের সক্রিয়তার প্রমাণ দেয়। শাহবাগে তারা শুধু উপস্থিতই ছিল না, বরং সাংগঠনিকভাবে সক্রিয় থেকেছে, সাংস্কৃতিক কর্মসূচি চালিয়েছে এবং একাত্তরের পক্ষের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে কাজ করেছে। এর ফলে একসময় মনে হচ্ছিল বাম রাজনীতি হয়তো আবারও জনভিত্তি পুনর্গঠন করতে পারবে।

কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনের পর যখন সময় গড়াতে থাকে, তখন দেখা যায় যে আওয়ামী লীগ ও বাম শক্তির সম্পর্ক নতুনভাবে সংকটময় হয়ে উঠছে। একদিকে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধপন্থি অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল, কিন্তু অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে বিরোধীদের দমন করতে গিয়ে তারা ক্রমে একনায়কতান্ত্রিক চর্চায় জড়িয়ে পড়ে। বাম দলগুলোর কাছে এই দ্বৈত অবস্থান এক ধরনের দ্বিধার জন্ম দেয়। ফলে অনেক সময় দেখা গেছে তারা একদিকে জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগবিরোধিতায় এতটাই মগ্ন থেকেছে যে বিএনপি-জামায়াতের সুবিধা হয়েছে। এই অবস্থান সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে—যারা একাত্তরের শত্রু শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছে, অথচ বাস্তবে তাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে সেই শত্রুদের রাজনৈতিকভাবে সুযোগ করে দিচ্ছে, তারা আসলে কার পক্ষে দাঁড়িয়ে আছে?

শাহবাগ আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ছাত্র ইউনিয়নসহ বাম ছাত্র সংগঠনগুলো আবারও রাজপথে কিছুটা সক্রিয় হয়। তবে সেই সক্রিয়তা স্থায়ী রূপ পায়নি। মাঝে মাঝে কিছু আন্দোলনে তারা সাহসী ভূমিকা রাখলেও ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারেনি। যেমন শিক্ষানীতির প্রশ্নে, কোটা সংস্কার আন্দোলনে, কিংবা ভিকারুননিসার ছাত্রী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনে তারা উপস্থিত ছিল, কিন্তু নেতৃত্বের আসনে বসতে পারেনি। ছাত্র রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এবং বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল সবসময় প্রভাবশালী থেকেছে, আর বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ধীরে ধীরে প্রান্তিক হয়ে গেছে।

গত এক বছরে একটি নতুন মোড় দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে সংবিধান সংস্কারের প্রশ্নে বাম দলগুলোর অবস্থান, কিংবা সম্প্রতি জামায়াত-শিবিরবিরোধী স্লোগান আবারও সামনে আনা, এগুলো ইঙ্গিত দেয় যে তারা হয়তো অন্ধ বিরোধিতার রাজনীতি থেকে সরে এসে আবারও নিজেদের অবস্থান পুনর্গঠন করছে। ‘তুমিও জানো, আমিও জানি, জামায়াত শিবির পাকিস্তানি’—এই নতুন স্লোগান আসলে সেই পুনর্গঠনের প্রতীক। এটি মনে করিয়ে দেয় যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থানই বাম রাজনীতির প্রাণশক্তি এবং সেটিকে ভুলে গিয়ে কেবল আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে লিপ্ত হওয়া আত্মঘাতী পথ।

তবে এখানে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়—এটি কি কেবল সাময়িক আবেগ, নাকি প্রকৃত পরিবর্তনের সূচনা? শাহবাগের পর যেমন দ্রুত আবেগ কমে গিয়েছিল, তেমনই কি আবার এই নতুন স্লোগানও মিলিয়ে যাবে? নাকি সত্যিই তারা একাত্তরের স্মৃতি পুনরুদ্ধার করছে? এর উত্তর এখনই বলা সম্ভব নয়, তবে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে দীর্ঘ সময় ধরে চলা অন্ধ বিরোধিতা হয়তো কিছুটা হলেও ভাঙছে। এতে স্পষ্ট হচ্ছে, তরুণ প্রজন্মের চাপ এবং ইতিহাসের দায় মিলিয়ে বাম সংগঠনগুলো আবারও মুক্তিযুদ্ধপন্থি অবস্থানের দিকে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে।

এখানে আরেকটি দিক লক্ষণীয়। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতি একটি কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি এই দুই মেরুকেন্দ্রীক রাজনীতি আপাতত নেই। কারণ গত বছরের জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ এখন মাঠছাড়া। বিএনপি এখন রাজনীতির মাঠের প্রধানশক্তি। তবে জামায়াত ও ইসলামপন্থি রাজনীতির উত্থানও চোখে পড়ছে। তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন দল এনসিপি জগাখিচুড়ি রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে এখন হিমশিম খাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিপরীতে জামায়াত এখন নিজেদের বিকল্প শক্তি হিসেবে দেখাতে চাইছে। কিন্তু একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার জন্য তাদের নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় আছে।

এখন সত্যিকার বিকল্প রাজনীতি গড়ে তুলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে। জামায়াত-শিবিরকে প্রত্যাখ্যান ছাড়া নতুন কোনো জাতীয় শক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় বাম রাজনীতির জায়গা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে। যদি তারা জনগণের কাছে পরিষ্কার বার্তা দিতে পারে যে আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুর্নীতি, দমননীতি কিংবা লুটপাট এবং জামায়াতসহ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বাইরে একটি বিকল্প পথ আছে, এবং সেই পথ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ওপর দাঁড়িয়ে, তবে হয়তো নতুন প্রজন্ম তাদের দিকে ফিরে তাকাতে পারে।

এই পথ কঠিন। কারণ একদিকে সাংগঠনিক দুর্বলতা, অন্যদিকে জনসংযোগের অভাব। আজকের তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেই তারা রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ নেয়। অথচ বাম সংগঠনগুলো এখনো ঐতিহ্যগত প্রচারণা পদ্ধতির ওপর নির্ভর করছে। এর ফলে তাদের কথা তরুণদের কানে পৌঁছায় না। শাহবাগ আন্দোলনের সময় ফেসবুক, ব্লগ, অনলাইন মিডিয়া বিশাল ভূমিকা রেখেছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাম সংগঠনগুলো সেই মাধ্যমকে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে।

তবে সম্প্রতি আবারও তারা নতুন স্লোগান দিয়ে জনমনে কিছুটা হলেও আলোড়ন তুলতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে। এটা ছোট একটি সাফল্য হলেও এর তাৎপর্য অনেক। কারণ রাজনীতি আসলে মানুষের হৃদয় নাড়া দেওয়ার শিল্প। ‘তুই রাজাকার’ যেমন এক সময় মুক্তিযুদ্ধপন্থি তরুণদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল, তেমনি ‘তুমিও জানো, আমিও জানি, জামায়াত শিবির পাকিস্তানি’ স্লোগানটি নতুন করে সেই চেতনা জাগিয়ে তুলতে পারে।

প্রশ্ন হলো, তারা কি পারবে? ইতিহাস বলে, প্রতিটি আন্দোলনের সাফল্যের জন্য তিনটি জিনিস প্রয়োজন—আদর্শে দৃঢ়তা, জনগণের সঙ্গে সংযোগ এবং সাংগঠনিক শক্তি। বাম রাজনীতি বহুবার প্রমাণ করেছে যে আদর্শে তাদের দৃঢ়তা আছে। জনগণের সঙ্গে সংযোগ ও সাংগঠনিক শক্তি তারা হারিয়েছে। যদি তারা নতুনভাবে সেই দুইটি স্তম্ভ পুনর্গঠন করতে পারে, তবে হয়তো আগামী দিনে আবারও গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠবে।

শাহবাগ আন্দোলনের পর এক দশক পেরিয়ে গেছে। সেই আন্দোলনের শিশু যারা তখন স্কুলে পড়ত, তারা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই নতুন প্রজন্ম রাজনীতি নিয়ে ভিন্নভাবে ভাবে। তারা আদর্শ চায়, কিন্তু একইসঙ্গে কার্যকর বিকল্পও দেখতে চায়। যদি বাম রাজনীতি সেই বিকল্প তৈরি করতে না পারে, তবে আবারও প্রমাণ হবে যে তাদের সমস্ত স্লোগান কেবল ক্ষণস্থায়ী আবেগ। কিন্তু যদি পারে, তবে একদিন আবারও রাজপথে শোনা যাবে স্লোগান—মুক্তির পথে বামপন্থা, শোষণমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন।

তিন.

বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। জনগণের একটি বড় অংশই এখন হতাশ—তারা আওয়ামী লীগের দমননীতি ও দুর্নীতিতে ক্লান্ত, আবার বিএনপির দুর্বলতা ও অক্ষমতায়ও আস্থা রাখতে পারছে না। ফলে এখানে একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে, আর সেই শূন্যতাই ভবিষ্যতের রাজনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। বাম রাজনীতির সামনে এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ, যদিও সেটি কাজে লাগানো মোটেও সহজ নয়।

প্রথমত, বাম দলগুলোর জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি পুনর্গঠন করা। একসময় গ্রামে-গঞ্জে, শ্রমিক-মহল্লায়, স্কুল-কলেজে বাম সংগঠনগুলোর ভিত্তি ছিল। আজ সেই ভিত্তি প্রায় নেই বললেই চলে। শহুরে ছাত্র আন্দোলনের ভেতরেও তারা প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। এই শূন্যতা পূরণ করতে হলে আবারও জনগণের কাছে ফিরে যেতে হবে। মাঠে থাকতে হবে শ্রমিকের পাশে, কৃষকের পাশে, ভুক্তভোগী মানুষের পাশে। শুধু ফেসবুকে বিবৃতি দিলেই রাজনীতি হয় না, আবার শুধু আদর্শের বুলি ঝেড়েও জনগণকে টানা যায় না। মানুষের দৈনন্দিন সমস্যার সমাধানে পাশে দাঁড়াতে হবে। যেমন—চাকরিপ্রার্থী তরুণদের জন্য আন্দোলন, শ্রমিকদের মজুরি ও অধিকার রক্ষার লড়াই, কৃষকের ন্যায্যমূল্যের জন্য সংগ্রাম—এসব বাস্তব ইস্যুই জনগণকে আকৃষ্ট করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, যোগাযোগের মাধ্যম বদলে গেছে। তরুণ প্রজন্ম রাজনীতিকে দেখে ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার কিংবা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে। সেখানে বাম রাজনীতির উপস্থিতি এখনও দুর্বল। অথচ যারা জনগণকে সংগঠিত করতে চায়, তাদের অবশ্যই এই প্ল্যাটফর্মে শক্তিশালী কণ্ঠ হতে হবে। স্লোগান, গান, পোস্টার—সবকিছু এখন ডিজিটাল আকারে মানুষের মুঠোয় পৌঁছে যায়। তাই যদি নতুনভাবে তরুণ প্রজন্মকে ছুঁতে হয়, তবে বাম সংগঠনগুলোর মধ্যে ডিজিটাল প্রচারণার একটি কার্যকর কৌশল তৈরি করতে হবে। শুধু প্রচারণা নয়, শিক্ষামূলক ও অনুপ্রেরণামূলক কন্টেন্ট তৈরি করতে হবে যাতে তরুণরা মনে করে এটাই তাদের আন্দোলন, তাদের রাজনীতি।

তৃতীয়ত, আদর্শের স্বচ্ছতা অত্যন্ত জরুরি। এতদিনের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে বাম রাজনীতির অনেক বড় সমস্যা হলো দ্ব্যর্থক অবস্থান। যখন জামায়াত-শিবিরের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিকে সরাসরি মোকাবিলা করার সময় এসেছে, তখন অনেকেই ‘আওয়ামী লীগবিরোধিতা’র নেশায় পড়ে সেই স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারেনি। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতে টিকে থাকতে হলে এই বিভ্রান্তি দূর করতে হবে। জনগণকে পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়ানো ছাড়া বাংলাদেশের কোনো বিকল্প রাজনীতি গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। জামায়াত-শিবিরকে প্রতিপক্ষ ঘোষণা না করলে কোনো শক্তিই জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারবে না। তাই বাম রাজনীতিকে প্রথমেই নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে—তারা মুক্তিযুদ্ধের ধারায় বিশ্বাসী, পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে আপসহীন এবং একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের একচেটিয়া রাজনীতির বিরোধী।

চতুর্থত, সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে নতুনভাবে জাগিয়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে সংস্কৃতি হলো বাম রাজনীতির শক্তিশালী অস্ত্র। গণসঙ্গীত, নাটক, কবিতা, পোস্টার—এসব মাধ্যম সাধারণ মানুষকে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছে। শাহবাগ আন্দোলনের সময় যেভাবে গান, কবিতা আর নাটকের মাধ্যমে লাখো তরুণ একত্র হয়েছিল, সেটাই আবারও প্রমাণ করে যে সংস্কৃতির শক্তি অবিশ্বাস্য। তাই ভবিষ্যতে যদি বাম রাজনীতি আবারও জনভিত্তি তৈরি করতে চায়, তবে তাদের অবশ্যই সাংস্কৃতিক লড়াইকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। শুধু বক্তব্যে নয়, গান-কবিতা-চিত্রকলা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করতে হবে।

পঞ্চমত, নেতৃত্বের প্রশ্নে নতুন প্রজন্মকে সামনে আনতে হবে। আজকের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিংবা সদ্য পাশ করা তরুণদের মধ্যে নতুন স্বপ্ন আছে, নতুন চিন্তা আছে। তারা আদর্শ চায়, কিন্তু একইসঙ্গে বাস্তববাদী হতে চায়। যদি ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা অন্য বাম সংগঠনগুলো তাদের নেতৃত্বের আসনে নতুন তরুণদের জায়গা না দেয়, তবে এই প্রজন্মকে ধরে রাখা যাবে না। নেতৃত্বে প্রবীণ-তরুণের মিশ্রণ থাকা জরুরি, কিন্তু তরুণদের হাতে বাস্তব ক্ষমতা না দিলে তারা আগ্রহ হারাবে। আর একবার তারা সরে গেলে আর ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে যাবে।

ষষ্ঠত, আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় নিতে হবে। আজকের পৃথিবী একেবারেই ভিন্ন। বৈশ্বিক পুঁজিবাদ, জলবায়ু সংকট, শ্রম অভিবাসন, তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার—এসবের সঙ্গে যুক্ত না হলে কোনো রাজনীতি টিকতে পারে না। বাংলাদেশের বাম রাজনীতি যদি শুধু পুরোনো স্লোগানেই আটকে থাকে, তবে তারা প্রাসঙ্গিক হতে পারবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, ডিজিটাল অধিকারের প্রশ্ন, নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার—এসব আধুনিক ইস্যুকে সামনে আনতে হবে। এতে করে শুধু বাংলাদেশেই নয়, বৈশ্বিক আন্দোলনের সঙ্গেও সংযুক্ত হওয়া সম্ভব হবে।

সবশেষে, রাজনীতিতে বিশ্বাসের সংকট দূর করতে হবে। জনগণ এখন রাজনীতিকে সন্দেহের চোখে দেখে। তারা মনে করে সব দলই ক্ষমতায় গিয়ে দুর্নীতি করে, জনগণকে ভুলে যায়। এই মানসিকতা ভাঙা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। যদি বাম রাজনীতি দেখাতে পারে যে তাদের নেতারা সৎ, স্বচ্ছ এবং ত্যাগী—তাহলে মানুষ আবারও বিশ্বাস করবে। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্ব যদি সামনে আসে, তবে জনগণ সেই নেতৃত্বের পেছনে দাঁড়াতে দ্বিধা করবে না।

সামনের পথটা তাই কঠিন হলেও সম্ভাবনাময়। হয়তো দেরি হয়ে গেছে, হয়তো অনেক ভুল হয়েছে, কিন্তু তবুও বলা যায়—বেটার লেট দ্যান নেভার। যদি তারা সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে পারে, যদি তারা জনগণের পাশে দাঁড়ায়, যদি তারা সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তোলে এবং ডিজিটাল যুগে নিজেদের কণ্ঠ পৌঁছে দিতে পারে, তবে একদিন হয়তো আবারও রাজপথে উচ্চারিত হবে মুক্তির ডাক। তখন হয়তো মানুষ আর প্রশ্ন করবে না—'সখী তুমি কার?’ বরং মানুষ বলবে—'তোমরা আমাদেরই লোক।’

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কলামিস্ট।