Image description
অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন
বিএনপি আমলের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন শিক্ষা বিষয়ক এক সেমিনারের আয়োজন করেছেন। এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। সেখানে তিনি বলেন যে, ‘রিভার্স ব্রেন ড্রেনই আমাদের শিক্ষার ক্রায়িং নীড’! এই ক্রায়িং নীডকে এড্রেস করার জন্য তিনি একটি পদ্ধতিও বাতলে দিয়েছেন। এর মাধ্যমে আমি আজকে ‘রিভার্স ব্রেইন ড্রেইন’ ঘটানোর একটা নতুন পদ্ধতি জানলাম।

তিনি বলেছেন, দেশে একটা ট্যালেন্ট পুল তৈরি করা উচিৎ। সেই পুল থেকে ট্যালেন্টদের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হবে। সেসব ট্যালেন্টেড শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দেশে আমাদের দেশের জন্য উপযোগী শিক্ষা অর্জন করবেন। তারপর আমাদের ট্যালেন্টরা আমাদের, মানে তাদের নিজের দেশে ফিরে আসবেন। দেশের সেবা করবেন। তাদের পুরো পড়াশোনার খরচ দেবে সরকার। তারপর পড়াশোনা শেষে তাদেরকে উচ্চসম্মানে দেশে ফিরিয়ে আনবে। উপযুক্ত কাজে লাগাবে। 

এটাই রিভার্স ব্রেন ড্রেন। আমাদের দেশের শিক্ষার জন্য এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন বা crying need! অর্থাৎ আমাদের ট্যালেন্টসরা দেশের ট্যাক্সের টাকায় বিদেশে কোটি কোটি টাকায় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে বিদেশে পাঠানো হবে। উচ্চ শিক্ষা শেষে তারা যে দেশে ফিরে আসবে তার কি গ্যারান্টি? আর এই ট্যালেন্টসদের যেই পুল তৈরি করা হবে, সেটা যে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হবে না, তারও কোনও গ্যারান্টি নেই। 

আমি ইংল্যান্ডে থাকা অবস্থায় দেখেছি, প্রচুর পাকিস্তানি এরকম স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পিএইচডি করেছে। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি, এরকম guaranteed সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে যারা পিএইচডি করতে যায়, তাদের পিএইচডির মান বেশি ভালো হয় না।  তার চেয়েও বড় কথা যারা ট্যালেন্টেড তাদেরকে দেশের ট্যাক্সের টাকায় পিএইচডি করতে পাঠাতে হবে কেন?

যারা ট্যালেন্টেড, তারাতো স্কলারশিপ, টিচিং বা রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপই পাবে। পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণার জন্য সাধারণত যেই দেশের যেই প্রতিষ্ঠানে পিএইচডির গবেষণা হয়, সেই প্রতিষ্ঠান বা সেই দেশের সরকারই স্কলারশিপ বা ফেলোশিপ দেয়। সেই দেশ বা সেই প্রতিষ্ঠান তখন তাদের স্কলারশিপ বা ফেলোশিপ দেবে। যারা পাবে তাদেরকে আমরা ট্যালেন্টেড বলব এবং তাদের নিয়েই আমরা ট্যালেন্ট পুল তৈরি করতে পারি। তখন আর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকবে না। 

এরকম পদ্ধতি চীন ৫০ ও ৬০ দশকে নিয়েছিল। সে সময় চীন বাছাই করে একদল ছাত্রকে রাশিয়ায় পাঠিয়েছিল, কারণ তখন চীনের ছেলেমেয়েদের পশ্চিমা দেশে পিএইচডির সুযোগ কম ছিল। কিন্তু এখন আর সে পদ্ধতি নেয় না বা নেওয়ার প্রয়োজনই নেই। এ ধরনের ট্যালেন্ট পুল তৈরি করে ট্যাক্সের টাকায় বিদেশে পাঠানোর বাস্তবতা বর্তমান বিশ্বে আর নেই। তবে সব কিছুর আগে শিক্ষায় জিডিপির ন্যূনতম ৫.৫ শতাংশ বরাদ্দের কমিটমেন্ট চাই।

আমি বেশ অনেক দিন যাবৎ বলে আসছি, চীনের মতো আমাদের উচিৎ একটা ট্যালেন্ট হান্ট প্রজেক্ট নেওয়া। এ প্রজেক্টের অধীনে বিশ্বের সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভালো মানের পিএইচডি করেছে বা যারা বিশ্বের বড় বড় গবেষকের অধীনে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক করছে কিংবা যারা ইতিমধ্যেই ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাদেরকে উচ্চ মানের বেতন, উচ্চ মানের থাকা খাওয়ার সুবিধা ও গবেষণার চালিয়ে যাওয়ার গারান্টেড সুবিধা দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করলে কি অসুবিধা? 

এতে আমাদের ট্যাক্সের টাকায় বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে সেখানে থেকে যাওয়ার রিস্ক থাকে না। যারা আসবে, তারা ভাববে, দেশ তাদের বিশেষভাবে সম্মান দিয়ে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই কাজটিই চীন করছে। আমরা কেন নতুন সংজ্ঞা দিচ্ছি?

লেখক: সিনেট সদস্য এবং অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

(ফেসবুক থেকে নেওয়া)