Image description
যুক্তরাজ্য থেকে ডা. আলী জাহান

১. শুক্রবার রাত ২ টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভিসি অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ কি উনার বাসভবনে ঘুমাচ্ছিলেন? হয়তো ঘুমাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁর ঘুমানোর কথা এবং অধিকার আছে। ভিডিওতে দেখলাম কিছু অস্থির বালক বালিকা ভিসি ভবনের গেটে জোরে জোরে ধাক্কাচ্ছে। এই ধাক্কার শব্দে মাননীয় উপাচার্যের এবং তার পরিবারের অন্য সদস্যদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটার কথা। আশপাশে যারা ছিলেন তাদেরও কপালেও হয়তো ঘুম লেখা ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকশো ছাত্র ছাত্রী (সর্বোচ্চ এক হাজার) মধ্যরাতে বিভিন্ন হল থেকে বেরিয়ে এসে ভিসি ভবনের উপর হামলে পড়েন। বাধ্য হয়ে মাননীয় উপাচার্য এবং প্রক্টরকে উত্তেজিত ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কথা বলতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু সেখানেও মজার ঘটনা ঘটে। ভিডিওতে দেখছিলাম অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ কয়েকবার কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু কিছু অস্থির ছাত্র-ছাত্রী তাকে কথা বলতে দিচ্ছিলেন না। বারবার তার কথা বাধাগ্রস্ত হচ্ছিলো। তাকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল। অন্যের কথা শোনার গুণাবলী আমরা অনেকেই রপ্ত করতে পারিনি।

 

২. জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে তাদের কমিটি ঘোষণা করেছিল। সঙ্গত কারণেই কিছু ছাত্র ছাত্রী বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেই বিক্ষোভ মিছিলের রূপান্তরিত হয়। কিন্তু কেন এ মিছিলগুলো শুক্রবার রাতেই করতে হলো? শনিবার দিনে করলে কী হতো? যারা এই মিছিলের আয়োজন করেছে তাদের কি কোনো পড়াশোনা নেই? বিশ্রামের প্রয়োজন নেই? সামনে কোনো পরীক্ষা নেই? কোনো এসাইনমেন্ট নেই? কোনো ক্লাস নেই? নাকি “নীলক্ষেত বিশ্ববিদ্যালয়” থেকে নোট এনে পড়লেই পরীক্ষা পাস?

৩. প্রায় ৪০ হাজার ছাত্রছাত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন হলে প্রায় দশ হাজার ছাত্রছাত্রী থাকেন। শুক্রবার রাতের মিছিলে ছিলেন কয়জন? কয়েকশো থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার। এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কী অধিকার আছে সংখ্যাগুরু ছাত্র-ছাত্রীদের ঘুম এবং পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটানোর? 

৪. বিক্ষোভ করার অধিকার আছে। ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই অধিকার থাকতেই হবে। ৫ আগস্টের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মত প্রকাশের জন্য কেউ শাস্তি দিতে আসছে না। কিন্তু আপনারা কেন অন্যদের শাস্তি দিচ্ছেন? মধ্যরাতের কার্যক্রম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক কর্মচারীদের জীবনকে জাহান্নাম বানানোর অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে?

৫. কেন এ বিক্ষোভ মিছিল শনিবার সকালে করা গেল না? ছাত্রদল কমিটি করেছে l আপনার দ্বিমত করার অধিকার আছেই। কিন্তু রাতে কেন এ মিছিল? ভালো কথা, ছাত্রদলের কমিটি গঠনের ব্যাপারে আপত্তি দিয়েছেন, কিন্তু ছাত্র শিবির হলের ছাত্রদের জন্য নিজ খরচে যে ওয়াটার ফিল্টার মেশিন দিয়েছে তা ভাঙতে গেলেন কেন?

৬. কেন রাতে মিছিল করে টেবিলে বসা বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনকে জাহান্নাম বানিয়ে দিচ্ছেন? বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টারে থাকেন এমন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদের রাতের ঘুমকে হারাম করার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? এই প্রশ্নের জবাব দেবে কে? 

৭. ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যে নতুন ভিসি নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তার ভেতর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ অন্যতম। তাঁর কিছু কার্যবিধি এবং বায়োডাটা দেখার সুযোগ হয়েছে। নিঃসন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একজন পন্ডিত এবং ছাত্রবান্ধব ব্যক্তিকে তার অভিভাবক হিসেবে পেয়েছে। 

৮. শুক্রবার রাতে তাঁর বাসভবনের সামনে তাঁর সাথে কিছু ছাত্র-ছাত্রীর তর্ক ও কথা বলার ধরন দেখে আমি অবাক হইনি। কারণ, কথা না শোনার অভ্যাস আমাদের জাতিগত। এই অভ্যাস থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারিনি। সে কারণেই অধ্যাপক নিয়াজ আহমদকে শুক্রবার রাতে খুবই অসহায় লাগছিল। কিছু অস্থির বালক বালিকা বুঝতে পারছিল না যে, তারা কার সাথে কথা বলছে। তারা হয়তো জানে না কীভাবে কথা বলতে হয়, অন্যের কথা শুনতে হয়।

৯. অন্যের কথা শোনার অভ্যেস এখন থেকেই গড়তে হবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই অমূল্য গুণ (skills) অর্জন করতে না পারলে সামনের জীবনে ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশে লিসেনিং স্কিলস না থাকলে কোথাও চাকরি করতে পারবেন না। একদম ঘাড় ধরে বের করে দেবে। অন্যের কথা শুনতেই হবে। অন্যকে কথা বলতে দিতেই হবে।

১০. নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেই অধিকার আদায় করতে গিয়ে অন্যের অধিকার হরণ করা কোনো সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে না। নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচতে দিন। ভিসির দায়িত্ব নিয়ে অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ কোনো পাপ করেননি যে ভোররাতে তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে অপদস্থ করবেন। এই অভ্যাস বন্ধ হওয়া উচিত। এখন না হলে আর কখনোই হবে না। 

ডা. আলী জাহান 

কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য 

সাবেক সরকারি কর্মকর্তা (বিসিএস স্বাস্থ্য) বাংলাদেশ